ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হামিম কামালের গল্প || চূড়া

হামিম কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ৯ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হামিম কামালের গল্প || চূড়া

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

‘পাহাড়ে পাহাড়ে তো ঘুরলে অনেক।  এবার গল্পটল্প কিছু করো।’
    সোহাগ ভাই লোকটা অদ্ভুত। এমনিতে অনেক কথা বলবে, কিন্তু কোথায় গেছে তার গল্প করতে বললেই হাত দুটো দুপাশে মেলে দিয়ে কাঁধ ঝাকিয়ে বলবে, ‘এভাবে তো ভাই হয় না।’
    কিন্তু আমার এ কথায় আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। সূর্য গোপনে পশ্চিমে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল কিনা জানি না। সোহাগ ভাই বললেন, ‘এবার একটা ঘটনার কথা তোমাদের বলার জন্যে আমি আসার পর থেকে অপেক্ষা করছি।’
    গরমের রাত। ধানমণ্ডিতে আমাদের অজ্ঞাতবাসের কদমতলায় ছাপড়া দোকানের বেঞ্চিতে বসে দ্বিতীয় দফায় চায়ের অর্ডার হলো। কাপে চামচের টুংটাং বাজছে।  অলাত সিগারেট ধরাল।  সোহাগ ভাই বলতে শুরু করলেন। 

তিন্দুর পুবদিকে অত্যন্ত দুর্গম পথ ধরে টানা এগোনো আর ক্যাম্প ফেলার চতুর্থ দিন এক পর্বতের গোড়ায় এসে থামলাম। পাহাড়ে আসার তৃতীয় দিন হলো একটা বিশেষ দিন। এই দিনে অতি বড় সুবোধ দলেও দ্বিধা আসতে শুরু করে, দ্বিমত আসতে থাকে। কেউ বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। দলনেতার সংকট উপস্থিত হয়। উপরন্তু আজ চতুর্থ দিন। এতোদিন আমরা সামনে যা পাচ্ছিলাম তাই উৎরে যাচ্ছিলাম। আজ আমাদের অমন অভিযাত্রী দলটাও দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। দেখা গেল অচেনা পর্বতের চূড়ায় ওঠার ইচ্ছা সবার নেই। 
    এখানে বলে রাখি, অভিযানে ছিলাম আমরা ন’জন। সাতজন আমার বিভিন্ন অভিযানের সঙ্গী, আর দুজন নতুন মানুষ। তাদের ভেতর একজন খোবেল টিপ্রা নামে বছর পঁচিশের এক পাহাড়ি তরুণ। অপরজন আনিস আহমেদ নামে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। প্রথমেই খোবেল কাটা পড়ল। এখানে আমরা ক্যাম্প ফেলব কিনা জানি না, সুতরাং খাবারের বোঝা টানিয়ে ওকে বৃথা ক্লেশ দেওয়ার মানে হয় না। রইল বাকি আট। তাদের ভেতর চারজনের হাত তুলে আত্মসমর্পণ। এক সৌখিন পর্বতারোহী জুটি— গোঁসাই আর শীলা। সঙ্গে দুই তাসুড়ে, রবি আর রিকি।  
গোঁসাই আর শীলা দুজনই ননীর পুতুল পরিবার থেকে আসা। ওরা যা দেখিয়েছে তা এমনিতেই অকল্পনীয়। তাই আর না যেতে চাইলে দোষ দেওয়া যায় না। এদিকে রবি আর রিকিকে দেখলে জেমি ইউওয়াইজের গডস মাস্ট বি ক্রেজি চোখে ভেসে ওঠে । বিপ্লবী স্যাম বোগার দুই তাসুড়ে সৈন্য যেন ওরা, সুযোগ পেলেই তাস পেটাচ্ছে। অদ্ভুত। তো, আমিসহ চারজন কেবল উঠতে রাজি। তাদের ভেতর আছে ময়ূখ-কমল জোট, আর আছেন ওই নবীন ভদ্রলোক— আনিস আহমেদ।   
ময়ূখ আর কমলকে আমি আগে থেকে চিনতাম। আমার সাথে বন্ধুত্ব না থাকলেও আমার আগের অভিযানে ওরা ছিল বিধায় আলাপ আছে। দুজনই আচরণে নির্বিরোধী, আর কৌতূহলী। শক্তিই বলো আর দুর্বলতাই বলো, ওরা সবসময় একসঙ্গে আছে। এরকম বন্ধুত্ব দেখা যায় না।  
তৃতীয় ব্যক্তি, মানে আনিস আহমেদ, একেবারেই আনকোরা, আগেই বলেছি। তার সাথে আলাপ সদরের বাজারে। ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হলো বয়স ষাটের কাছাকাছি। বরাবর একা বেড়ানো অভ্যাস, তবে তরুণদের সঙ্গ পেতে ভালো লাগে। বান্দরবানে বিশেষ কোথাও যাওয়ার নেই। আমাদের দলে তাকে নিতে আপত্তি আছে যখন কিনা জানতে চাইলেন, ভেবে দেখলাম, অসুবিধে কোথায়। সুবিধা-অসুবিধা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো সবখানে, সবসময় আছে। অভিযাত্রীর কিন্তু তাকে আলিঙ্গন করতে হয়। আর নতুন মানুষ মানে নতুন অভিজ্ঞতা। তাছাড়া আমার সঙ্গীযোগ বরাবরই ভালো। পথে এমন অনেক মানুষ আমার সাথী হয়েছেন যাদের সঙ্গে আজো যোগাযোগ, বন্ধুতা আছে।  মনে মনে রাজি হলাম। কিন্তু অন্যদের অভিমতও তো চাই। ভদ্রলোককে দেখে, তার কথা শুনে খোলা মনের মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল। এখন এটা যদি তার মুখোশ হয়ে থাকে, তো কী করা যাবে। দেখলাম, অন্যদের মনের ভাবও তা-ই, সবমিলিয়ে আপত্তি করল না কেউ। তবে দ্বিধা একটাই, তা হলো ভদ্রলোকের বয়স। অল্টিচিউডে যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন? 
ঝুঁকিটা আমরা নিয়েছিলাম। এখন প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিই যে নিয়েছিলাম ভাগ্যিস;  যাহোক, সেই থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে। আমরা থানচি আরো দক্ষিণে যেতে চাইলে ভদ্রলোকের না নেই। তিন্দুর পুবদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্যাম্প ফেলতে ফেলতে এগোব বলায়ও একবার ভেবে রাজি। এ পর্যন্ত যেসব ছোট ছোট টিলা, খাঁজ, পাহাড়ি নদী পেরিয়েছি, তাতে সাধ্যের তেমন পরাকাষ্ঠা কাউকেই দেখাতে না হলেও, প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কাছে অবচেতনভাবেই হয়ত একটু কম আশা করায় আমাদের কিন্তু বেশ রকম অবাক হতে হয়েছে। রীতিমতো ভালো দেখিয়েছেন তিনি। শরীর এবং মনে যথেষ্ট জোর। এই অচেনা উঁচু পর্বতে চড়ার দলে ঢুকে পড়াটা স্রেফ তারই একটা ধারাবাহিকতা— যা বুঝলাম।  
    যাহোক, চারজনের ব্যক্তিগত আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিছু আলাদা করে আমরা উঠতে শুরু করলাম। প্রয়োজনীয় বলতে যার যার খাবার পানি, স্যালাইন, ফার্স্ট এইড এসব। জিপিএস তো আছেই। আসল খাবার দাবার, সঙ্গে ক্যাম্প করার জিনিসপত্র এসব নিচেই থাকল। 
আসার পথে আমরা টিলার ওপর, বা সাঙ্গু নদীর ধারে রাত কাটিয়েছি। এ পাহাড়ের চূড়া ভালো লেগে গেলে আজ রাতটা এটার ওপরই কাটাব। খাবার আর তাঁবু নিয়ে তখন উঠে আসতে বলব আলসেগুলোকে, আমি আর নামব না। মনে মনে এই দুষ্টুবুদ্ধি।

মচ্ মচ্ মচ্... পায়ের নিচে ঝরা পাতার মাদুর। পাহাড়ে ঝরা পাতার কোনো শীতগ্রীষ্ম নেই। পাতার আড়ালে থাকা একটা পাহাড়ি হলুদ হঠাৎ আমার পায়ে চাপে ভেঙে, চারপাশ ঘ্রাণে ভরে গেল। চড়ার মুখেই হলুদ ভাঙা নাকি শুভলক্ষণ। 
আবহাওয়া বেশ ভালো, এপ্রিলের শুরুর দিকের সময় বিধায় পাহাড়ে ভরা বসন্তকাল। বাতাস হালকা বলে গরমের ভ্যাপসামো নেই, কিন্তু পরিশ্রমের কারণে দরদরিয়ে ঘামছি। তারপরও ভালো লাগছে। পাহাড়ে ওঠার সময় একভাবে ঘামার কারণে লবণপানি বেরিয়ে যায় শরীর থেকে, তখন ঝিমুনি আসে, একটা ঘোর তৈরি হয়। বুঝতে পারছিলাম আর কিছুক্ষণের ভেতরই ওটা শুরু হয়ে যাবে। তার আগে কতটা উঠতে পারব না-পারব তার একটা আঁচ করব বলে ওপরের চূড়ার দিকে ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছিলাম। 
জিনের পাহাড় বা চুম্বক পাহাড়ের মতো মানুষের অনেক মজার দৃষ্টিভ্রমের আরো একটা হলো— নিচ থেকে ওপরের দিকে তাকিয়ে ততটা উঁচু মনে হয় না, যতটা ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে মনে হয়। এজন্যেই বোধয় ছোটমনের মানুষেরা বড় মানুষদের খুব সহজে অপমান করতে পারে, আবার খানিক ওপরে উঠে গিয়ে লোকে খুব সহজেই নিচের মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারে, হোহো। যাহোক; যথারীতি, পাহাড়ের চূড়াটা তত উঁচু মনে হলো না, সুতরাং কিছুক্ষণ খুব তেজের সাথে উঠলাম। কিন্তু একটুপরই কাঁধের ওপর ভূত চেপে বসল। কানের দুপাশ ধরল চেপে। সঙ্গে একটা শোঁ শোঁ সংগীত শুরু হয়ে গেল মাথার ভেতর। 
চূড়া কিন্তু তার আগের জায়গাতেই স্থির। এদিকে উরু ধরে গেছে ব্যথায়। মনে হলো পায়ের পেরিফেরাল হার্টে কোনো গণ্ডগোল বেঁধে গেছে। আমার তো আবার মাসল স্পাজম আছে তোমরা জানো। ঝুঁকে উঠতে গিয়ে না আবার মেরুদণ্ডের ডিস্ক নড়িয়ে ফেলছি, এই ভেবে উল্টো হয়ে উঠলাম কিছুক্ষণ। সবাই মিলে হাসতে থাকল। নিজেও হাসলাম, কী করব, নিরুপায়।  
মাথার ব্যথাটা যায়নি তখনও, যাওয়ার কথাও ছিল নয়। কানের দুপাশে চাপ তখন আরো বেড়েছে। মন মনকে মনে করিয়ে দিলো, যত বেয়াড়াই হয়ে থাকো, অভিযানে নিজের শরীরের সাথে যুদ্ধ করতে নেই। চিৎকার করে  অন্যদের বললাম, ‘তোমরা ওঠো ভাই, আমি একটু থামছি। ’
আমি থেমে গেছি দেখে মুহূর্তের জন্য ওরাও যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। বসে পড়ার পর নিজের বুকের ধুকপুকটা কানে আসতে থাকল আমার। দেখি আবার হাঁটতে শুরু করেছে ময়ূখ আর কমল। আনিস আহমেদ বেশ নিচে পড়ে আছেন। তার কেমন লাগছে কে জানে। খুব কষ্ট হওয়ার কথা। আমাদের মতো তরুণের যদি এ অবস্থা হয়, তার নির্ঘাৎ আরো খারাপ লাগছে। 
ময়ূখ কমল আমার কাছ থেকে খানিকটা দূরে হাতপা ছড়িয়ে বসল। নীরক্ষরেখার নিচের পাহাড়। থেকে থকে গরম বাতাসের একেকটা হল্কা আসছে। আর গাছপালার প্রস্বেদনের গরম। 
ভদ্রলোক কাছাকাছি আসতেই হাসি বিনিময় হলো। মনে হলো না তিনি দাঁড়াবেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। বেশি বিশ্রাম নেওয়া বারণ। শরীর শিথিল হয়ে যায়। চূড়াটা যেন এবার খানিকটা এগিয়ে এসেছে। 
আবার উঠছি। ঘন ঘন ঢোক গিলছি। তাতে কানের ওপরকার চাপ কিছুক্ষণ কমছে, তবে শুকনো গলায় ঢোক আর কত গেলা যায়। চূড়াটা বড্ড চোখ টানছে। তাকাতে চাইলাম, কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে এসে চোখের ভেতর ঢুকে পড়ে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। জিপিএসের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আড়াইশ মিটার উঠেছি, কিন্তু এখনও পর্বতের অর্ধেকও পেরোইনি। এর মানে হলো এটা যে একটা পর্বত শুধু তাই না, বাংলাদেশের বিচারে বেশ নামী পর্বত হওয়ার কথা এর।  অথচ খোবেল টিপ্রাও কিছু বলতে পারল না।  কে জানে, আরো স্থানীয় কাউকে ধরতে পারলে হয়ত জানতে পারব। খোবেলের বাড়ি আরো উত্তরে। 

আনিস আহমেদ তখন আমায় একবার অতিক্রম করে গেছেন। আধঘণ্টার ব্যবধানে আরো একবার অতিক্রম করে গেলেন। তখন আমি বসে আছি একটা পাথরের ওপর। তার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। এবার আর আগের সেই হাসি হাসলেন না। তার মনের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আছে না কিছু মানুষ, যারা তরুণদের ক্লান্ত হতে দেখলে অবজ্ঞা করে খুব কথা শোনান? যেন তরুণরা তরুণই, তারা মানুষ নয়।  তেমন কি ব্যাপারটা? হতেও পারে। কিন্তু মন থেকে সাড়া পেলাম না। কারণ অমন লোকের চোখ বা ঠোঁটে প্রতিক্রিয়ার যে চিহ্নটা দেখে আমি অভ্যস্ত, তেমন কোনো চিহ্ন এঁর নেই। 
ব্যাগ খুলে ঢকাঢক স্যালাইন খেলাম। থেকে থেকে মনে হচ্ছিল, এ পাহাড়ের নিচে এমন কিছু আছে যেটা কেবল আমাকেই উঠতে দিচ্ছে না। অন্যেরা দিব্বি তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু আমার অবোধ মনের এ দাবি ভুল শতভাগ। দেখলাম আনিস আহমেদও দিক বদলে উত্তর দিকের চড়াই ছেড়ে খানিকটা দক্ষিণের সরে এসে একটা পাথরের ওপর বসে গলা ভেজাচ্ছেন। ময়ূখ পাহাড়ের ঢালে শুয়ে পড়ে চোখের ওপর হাত রেখে মেঘের ভেড়া গুনতে লেগে গেছে, আর কমলও ছড়িয়ে বসে কুড়িয়ে পাওয়া একটা ওলটকম্বল গাছের বড় পাতা দিয়ে নিজেকে হাওয়া করছে। হাত তুলতে ওরাও সাড়া দিলো। 
জিপিএস দেখলাম। চারশ পঁচানব্বই মিটার। 
পর্বতের গোড়ার দিকে তাকালাম। গাছপালার মাথা ছাপিয়ে বহু নিচে আঁকা বাঁকা পায়ে চলা পথ আর হাতিঘাসের জঙ্গল। সঙ্গীদের কাউকে দেখা গেল না। ছায়া দেখে কোথাও বসেছে হয়ত।  ঘুরে আবার প্রৌঢ়ের দিকে তাকালাম। তিনি ওঠার উপক্রম করছেন। 
‘দাঁড়ান,’ আমি চিৎকার করে বললাম। ‘একটু খানি প্লিজ।’
ভদ্রলোক দাঁড়ালেন। আমি আবার উঠতে শুরু করলাম। 
হুফ হুফ হুফ! আরো মিটার পঞ্চাশেক কৌণিক অবস্থানে তিনি বসে। কাছাকাছি পৌঁছতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি ঘর্মাক্ত হাতে তার শক্ত হাতটা ধরে কয়েক পা ওপরে উঠে এসে থেমে দাঁড়িয়ে তাকে স্যালুট করলাম। যে স্যালুটে মাথার চুল অব্দি নেচে ওঠে। গত কয়েক ঘণ্টা যা দেখছি, তাতে মনে হয়েছে এমন স্যালুট পাবার যোগ্য তিনি। 
‘আপনি কিভাবে এতো সহজে উঠে আসছেন? কী সাংঘাতিক।’
ভদ্রলোক হাসলেন। শিশুর এঁচড়ে পাকা রাজনৈতিক মত শুনে বড়রা যেভাবে আসে। বললেন, ‘সহজে উঠে আসছি? আপনি নিশ্চিত?’
পাল্টা এমন প্রশ্নে আমি বিব্রত হয় উঠলাম।  আমাকে যেমন মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে, শারীরিক দুর্বলতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, এঁকেও একই লড়াই করে তবেই উঠতে হচ্ছে। কোনো ছাড় তো পাচ্ছেন না তিনি। বরং তার যেসব শারীরিক ঘাটতি রয়েছে সেসব আমার নেই। অর্থাৎ আমার শব্দনির্বাচন হয়েছে বুদ্ধুর মতো। তবে একটা ব্যাপার সত্য, তা হলো— গত কয়েক ঘণ্টায় মিস্টার আনিস আহমেদের ধীর কিন্তু স্থির পর্বতারোহন দেখে মনে হয়েছে, এমন একটা কিছু তিনি জানেন, যা আমি বা আমরা জানি না। কী সেটা?
আমি হাত তুলে বললাম, ‘মাফ করবেন। আমি আসলে যা বলেছি ঠিক তা বোঝাইনি,’ হাঁপাচ্ছি তখনো। ‘আসলে আমাকে যে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আপনাকেও তাই করতে হচ্ছে। কিন্তু একটা কিছু আপনাকে এগিয়ে রাখছে। সেটা কী ধরতে পারছি না।’
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। আমি দেখেছি, বড় মানুষেরা নিজেরাও অকপট বিধায়, যারা অবাধে অজ্ঞতা  প্রকাশ করে তাদের বিমুখ করেন না। হাসি থামিয়ে আমার বাহুতে একটা হাত রেখে বললেন, ‘ক’টা পাহাড়ে চড়েছেন আপনি?’
‘বেশি নয়,’ কমিয়ে বললাম ভদ্রলোককে, পাছে বিব্রত হতে হয়। ‘দেশের ভেতর কেওকারাডং, আর দেশের বাইরে লুম শাইলং। আপনি?’
ভদ্রলোক যেন আমার শেষ প্রশ্নটা শুনেও শুনলেন না। নীরবে পর্বতের চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। আবার যখন আমার দিকে ফিরেছেন, দেখি পুরনো হাসিটা আবার ফিরে এসেছে। 

 ‘ওঠা শুরু করার পর এই প্রথম চূড়ার দিকে তাকালাম আমি,’ তিনি বললেন। 
এরপর যেন আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চান, এমনভাবে তাকালেন। আমি বললাম, ‘এই প্রথম? আচ্ছা।’ 
‘হ্যাঁ, উঠতে শুরু করার আগে একবার দেখেছিলাম। আর ওঠার শুরুর পর এই প্রথম।’
‘বেশ,’ কেমন নির্বোধের মতো বললাম আমি। তার ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে অবোধ শিশু মনে হচ্ছিল। ভাবলাম, তিনি নিশ্চয়ই আমায় নিয়ে হতাশ। কী বলতে চাচ্ছেন আমি তাও ধরতে পারছি না, আর এসেছি পর্বত বাইতে। বর্তমান প্রজন্মকে শাপশাপান্ত করে বোধয় একদম একপাশ করে ফেলছেন মনে মনে। কিন্তু তাই যদি হয়, তো তার চোখ কিছু বলছে না কেন? উল্টো মনে হচ্ছে সেখানে কেমন একটা প্রশ্রয় খেলা করছে। 
আমার বাহু ছেড়ে সোজা হয়ে হাত দুটো হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির নায়কের মতো বুকের ওপর বেঁধে তিনি বললেন, ’আপনি বোধয় আমার কথাটা ধরতে পারেননি।’
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। অস্বীকার করে লাভ কী। মাথা দু’পাশে নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম, আসলেই ধরতে পারিনি। 
তিনি বললেন, ‘ওঠা শুরুর পর আমি এই প্রথমবার তাকালেও আপনি কিন্তু কম করে হলেও পঞ্চাশবার তাকিয়েছেন।  এই পঞ্চাশবার আপনার শক্তিক্ষয় হয়েছে, আর আমার হয়েছে মাত্র একবার। ময়ূখ আর কমল নিজেদের নিয়েও খানিকটা ব্যস্ত, তাই তাদের শক্তিক্ষয় আপনার চেয়ে কম হয়েছে। তাই শুরুর দিকে আপনি এগিয়ে থাকলেও ক্রমশ ফলটা কী হয়েছে এবার দেখুন। 
আমি ওপরে ময়ূখ কমলের দিকে তাকালাম। 
ঘুরে আবার তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। 
আমার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। তিনি হাসছেন। হাসিটুকু ধরে রেখেই বললেন, ‘যদি কোনো শক্তি থেকে থাকে তো তা এই মানসিক কৌশলে। আর যদি আপনার কোনো দুর্বলতা থেকে থাকে, তো সেটাও এখানেই।’
যেন দুর্বোধ্য এক আলোর রেখা আমাকে বোকা করে দিয়েছে। মনে পড়ল পাহাড়ি হলুদের ঘ্রাণ। আজ তাহলে আমার শুভ জ্ঞানযোগ। আমি হঠাৎ পাওয়া এই গুরুর কাছ থেকে বহু কষ্টের দামে এক অদ্ভুত জ্ঞান লাভ করলাম, যে জ্ঞান নিজের মতো আবিষ্কারে হয়ত আমার এক জীবন লেগে যেত।  ভদ্রলোক শেষ পেরেকটা ঠুকলেন। কাটা কাটা শব্দে বললেন, ‘ওঠার সময় আরোহীদের চূড়ায় তাকাতে নেই। জীবনের সর্বক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য মনে রাখবেন।’
তাকিয়ে দেখি তার মুখে সেই হাসি আর নেই। বরং দ্বিতীয়বার আমাকে অতিক্রমের সময় যেমন নিরুত্তাপ একটা চাপা কঠোর একটা ভাব ছিল, সেটাই যেন ফিরে এসেছে। 

দুজনে একসাথে উঠতে শুরু করলাম। এ আমি আর আগের আমি নই। শব্দেই ব্রহ্ম— বহুবার শুনেও এ কথার সত্য মানেটা বুঝতে পারিনি। আজ বুঝেছি। শব্দই ব্রহ্মশক্তি। মাত্র ক’টা শব্দ উচ্চারিত হলো, আর অমনি আমার কেবল পর্বতারোহন নয় যেন গোটা জীবনটা বদলে গেল। 
    যথারীতি—
প্রথম প্রথম বেশ গোঁড়া হয়ে উঠলাম। চূড়ার দিকে তাকাব না বিধায় ওপরের দিকে তাকানোই বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু ভদ্রলোককে লক্ষ করলাম, তিনি ওপর-নিচ এপাশ-ওপাশ চারদিকই দেখছেন। একটু পর পর ছোট ছোট বিশ্রাম নিচ্ছেন। খুবই অল্প জলে গলা ভেজাচ্ছেন। তবে চোখ মূলত পায়ের দিকে, কারণ চড়াইয়ের বাধাগুলোই আসল। তবে ইন্দ্রিয় সবদিকে সজাগ।  
আমিও ছোট ছোট বিশ্রামে শক্তি সঞ্চয় করে এগোতে থাকলাম। ছোট ছোট কাছের লক্ষ্য ঠিক করে করে কেবল পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ওঠায় ততক্ষণে অদ্ভুত মজা পেয়ে গেছি। জিপিএস দেখার আগ্রহও হারিয়ে ফেললাম। মনে হলো, ধুর, জিপিএস দেখে কী হবে। 
অনুভব করলাম আমার খেলোয়াড়ি মানসিক শক্তি কী করে শারীরিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। সত্যি, অবাক হয়ে গেলাম। আমি থেকে থেকেই প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখছিলাম। হ্যাঁ, এবার তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। চোখে চোখ পড়তেই হাত নেড়ে আমায় এগোতে ইশারা করলেন। তার জন্যে যেন না থামি। 
একবার মনে হলো, আচ্ছা, তিনি কি বিখ্যাত কেউ? বিখ্যাত যদি না-ও হন, তিনি যে বিশেষ কেউ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 
সব পথের শেষ আছে। চলতে চলতে একসময় চূড়ায় পৌঁছে গিয়ে ছেলেমানুষী আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। আর তখন চোখ পড়ল, যাকে চূড়া ভেবে এসেছি, সেটিও আসলে চূড়া নয়। সেটিকে পাহাড়ের দ্বিতীয় ছাদ বলা যেতে পারে। প্রায় ত্রিশ গজ পুবে দুপাশে গিরিখাদ রেখে একটা চড়াই উঠে গেছে আরো মিটার ছয়, এবং ওটুকু বেশ খাড়া। অবশেষে আরো মিনিট পনের ব্যয় করে উঠে এলাম সত্যিকার চূড়ায়। যে চূড়া কেউ দেখতে পায়নি। 
সব কিছুই অন্য রকম অর্থ নিয়ে ধরা দিতে থাকল আমার কাছে। 
একেবারে ওপরে উঠে আসার পর যখন চারপাশে মন লাগিয়ে তাকিয়ে ওঠার প্রথম অবকাশ হলো আমার, শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। আমার চারপাশে যেন ঝড়ে উত্তাল এক সমুদ্র থমকে আছে। নাহ, কোনো ভুল নেই।  কেবল জলে আর মাটিতে তফাৎ। সবুজাভ জলের বদলে গাছ আর ঘাসের মাদুরে ঢাকা দৈত্যাকার পাথুরে সব ঢেউ। দূরে পৃথিবীর আধগোলাকার রেখা। আকাশটা নীল। এতো নীল যৌবনে সহ্য হয় না। হাহাকার বোধ হয়।  
ঠিক করলাম, রাতে এখানেই ক্যাম্প ফেলব।  পেছনে শোরগোল শুনে তাকিয়ে দেখি ময়ূখ কমল উঠে এসে হৈ হৈ কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে।  মাঝখানে ও কে! চাপাহাসিতে লাল হয়ে আছে খোবেল টিপ্রা। রীতিমতো বোঝা নিয়ে কোন পথে উঠে এসেছে এ লোক? কী সাংঘাতিক। 
‘কী ব্যাপার খোবেল!’ আমি এগিয়ে গেলাম। ‘ভালোই চমকে দিলে। অন্যেরা কোথায়?’
‘নিচে। ওনারা উঠবেন না। আমি ভাবলাম, উঠি। আপনাদের চমক দিই।’
‘তোমার উদ্দেশ্য সফল। আমরা ভয়াবহ চমকেছি। কিন্তু তুমি যে এই খাবারের বোঝা নিয়ে উঠে চলে এলে, আমরা যদি কোনো কারণে না থাকি এখানে?’ 
এবার খোবেলের চমকানোর পালা। বোকার মতো তাকিয়ে থাকল ছেলে। পাহাড়িরা সরল হয়, কিন্তু এমন সরল আর দেখিনি।  আমি তার পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে নিয়ে গম্ভীর মুখে বললাম, ‘তোমার কোনো ভুল হয়নি খাবেল টিপ্রা। আজ রাতটা আমরা এখানেই থাকছি।’ সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের শব্দ করে ময়ূখ আর কমল আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর তিনজন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম খোবেলের ওপর।  একবারে জড়াজড়ি হট্টগোল করে বেহাল। 
এসবের ভেতর ভুলেই গিয়েছিলাম আনিস আহমেদের কথা। হঠাৎ তার ঘড়ি পরা বাঁ হাতটা চূড়ার ওপর উঠে এলো। দৌড়ে গেলাম।  ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। তকে টেনে তুলতে হাত লাগাল সবাই। উঠে দঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ার উপক্রম করছেন, এমন সময় আমি দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম।  তিনি আমার জড়িয়ে ধরলেন।  মনে মনে বললাম, তোমায় পেয়েছি আজ। রাতে আগুনের চারপাশে বসে গল্প শুনব। না জানি আরো কত কিছু লুকোনো তোমার ঝোলায় গো! ওর স-ব আমার চাই। 

‘ক্যাম্প করেছিলে?’ আমার বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন। 
‘করিনি আবার!’
‘জিপিএস রিডিং?’
‘এইরে, বলিনি? জিপিএসের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। যখন মনে পড়ল, তাকিয়ে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আটশ চৌত্রিশ মিটার।’
‘সর্বনাশ!’
‘হ্যাঁ, এই সর্বনাশ সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যেত যদি মোদক মুয়ালকে ছাড়িয়ে যেত। তা অবশ্য ছাড়ায়নি।’
‘আর ওই ভদ্রলোক? আগুনের পাশে গল্প? কী বলল বাকি রাত?’
এইবার পুরোন রূপে সোহাগ ভাই।  হাত দুটো দুপাশে মেলে দিয়ে কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, ‘এইভাবে তো ভাই হয় না।’ 
আর আমিও নিশ্চিন্ত হলাম। সূর্য তাহলে কাল পূর্ব দিকেই উঠছে। 
 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়