ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভৌতিক গল্প || পানির উপর বিড়াল হাঁটছে

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৩০ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভৌতিক গল্প || পানির উপর বিড়াল হাঁটছে

অলংকরণ: মারুফ খান

|| মনি হায়দার ||

 

রাতটা শান্ত, হালকা।

আকাশে চাঁদ নেই। পরিষ্কার আকাশে তারার ঝিকিমিকি। নিচে মাটির উপর আধা হাঁটু পানির উপর আমরা দুজন দাঁড়িয়ে মাছ মারছি। আমার হাতে হারিকেন। শামচু ভাইয়ের কাছে তিন ব্যাটারির টর্চ। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি। বিকেলে বোথলার বাজার থেকে আসার সময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, হাসান যাবি মাছ মারতে?

যামু।

তাইলে রেডি থাহিস। মুই রাইত সাতটার দিকে আমুনে তোর ঘরের সামনে। 

আইজ কোতায় যামু?

আইজ যামু মাঝের কোলায়।

মাঝের কোলায়? ওইহানে তো পানি বেশি। আমি বললাম, আর বেশি পানিতে মাছ পাওয়া যাইবে?

শামচু ভাই আমার চেয়ে এক হাত লম্বা। কালো রঙের দোহারা শরীর। মাথায় ঘনকালো চুল। নিজেদের জমির হালচাষ করে। মোটামুটি স্বচ্ছল গৃহস্থ। ছোট সময় থেকে দেখে আসছি বৈশাখের নতুন পানি উঠলে মাছ মারার জন্য পাগল হয়ে যায় এবং চৈত্র মাস থেকেই শামচু ভাই প্রস্তুত হতে থাকেন। আমার মেঝো ভাই খায়রুল আলী প্রায়ই সঙ্গী হয় শামচু ভাইয়ের। কিন্তু খায়রুল ভাই বিশেষ কাজে বড় মামার বাড়ি যাওয়ায় আমাকে ধরেছে। আমিও মাঝে মধ্যে যাই। কোলায় নতুন পানির মধ্যে রাতের অন্ধকারে তাজা মাছের আনাগোনা দৌড় ঝাপ আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। কিন্তু সমস্যা হলো মা।

তোর মাছ ধরতে যাওয়া লাগবে না, আমি মাছ ধরতে যেতে চাইলে আমাকে বাধা দেন।

কেন বাধা দেন সেটাই বুঝি। কয়েক বছর আগে পাশের বাড়ির রহমান মুনশী মাছ ধরতে গিয়ে ভূতের পাল্লায় পড়ে শেষ রাতে আধমরা অবস্থায় ঘরে ফিরেছিল। শেষে ওজা বৈদ্য এনে ঝাড়ফুঁক দিয়ে রহমান মুনশীকে তাজা করা হয়েছিল। আমিও চোখের সামনে ঘটনাটা দেখেছি। স্কুলে বিজ্ঞানের স্যার অতুল লাহিড়ী বলেন, ভূতপ্রেত বলতে কিছু নেই। ওসব ভয় পাওয়া মানুষের কল্পনা।

রাতে খায়রুল ভাই, শামচু ভাই, বিলাল চাচা, শংকর গোমস্তা, হরলাল মিস্ত্রি রাতের মাছ ধরার ঘটনা বলে, আর বিড়ি টানে, তখন মনে হয়, আমিও যাই। কিন্তু মায়ের কারণে পারি না। একরাতে মাকে না জানিয়েই মাছ ধরতে গেলাম কোলায়। মা মনে করেছিল ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু বিছানার উপর কোল বালিশ লম্বা করে উপরে পাতলা কাঁথা দিয়ে চলে গেলাম। মাঝরাতে যখন খাড়ই ভরে মাছ এনে মাকে ডাক দিলাম, মা তো অবাক!

মায়ের ভয় ভাঙল। সেই থেকে আমি মাঝে মাঝে মাছ মারতে যেতে লাগলাম। আমার ভালোই লাগে। আর কোলায়তো আমরা না শুধু, মূরার বাড়ির লোক, কালু বড় মিয়ার বাড়ির লোক, হিন্দু পাড়ার লোক… কতো মানুই নামে মাছ মারতে। মাছ মারতে মারতে দুই দল মুখোমুখি হলে দাঁড়িয়ে গল্প করে, বিড়ি টানে। মাছ মারার উৎসব মনে হয় আমার কাছে।

শামচু ভাই যখন বলল আইজ মাঝের কোলায় মাছ মারতে যামু, পাশ দিয়ে যাচ্ছির খালপারের জমির মৃধা। গলা বাড়িয়ে বলে, মাঝ কোলায় যাবার দরকার কী? তোমারা কোলার পারে পারে থাইকো।

গেলে কী অইবে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।

ওই জায়গাটা ভালো না।

আমি তাকাই শামচু ভাইয়ের দিকে। শামচু ভাইয়ের চোখ কঠিন হয়ে উঠেছে, ও মেরধার পো, এইসব গা জালাইন্না কতা আপনারে কেডা কইতে কইচে?

আমি তোমাগো মুরুব্বী। আমার জানা আচে হের লাইগা কইলাম। বচ্চর পাঁচেক আগে মুইও ওই মাঝ কোলায় মাছ ধরতে গেছিলাম। রাইতে ধরছে মোরে বোবাওলায়। আর তো পত চিনি না। শ্যাষে শ্যাষ রাইতে প্রায় বেহুষ অইয়া বাড়ি আইচি। আমার কতা আমি কইলাম, রাখলে রাখবা, না রাখলে নাই। জমির মৃধা লম্বা পা ফেলে চলে যায়। আমরাও আমাদের বাড়ি যাই।

ঘরে এসে দ্রুত হেরিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে, তেল ভরে প্রস্তুতি নেই। মাছের খাড়ইটা রান্নাঘর থেকে এনে আমার পড়ার ঘরে রাখি। মাকে বলি, আমারে ভাত দ্যান।

মা বড় একটা থালায় গরম ভাত, দুইদিন আগে ধরা খাইরুল ভাইয়ের মাছ ভাজা, পাতলা ডাল দিয়ে গপাগপ খেয়ে লুঙ্গি মালকোচা মেরে কেবল দাঁড়িয়েছি, শামচু ভাইয়ের হাক, কইরে হাসান? রাইত নাইমা আইতাচে। আয়, তাড়াতাড়ি আয়।

এইতো শামচু ভাই! হাতে হেরিকেন আর খাড়ই নিয়ে উঠোনে নামি। দুজনে হাঁটতে শুরু করি। পুরান বাড়ি পার হয়ে নয়াবাড়ির সামনে দাঁড়াতেই আমাদের সামনে দিয়ে তিন চারটে কুকুর শো শো শব্দ তুলে দৌড়ে চলে যায়। শামচু ভাই দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরায়। বিড়িতে আগুন লাগিয়ে টর্চ মারলো। গোটা পথ ফকাফকা, পরিষ্কার।

নতুন ব্যাটারি?

আমার প্রশ্নে দ্রুতই সাড়া দেয় শামচু ভাই, হ। আজকেই তিনটা নতুন ব্যাটারি কিনলাম। দেকচো কতো আলো অইচে?

হ, ম্যালা আলো। ঘাসের গোড়াও দেহা যায়।

হের লাইগাতো আইজ মাঝের কোলায় যামু। পানি একটু বেশি তো, বেশি পানির মইধ্যে নতুন ব্যাটারির আলোতে সব ফকফকা দেহা যাইবে। আর বড় বড় শৌল, গজার পাওয়া যায়।

গজারের চাইয়া মৌল মাছ খাইতে ভালো লাগে।

বেশি মরিচ দিয়া ভাজা ভাজা হরলে গজালের সামনে আর কোনো মাছই নাই। এতো টেস্ট!

দুজনে কথা বলতে বলতে বড় কোলার কিনারে এসে দাঁড়াই। ওমা, সারা কোলাজুড়ে মানুষের লাইন আর হেরিকেনের আলো। অনেক মানুষ মাছ ধরতে নেমে গেছে।

ও শামচু ভাই, এতো মানুষ নামচে, মোরা মাছ পামু?

মোরা ঠিকই পামু। আমার দিকে চেয়ে বলে শামচু ভাই, ওই দ্যাখ হাসান। মাঝের কোলায় কেউ নাই। আমরা অইহানে যামু। বড় বড় শৌল আর গজার…

দুজনে কোলায় না নেমে মাঝের রাস্তা ধরে রাস্তার মাঝখানে যাই। রাস্তার দুই পাশে হাঁটু বা হাঁটুর অর্ধেক পানি থৈ থৈ করছে। হালকা বাতাস। শরীরটা ফুরফুরে লাগে।

ল হাসান, বিসমিল্লা কইয়া নামি, শামচু ভাই কোলায় নেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমিও নামি। পানি পরিষ্কার। হেরিকেনের আলোয় সবকিছু দেখা যাচ্ছে। দুজনে পানির মধ্যে হাঁটছি। রাস্তা ছেড়ে মাঝের কোলায় যেতে অনেকটা পথ। আর পানির মধ্যে দ্রুত হাঁটা যায় না। শামচু ভাই একটা কোরাল গেথে ফেলে কোচে। আমিও একটা বাইলা আর দুইটা টেংরা কোচে গাথি। মনটা বেশ ফুরফুরে। বোঝা যাচ্ছে, আমরা সঠিক দিকেই আছি। এদিকে কোনো লোক নেই। ফলে ওই দিকে মানুষের নাড়াচাড়া খেয়ে মাছ চলে আসছে মাঝের কোলায়। মাঝের কোলায় ইমু মামার একটা বড় পুকুর আছে। আমরা সেই পুকুর পারে উঠলাম। ভালো করে লুঙ্গি কাচা দিয়ে আবার নেমে পড়লাম পানিতে। পানি কোথায় হাঁটু পর্যন্ত, কোথায় হাঁটুর অর্ধেক, কোথাও হাঁটুর বেশি। মাছও চারদিকে ফরফর করে। দুজনে একের পর এক মাছ মারতে থাকি। মাছ মারি আর খাড়ইয়ে রাখি। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনের খাড়ই আধা ভরে যায়। নানা ধরনের মাছ। টেংরা, শোল, বোয়াল, কোরাল, বড় বড় পুঁটি, গজারও…।

মাছ মারায় একেবারে দুজনেই মশগুল। কিন্ত আমার মনে হলো, কেউ একজন আমার পিছনে পানির মধ্যে থপথপ শব্দে হাঁটছে। ফিরে তাকাই শামচু ভাইয়ের দিকে। আর শব্দ নেই। তাকাই পিছনে, কেউ নেই। আমার ডান পাশে শামচু ভাই বড় একটা বোয়াল মারার চেষ্টা করছে। বুঝলাম, আমি ভুল শুনেছি। আবার হেরিকেনের আলো পানির উপর রেখে মাছ খুঁজতে শুরু করলাম। একটা বড় টাকি মাছ মারলাম। কোচ থেকে ছুটিয়ে খাড়ইয়ে রেখে আবার মাছ মারার নিশানা লাগাতেই পিছনে পানির মধ্যে সেই থপথপ পায়ের শব্দ। মাছের নিশানা বাদ দিয়ে পিছনে তাকাই, সব ঠান্ডা।

একটু ভয় লাগলো। ঘটনাটা শামচু ভাইকে বলবো? বললে, সকালে চারবাড়ির সবাইকে বলবে আর হাসবে। আমি দাঁড়িয়ে শামচু ভাইয়ের মাছ মারা দেখতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি, শামচু ভাই হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিসের শব্দ শুনলাম? তোর পায়ের শব্দ না?

হয়, আমি সাড়া দিয়ে আবার মাছ মারতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার পিছনে আবার থপথপ পায়ের শব্দ। আমার দিকে তাকায় শামচু ভাই, আমিও তাকাই। বুঝতে পারলাম, এতোক্ষণে শামচু ভাইকেও আক্রমণ করেছে থপথপ পানির শব্দ।

হাসান! শামচু ভাই মাছ মারা বন্ধ করে আমার কাছে আসে, একটা বিষয় খেয়াল করচো?

কী বিষয়?

আমাগো দুইজনার চাইরপাশে অনেক মাছ ঘোরতে আছে। একটা মারি দশটা আহে। ব্যাপারটা ভালো মনে অইতেছে না, শামচু ভাইর গলায় হালকা ভয়। সঙ্গে সঙ্গে কোলার উত্তর দিকে, পূর্ব দিকে তাকাই, কোনো আলোই নেই। কোলায় মাছ মারার কোনো লোক নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটাও তারা নেই। গোটা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।

শামচু ভাই, দেহেন তো কয়টা বাজে?

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শামচু ভাই অবাক, এতো ক্যামনে বাজে?

কয়ডা বাজে ভাই?

দ্যারটা।

কন কি দেরটা বাজে? বাজলো কহন? মনে অয় মাত্র আইলাম।

ঘড়ির কাটাইতো কইতেছে।

সঙ্গে সঙ্গে সারা কোলাজুড়ে হিমশীতল বাতাস বয়ে যায়। তীব্র সেই বাতাসে আমরা পানিতে উল্টে যাবার অবস্থা। অন্যদিকে কোলার মাছগুলো আমাদের ঘিরে মিছিল শুরু করেছে, শত শত মাছ, হাজার হাজার মাছ। মনে হচ্ছে সব মাছ মিলে আমাদের আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভয়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপতে শুরু করে। আমরা দুজনে শরীরের সঙ্গে শরীর রেখে দাঁড়াই। আমার মতো শামচু ভাইও কাঁপছে। দেখতে পেলাম পূর্ব দিকের হিন্দু পাড়ার গাছগাছালির উপর দিয়া একটা বিশাল লম্বা পা দিয়ে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা হাড়ের কংকাল ঠিক আমাদের সামনে দাঁড়ায়। আমি ভয়ে শামচু ভাইকে জড়িয়ে ধরি, ও শামচু ভাই...।

আমার ভারে ও ভূতের ভয়ে কাহিল শামচু ভাই আমাকে নিয়ে কোলার পানির মধ্যে পড়ে যায়। পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আর পানির ঠাই পাই না। মনে হচ্ছে এখানে পানি কোমড় সমান। খাড়ইয়ের মাছ পানির ছোয়া পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে লাফিয়ে লাফিয়ে বের হয় যায়। যে মাছগুলো মেরেছিলাম অধিকাংশই কোচের নির্মম আঘাতে নির্মমভাবে মারা গেছে। মরা মাছই রেখেছিলাম খাড়ইয়ে। সেই মাছ...। অবাক হয়ে দেখছি খাড়ইয়ের সব মাছ বেঁচে উঠছে এবং খাড়ই থেকে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাছগুলো হাসছে। ছোট ছোট শিশুর কিচির মিচির কণ্ঠে হাসতে হাসতে বের হচ্ছে।

ভূতের মুখে কোনো মাংস নেই, কেবল কটকটে লাল দাঁত কিরমির করছে আমাদের মুখের উপর। সেই সঙ্গে মণি শূন্য চোখ দুটি থেকে থেমে থেমে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। আমরা দুজনে জড়াড়রি ধরে পানির মধ্যে ডুবে যেতে চাই কিন্তু এখন পানি হাঁটু পর্যন্ত। পানির মধ্যে ডুবে যেতে চাইলেও ডুবে যেতে পারছি না। ভয়ে আর কাপুনীতে শরীরে কোনো শক্তি নেই। আমরা শরীর ছেড়ে দিই, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুখ পানির মধ্যে ডুবে যায়। আমরা ঢোকের পর ঢোক পানি খাই। পানি খেয়ে কোনোভাবে উঠে দাঁড়াই পরস্পরের হাত ধরে। দেখি, আমাদের সামনে কোনো ভূত নেই। শামচু ভাই আমার হাত ধরে, এই সুযোগ হাসান, দৌড় দে।

হয়, না দৌড়ালে আর রেহাই নাই।

তয় আতের হ্যারিকেন ছাড়বি না। শক্ত কইরা ধরবি। দে দৌড়...।

একে অপরের হাত ধরে আমরা দৌড়াতে শুরু করি প্রাণপনে। বেশ অনেকটা সময় দৌড়ানোর পর মনে হলো আমরা একটা বাড়ির কাছে এসেছি। শামচু ভাই টর্চ মেরে পথ  চেনার চেষ্টা করে। কোলার চারপাশটা আমাদের পরিচিত। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা কোন পথে এসে দাঁড়িয়েছি, চিনতে পারছি না। আবার পিছনে কারো হাঁটার শব্দ পাচ্ছি। দুজনে পিছনে ফিরে তাকাই, না কেউ নেই।

আমরা ভুল পোতে আইচি, শামচু ভাই যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। কিন্তু সাহস হারাতে চায় না। জানে, সাহস হারালেই ওরা মেরে ফেলবে। দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে শামচু ভাই বোঝার চেষ্টা করছে, আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি, বুড়ি নানিদের মতো সাদা কাপড় পরা কেউ একজন এগিয়ে আসছে বড় বড় পায়ে, পানির উপর দিয়ে...।

দৌড়.. হাসান দৌড়..। আমরা দৌড়াতে শুরু করি। যতো দৌড়াই ততই পানি বাড়ছে।

শামচু ভাই?

ফ্যাসফেসে গলায় বলে, কী অইচে?

এতো পানি আইলে ক্যামনে? মোগো কী চুবাইয়া মারবে?

শামচু ভাই দাঁড়ায়, পিছনে তাকায়, কেউ নাই। কিচ্ছু নাই। আমরা আবার কম পানির জন্য উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করি। কিছু দূর যাওয়ার পর শুনি আমাদের চারপাশে শত শত মানুষের পায়ের শব্দ, থপ থপ থপ থপ...। দৌড়–তে দৌড়–তে ঘাড় বাঁকা করে তাকাই, না কেউ নাই। তাহলে এই শত শত পায়ের শব্দ কোত্থেকে আসে?

হাসান?

শামচু ভাই!

ভাইরে, আইজ আর হারন নাই। ক্যান যে মাচ ধরতে আইলাম, ভাঙা গলায় আর্তনাদের স্বরে বলছে শামচু ভাই।

এহন কী হরমু?

আবার দৌড়াই, ডাইন দিকে। এই দিকে গেলে মোগো বাড়ি পাওয়া যাইবে।

লন তাইলে! আমার মুখ শুকিয়ে ছাই। শরীরে কোনো শক্তি নাই। মনে হচ্ছে পরে যাবো মাটিতে। জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছি।

ল! আবার দৌড়–তে শুরু করি হাঁটু সমান পানি ভেঙে। কিন্তু  কয়েক পা দৌড়ানোর পরই শুনতে পেলাম মিউ মিউ  মিউ মিউ শব্দ। দু’জনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাঁপছি থরথর। দেখি, আমাদের চারপাশে বেশ কয়েকটি কালো বিড়াল হাঁটছে পানির উপর দিয়ে। ওদের পায়ের সূচাগ্র নখও দেখা যায়, পানির রেখায় রেখায়। প্রত্যেকটা বিড়ালের চোখ থেকে লাল রক্তের নহর বইছে।

শামচু ভাই! মুই আর হাঁটতে পারছি না...। ঢলে পরলাম শামচু ভাইয়ের উপর।

হাসান! হাসান!! আমাকে দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শামচু ভাই, ও মনু হোন, ওসব কিচ্চু না। তোরে কইচি না সাহস রাখতে অইবে…।  মুখের উপর পানি ছিটিয়ে দিলে আমি চোখ মেলে তাকাই।

ভাইডি, বাঁছতে অইলে এই মাঝের কোলা দিয়া বাইর অইতে অইবে। ওঠ, খাড়া.. দৌড়... নাইলে ওরা ঘাড় মটকাইয়া মাইরা হালাইবে রে ভাইডি।

আমারও বাঁচার খুব ইচ্ছে হলো। শামচু ভাইয়ের হাত ধরি, চলেন।

দুজনে আবার দৌড় শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে এক জায়গায় এসে দেখি, সামনে কোনো পানি নেই। সব ফকফকা সাদা। আর বিরাট বিরাট সিরিজ গাছ তাল গাছের সারি। তালগাছে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা লম্বালম্বি হেঁটে উঠছে, হেঁটে নামছে।

ওরা আমাদের দেখে খিক খিক করে হাসতে শুরু করে। একটারও দাঁত নেই। কিন্তু হাসিগুলো দাঁতাল। আমি তাকাই শামচু ভাইয়ের দিকে, শামচু ভাই সামনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধপাস শব্দে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমিও।

সকালে মূড়ার বাড়ির মতিন মৃধা গরু নিয়ে যাচ্ছে ইরি ধানের চাষের জন্য। যেতে যেতে মতিন মৃধা দেখতে পায়, মূড়ার বাড়ির পিছনের দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে থেকে মানুষের চারটি পা বের হয়ে আছে। গরু রেখে মতিন মৃধা দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে চিৎকার শুরু করে, কেডা কোম্মে আছো, শিগগির বাইরে আও। কারা জানি খুন অইচে...। জঙ্গলে পইরা রইচে।

মুহূর্তের মধ্যে ছয় ঘরের ত্রিশ চল্লিশজন মানুষ ঘুম ঘুম চোখে মূড়ার বাড়ির জঙ্গলের পিছনে এলে, দেখতে পায় চারটি পা। কয়েক মুহূর্ত দেখে লোকজন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু মূড়ার বাড়ির আবু কালামের চোখে প্রথমে পড়ে একটা কোচ মাটিতে পড়ে আছে, আর একটু দূরে একটা খাড়ই। খাড়ইয়ের ভেতরের মাছ ছটছফ করছে আর কিছু মাছ মাছ শুকনো মাটিতে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। আবু কালাম নিজেও মাছ মারে। এগিয়ে গিয়ে প্রথমে দেখতে পায় শামচুকে, নিথর পড়ে আছে। পাশে আমাকে, নিশ্চল ঘুমুচ্ছি।

আবু কালাম দেখেই বুঝতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে বলে ছোট ভাই ফোরকনাকে, বাড়ির ভেতর দিয়া আগুন জ্বালানোর বাইল লইয়া আয়।

আমাদের দুজনের পাশে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ডাকছে...। শরীরে ম্যাসাস করছে। আমার আর শামচু ভাইয়ের চোখ একই সময়ে খুলে যায়। চারপাশের লোকজন দেখে অবাক। আমরা এখানে কেন সেটা আরো অবাক করছে। ইতিমধ্যে শাহজাহানের বাবা আমাদের জন্য গরুর দোয়ানু দুধ নিয়ে আসে দুই গ্লাস। আমরা ঢগঢগ খাই। আবু কালাম, মতিন মৃধা সহ সবাই আমাদের দাঁড় করিয়ে সুপারির বাইলে আগুন জ্বালায়, আমরা আগুনের আঁচে নতুন করে জীবনের দিকে যাত্রা করি।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুলাই ২০১৯/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়