ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিত্রকলা

জলপদ্মের চিত্রকর অস্কার ক্লঁদ মোনে

অদিতি ফাল্গুনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৭, ১৭ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলপদ্মের চিত্রকর অস্কার ক্লঁদ মোনে

অদিতি ফাল্গুনী: অস্কার ক্লঁদ মোনে। জন্ম ১৮৪০ সালের ১৪ নভেম্বর, মৃত্যু ১৯২৬ সালের ৫ ডিসেম্বর। ফরাসি এই চিত্রশিল্পী ছিলেন ফরাসি ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকলার সবচেয়ে নিয়মিত বা ধারাবাহিক আঁকিয়ে। প্রচুর ছবি আঁকার পাশাপাশি ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনের মূল দর্শন শিল্পীকে একদম প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে আঁকতে হবে, মোনে ছিলেন সেই দর্শনের কঠোর অনুসারী। বিশেষত ল্যান্ডস্কেপ আঁকার ক্ষেত্রে ‘বিশুদ্ধ বাতাসে’ দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে হবে- এমন নীতি এই আন্দোলনকারীরা মেনে চলতেন। সত্যি বলতে ‘ইম্প্রেশনিজম’ শব্দটি এসেছিল মোনের আঁকা ছবি অনুভূতি, সূর্যোদয় (soleil levant-Impression, Sunrise) থেকে। ১৮৭৪ সালে এই ছবি মোনের একক চিত্রপ্রদর্শনীগুলোর মধ্যে প্রথম প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। মোনে ও তাঁর সহযোগীরা ‘সালোঁ দু পাহি’ বা প্রতিষ্ঠিত আর্ট গ্যালারিগুলোর আধিপত্যের বিকল্প খুঁজতে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।

ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলের সৌন্দর্য হুবহু ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে একই দৃশ্য বহুবার আঁকার একটি কৌশল তিনি অবলম্বন করেন যাতে বিভিন্ন মৌসুমে আলোর পরিবর্তন ঠিকঠাক আঁকা যায়। ১৮৮৩ সাল থেকেই মোনে গিভার্নিতে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে একটি বাড়ি ও আনুষাঙ্গিক কিছু জমি কেনেন তিনি। আর শুরু করেন প্রচুর ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার কাজ। এখানেই পদ্ম সরোবরের ছবি আঁকা শুরু করেন যা তাঁর শিল্পী জীবনের সেরা কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৮৯৯ সালে তিনি প্রথম জলপদ্মের ছবি আঁকা শুরু করেন। শুরুতে একটি জাপানি ব্রিজ বা সেতুকে ছবির কেন্দ্রবিন্দু করে এবং পরে পদ্মপুকুরের উল্লম্ব ছবি এবং আরো পরে বিশালায়তন ক্যানভাসে পদ্মপুকুরের সিরিজ ছবি আঁকা শুরু করেন এবং এই কাজ তিনি পরবর্তী ২০ বছর ধরে করেন।

জাপানি চিত্রকলা দ্বারা খুবই প্রভাবিত মোনে স্ত্রীকে একটি দীর্ঘ জাপানি কিমোনো পরিয়ে ছবি এঁকেছেন। অসংখ্য আলোচিত ছবির স্রষ্টা মোনের ‘জলপদ্ম’ নিয়ে আঁকা সিরিজ ছবিগুলোই অবশ্য আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। নিচে মোনের ‘জলপদ্ম সিরিজ’ বিষয়ে যে ১৫টি বিষয় আমাদের জানা উচিত বলে পশ্চিমা চিত্র সমালোচক ক্রিস্টি পুচকো মনে করেন, তার সামান্য সংক্ষেপিত অনুবাদ তুলে দিচ্ছি:

‘ওয়াটার লিলিজ’ (জলপদ্ম দল) মোনের আঁকা একটি মাত্র ছবি নয়: অনেকেই মনে করেন, নির্দিষ্ট এই শিরোনামে মোনে একটি মাত্র ছবি এঁকেছেন কিনা? না, বাস্তবে ফরাসি ইম্প্রেশনিজমের পিতা ক্লঁদ মোনে মোট ২৫০টি তৈলচিত্রে অসংখ্য একক জলপদ্মের ছবি এঁকেছেন। ‘জলপদ্ম’ সিরিজের আওতায় গিভার্নিতে তাঁর বাড়ির ফুলের বাগান তিনি এঁকেছেন। এই পুষ্পোদ্যানই ছিল তাঁর শৈল্পিক কাজের ত্রিশ বছরের মূল কেন্দ্রভূমি। এই ছবিগুলোর অনেক ক’টিই আঁকা হয়েছে এমন সময়ে যখন মোনে চোখে ছানির সমস্যায় ভুগছেন। মোনের জলপদ্ম বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ও ফরাসি ইম্প্রেশনিজমের বিভাময় উদাহরণ হলেও শিল্পীর উঠোন থেকে জাদুঘরের দেয়ালে জায়গা পেতে প্রচুর কাঠ-খড় পোড়ানো ও বাগান করার কাজও করতে হয়েছে।

জলপদ্ম আঁকার আগে মোনে পদ্মের চারা জলে ফুটিয়েছেন: একবার ট্রেনে করে যাবার পথে ফরাসি গ্রাম গিভার্নির সৌন্দর্য মোনেকে এতটাই মোহিত করে যে ১৮৮৩ সালে তিনি সেখানে একটি বাসা ভাড়া নেন। ১৮৯০ নাগাদ সেখানে একটি বাড়ি কেনার সঙ্গতি অর্জন করার পরেই তিনি ঐ গ্রামে থাকা শুরু করেন। দিনের যে সময়টুকু গাছপালার ছবি আঁকতেন না, সে সময়টুকু নানা উদ্ভিদ ও  পত্র-পুষ্পের বিন্যাস নতুন করে সাজাতেন। মোনের নিজের ভাষ্যে: ‘ছবি আঁকা আর বাগান করা ছাড়া আর কোন কাজই আমি পারি না।’ আসলে নিজের ছবি আঁকার জন্য তিনি একটি সুন্দর জায়গা সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন। তারপর বাকি দিন তৈল রঙে চারপাশের প্রকৃতিকে বন্দী করতেন।

পৌর কর্তৃপক্ষের কথা মানলে মোনে জলপদ্মের ছবি আঁকতে পারতেন না: উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোনে দূর মিশর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জলপদ্ম আমদানি করেছিলেন যা স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। কর্তৃপক্ষ দাবি করেন যে, এলাকার পানি দূষিত করার আগেই মোনে যেন এই পদ্মগুলো উপড়ে ফেলেন। মোনে এই আদেশ উপেক্ষা করেন।

এই ছবিগুলোই তাঁর পরবর্তী জীবনের কেন্দ্র হয়েছে। জীবনের পরবর্তী ত্রিশ বছর এই উদ্যানকে কেন্দ্র করেই তিনি অসংখ্য ছবি এঁকেছেন।  এমনকি ১৯১২ সালে যখন চোখে ছানি পড়েছে তখনও।

উদ্যানের জাপানি সেতুটি তিনি এঁকেছেন ১৭টি ছবিতে: ১৮৯৯ সালে বাগানে একটি জাপানি সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করান মোনে। পড়শিদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও। পরে নানা ছবিতে এই সেতুটি মোট ১৭ বার তিনি আঁকেন। ভিন্ন ভিন্ন আলো ও  আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে।

মোনের ‘জলপদ্ম’ তাঁর জীবদ্দশায় বিদ্রূপ কুড়ায়: সমালোচকদের মতে মোনের আঁকা এই ছবিগুলো ছিল ‘নোংরা’ এবং সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির বদলে মোনের ছানি পড়া ঝাপসা দৃষ্টির উদাহরণ। মোনের চোখ যত খারাপ হচ্ছিল, ততই সমালোচকরা তাঁর রঙ-তুলিকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলেন। উদ্ভিদ, জল ও আলোকে যে শৈল্পিক বাছাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মোনে দেখেছেন, তা পরবর্তী সময়ে প্রশংসা কুড়োলেও সমকালীন সমালোচকেরা বুঝতে পারেননি।

বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিজমের উত্থান ‘জলপদ্মে’র প্রতি আগ্রহের পুনঃসৃষ্টি করে: ১৯২৬ সালে মৃত্যুর পর বহুদিন হয় তাঁর ‘জলপদ্ম’ সিরিজ উপেক্ষিত ছিল। গিভার্নিতে তাঁর স্টুডিওতে আজো নানা ছবি উপেক্ষিত পড়ে আছে। তবে, ১৯৫০-এর দশকে কিউরেটররা আবার তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। ১৯৫৫ সাল নাগাদ ‘দ্য মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্ট’ প্রথম এই ‘জলপদ্ম’ সিরিজ থেকে মোনের ছবি ক্রয় করেন এবং দ্রুতই সেই ছবি জাদুঘরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠে।

কিছু জলপদ্মের ছবি পুড়ে গিয়েছিল: ১৯৫৮ সালে ‘দ্য মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্ট’-এ এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে ‘জলপদ্ম’ সিরিজের কিছু ছবি পুড়ে যায়।

কিছু ছবি শিল্পী নিজেই ধ্বংস করেছিলেন: ১৯০৮ সালে মোনে নিজেই পারির ‘দ্যুরান্দ-হুয়েল’ গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আগে নিজের আঁকা ১৫টি জলপদ্মের ছবি পুড়িয়ে ফেলেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে ছবিগুলো একদমই ভালো আঁকা হয়নি।

মোনে নিজেও খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন: সমালোচকরা কত কড়া জেনে নিয়ে মোনে নিজেও শেষ জীবনে খুব কম ছবিই প্রদর্শনীর জন্য স্বাক্ষর করে পাঠাতে রাজি হতেন। ১৯১৯ সালে এমন মাত্র চারটি ছবি তিনি পাঠান যার একটি আজ ‘দ্য মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট ইন নিউ ইয়র্ক’-এ রয়েছে।

‘জলপদ্ম’ সিরিজে শিল্পী ক্রমাগত সরোবরের তলদেশের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন: যত দিন গেছে, মোনে ছবি আঁকার সময় পদ্ম পুকুরের আরো কাছে ঝুঁকেছেন। সরোবরের প্রান্ত তাঁর ছবির ফ্রেমের কিনারে ঢুকে গেছে আর তার উপরে তিনি বসিয়ে দিয়েছেন দিগন্তরেখা। যেনবা পদ্মফুল ছেড়ে তিনি জলের নানা প্রতিবিম্ব এবং জলের উপরের ভুবনকেই আঁকতে আগ্রহী হয়েছেন।

‘জলপদ্ম’র দীর্ঘ সব ছবিতে দর্শককে তিনি আবৃত করতে চেয়েছেন: ১৯১৮ সালে বারোটি বিশালায়তন ছবি এঁকে তিনি একটি ডিম্বাকৃতি কক্ষে পাশাপাশি ছবিগুলো সাজিয়ে দর্শকদের ডাকেন যেন তাঁরা ‘এক অনিঃশেষ জলীয় সমগ্রতার অধ্যায়ে আক্রান্ত হন যেখানে থাকবে না কোন তীর বা অন্যতর দিগন্তরেখা।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বদেশভূমিকে ‘জলপদ্ম’ উপহার দিতে চেয়েছেন: ১৯১৮ সালে যেদিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ ঘোষণা করা হলো, মোনে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তাঁর স্বদেশভূমিকে ‘শান্তির পীঠস্থানে’ পরিণত করবেন। আর সেটা করবেন বিশাল সব জলপদ্মের ছবি এঁকে।

আজ মোনের ইচ্ছামাফিক সাজানো হয়েছে তাঁর ছবি: প্যারিসে আজ Musée de l'Orangerie-এ শিল্পী যেমন চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই ডিম্বাকৃতি কক্ষে তাঁর ছবিগুলো সাজানো হয়েছে।

ইম্প্রেশনিজমের আদি মান ভেঙে ফেলেছেন মোনে: কিউরেটর অ্যান তমকিনের মতে ‘জলপদ্ম’ সিরিজের মাধ্যমে মোনে ইম্প্রেশনিজমের শুরুর দিকের প্রচলিত মান ভেঙ্গে ফেলে শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়েছেন। 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়