ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (২য় পর্ব)

অভিজিৎ মুখার্জী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৫ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ১৪:১৯, ১৮ অক্টোবর ২০২১
অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (২য় পর্ব)

সপ্তাহের মাঝখানে একটা দিনে, ব্রেকফাস্ট টেবিল পরিষ্কার করা আর ডিনার টেবিল সাজানোর মাঝের সময়টায় গ্রেস অন্যান্য সব কাজ থেকে রেহাই পেত। জানতে পেরে মিসেস ট্র্যাভার্স বেইলিজ ফলস অবধি গাড়ি চালিয়ে গিয়ে ওকে লেকের বাড়িতে নিয়ে আসা শুরু করলেন, ঐ সময়টুকু কাটিয়ে যাওয়ার জন্য। ম’রি তখন কাজে গেছে— সেই গ্রীষ্মে রাস্তা সারানোর কর্মীদের দলে একজন হয়ে হাইওয়ে সেভেন মেরামতির কাজে লেগেছিল ও—ওয়াট ওর অটাওয়ার অফিসে, আর গ্রেচেন বাচ্চাদের নিয়ে লেকে গেছে সাঁতার কাটতে বা রোয়িং করতে। সাধারণত মিসেস ট্র্যাভার্স নিজেই ঘোষণা করতেন যে ওঁকে কেনাকাটায় বেরোতে হবে, অথবা রাতের খাবার তৈরি করতে হবে, কিংবা চিঠি লেখার আছে, আর গ্রেসকে একলা ছেড়ে দিতেন থাকা-খাওয়ার ঘরটাতে, সেই ছায়ায় ঢাকা বিশাল ঘরটা, ঠান্ডা। সেখানে ছিল পাকাপাকিভাবে ডেবে যাওয়া একটা চামড়ার সোফা আর বইভর্তি সব বইয়ের তাক।

 “যা পড়তে ইচ্ছে যায়, পড়ো,” মিসেস ট্র্যাভার্স বলতেন। “নতুবা গুটিশুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়েও পড়তে পার, যা ভালো লাগে। ধকলের কাজ, নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আমি দেখব তুমি যাতে সময়মতো ফিরে যেতে পার।”

গ্রেস কখনো ঘুমায়নি। ও পড়ত। নড়াচড়াই করত না, শর্টসের নিচ থেকে পায়ের অনাবৃত অংশটা ঘেমে চামড়ার গায়ে আটকে যেত। পড়ার আনন্দটা এতই তীব্র ছিল। প্রায়ই ও মিসেস ট্র্যাভার্সের দিকে তাকিয়েও দেখত না, যতক্ষণ না পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে ওকে ফেরত দিয়ে আসার সময় এসে উপস্থিত হত।

 যে বইটার মধ্যে এতক্ষণ ছিল, গ্রেসের চিন্তাটা তার থেকে একটু আলগা হয়ে আসার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়ে, তবে মিসেস ট্র্যাভার্স কথাবার্তা শুরু করতেন। তখন হয়তো বলতেন যে উনিও বইটা পড়েছেন, ওর কী মনে হয়েছিল সেটা জানাতেন—তবে সর্বদাই একটু হালকা মেজাজে, কিন্তু সুচিন্তিতভাবে। যেমন, আনা ক্যারেনিনা সম্বন্ধে উনি বলেছিলেন, “কতবার যে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে প্রথমে আমার নিজেকে মনে হত কিটি, পরে মনে হত আনা— ওহ্, আনার যা হল, আর এখন, জানো তো, শেষবার আমি দেখলাম যে আদ্যন্ত আমার সহানুভূতি চলে যাচ্ছে ডলির দিকে। ডলি যখন গ্রামে যাচ্ছে, জানো তো, বাচ্চারা সঙ্গে রয়েছে, ভেবে বের করতে হচ্ছে কী করে ধোয়াধুয়ির কাজটা করা যায়, ওয়াশটাব নিয়ে একটা সমস্যা— মনে হয় এইভাবেই বয়েস হতে থাকলে সহানুভূতির ধাঁচটা পালটে যেতে থাকে। আবেগ, উচ্ছ্বাস এগুলোকে ঠেলে পাঠিয়ে দিতে হয় ওয়াশটাবের পিছনে। কিন্তু তুমি আমার এসব কথায় কান দিও না। দাও না বোধহয় খুব একটা, দাও?

 “কারুর কথাতেই আমি খুব একটা কান দিই কি না, জানি না।’’ নিজের কথায় নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল গ্রেস, ভাবার চেষ্টা করল, কথাটা কি কপট শোনাল, কিংবা ছেলেমানুষী। “কিন্তু আপনি কথা বলতে থাকলে, শুনতে আমার ভালো লাগে।”

 মিসেস ট্র্যাভার্স হাসেন, “নিজের কথা শুনতে আমার বেশ লাগে।”

 

ম’রি এই সময় ওদের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতে শুরু করল। এখুনি হওয়া সম্ভব নয়— যদ্দিন না ও পাশটাশ করে ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে কাজ করতে শুরু করে—কিন্তু ও এমনভাবে বলত যেন গ্রেস এবং ও নিজেও ধরেই নিচ্ছে যে বিয়েটা হবেই। ‘যখন আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে’ বলে ও কথা শুরু করত, আর কোনও প্রতিবাদ না করে, কিংবা প্রশ্ন না তুলে গ্রেস কৌতূহলী হয়ে শুনে যেত।

বিয়ে হয়ে গেলে, লিটল সাবোট লেকের ধারে ওদের একটা বাড়ি হবে। বাবা মা যেখানে আছে, সেখান থেকে খুব কাছেও নয়, আবার খুব দূরেও নয়। অবশ্যই নেহাতই গ্রীষ্মকালটার জন্য। অন্যান্য সময় ইঞ্জিনীয়ারের কাজে যেখানে যেখানে যেতে হবে ওকে, সেখানে থাকবে ওরা। যেকোনও জায়গাই হতে পারে—পেরু, ইরাক, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। এই যে ভয়ানক গর্ব সহকারে ও বলত, ‘আমাদের নিজেদের বাড়ি’, এই আইডিয়াটা যত না ভাল লাগত, তারচেয়েও গ্রেসের ভালো লাগত ওই বেড়ানোর ব্যাপারটা। এর কোনোটাই আদৌ বাস্তবসম্মত বলে মনে হত না গ্রেসের, তবে কিনা, যে শহরটায়, যে বাড়িটাতে ও বেড়ে উঠেছে, সেখানে কাকার কাজে সাহায্য করা, বেত দিয়ে চেয়ার সারিয়ে দিনাতিপাত করা জীবন, এগুলোকেও কখনো খুব বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি ওর।

 ম’রি কেবলই জিজ্ঞেস করত, ওর সম্বন্ধে কাকা আর কাকিমাকে কী বলেছে গ্রেস, কবে ওকে বাসায় নিয়ে যাবে ওঁদের সঙ্গে দেখা করাতে। কী অনায়াসে বলত কথাটা— বাসা— কথাটা কেমন যেন শোনাত, ও নিজেই যদিও ঐ কথাটাই ব্যবহার করত। আরেকটু যেন সঠিক হত, যদি বলা যেত, ‘কাকা ও কাকিমার বাসা’।

 আসলে, সপ্তাহে যে একটা করে সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখত, তাতে ও কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে, কেবল উল্লেখ করেছিল যে ‘একটা ছেলের সঙ্গে কখনো ঘুরতে টুরতে যাওয়া হয়, গ্রীষ্মকালটার জন্য এখানেই কোথাও একটা কাজ নিয়েছে ছেলেটা’। ওদের হয়তো ধারণা হয়েছে যে ছেলেটা ওই হোটেলেই কাজ করে।

এমন নয় যে ও কখনোই বিয়ের কথা ভাবেনি। সেই সম্ভাবনা— আংশিক অনিবার্যতাও বটে— বেতের চেয়ার তৈরির জীবনের মতোই চিন্তায় কোথাও একটা ছিলই। ওকে কেউ কখনো প্রেম নিবেদন করেনি, তবু ওর মনে হয়েছিল যে সেটা ঘটবে, কোনও একদিন, এবং ঠিক এইভাবেই, সিদ্ধান্ত নিতে সেই মানুষটার এতটুকু দেরি হবে না। মানুষটার সঙ্গে দেখা হবে— খুব সম্ভবত একটা চেয়ার সারাতে নিয়ে আসবে সে— আর ওকে দেখে, ওর প্রেমে পড়ে যাবে। দেখতে শুনতে বেশ সুন্দর হবে, ম’রিরই মত। তারপর দৈহিক ঘনিষ্ঠতার সুখ।

একমাত্র এই ব্যাপারটাই ঘটেনি। ম’রির গাড়ির ভিতরে, কিংবা আকাশের নিচে ঘাসের ওপরে খোলা জায়গায়, ওর ইচ্ছে হত। ম’রি তৈরিই থাকত, কিন্তু ঠিক ইচ্ছুক ছিল না। ম’রির মনে হত যে ওর দায়িত্ব গ্রেসকে সুরক্ষিত রাখা। আর গ্রেস যে অবলীলায় নিজেকে সমর্পণ করত, এতেও ম’রি যেন কেমন হয়ে যেত। ও সম্ভবত টের পেয়েছিল যে ব্যাপারটাতে শীতলতা আছে। নিবেদনটা যেন সিদ্ধান্তপ্রসূত, যেটা ম’রির বুদ্ধির অগম্য, এবং গ্রেস সম্বন্ধে ওর যে ধারণা তার সঙ্গে খাপ খায় না। গ্রেস নিজেই বুঝতে পারত না, ও কতটা শীতল— ওর বিশ্বাস ছিল যে ও নিজে আগ্রহ দেখালেই একসময় সেই সুখটাতে উপনীত হওয়া যাবে, একাকি মুহূর্তে আর কল্পনায় যে সুখটার কথা ও ভাবত। ওর মনে হত যে এরপর ম’রিকেই উদ্যোগী হতে হবে বাকিটার জন্য। ম’রি সেটা হত না।

এই অবরোধ দু’জনকেই যুগপৎ অতৃপ্ত ও সামান্য ক্রোধান্বিত কিংবা লজ্জিত করে তুলত, আর এর ফলে বিদায় নেওয়ার সময় পরস্পরকে পুষিয়ে দিতে ওরা অবিরাম চুম্বন, জাপটাজাপটি, আদরের সম্ভাষণ, ইত্যাদি করেই যেত। ডমির্টরির বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে মন থেকে শেষ কয়েকটা ঘন্টা মুছে দিতে দিতে, একা একা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচত গ্রেস। ওর ধারণা ছিল, ম’রিও নিশ্চয়ই হাইওয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে গ্রেসের প্রতি ভালবাসায় হৃদয় পূর্ণ রাখতে, গ্রেস সম্বন্ধে নিজের চিন্তাটায় একটু এদিক ওদিক করে নিয়ে স্বস্তি পায়।

 

ওয়েট্রেসরা বেশিরভাগই স্কু্লে কিংবা কলেজে ফেরত যাবে বলে লেবার ডে’র পরে ছেড়ে দিল। একটু কমসংখ্যক কর্মী নিয়ে হলেও থ্যাংকস গিভিং পর্যন্ত হোটেল খোলা রাখা হল— গ্রেসও রয়ে গেল। কথা হচ্ছিল এ বছর ডিসেম্বরের গোড়ায় শীতকালটার জন্য আবার খোলা যায় কিনা, অন্ততপক্ষে ক্রিসমাসের মরসুমটার জন্য, কিন্তু সত্যিই তা করা হবে কিনা, যারা রান্নাঘরে কিংবা খাবার পরিবেশনের কাজ করত তারা কেউই জানে বলে মনে হল না। গ্রেস এমনভাবে কাকা কাকিমাকে লিখল, যেন ক্রিসমাসের সময়টায় তো খোলা থাকবেই। আসলে বন্ধ হওয়ার প্রসঙ্গই তোলেনি ও চিঠিতে, যেন বা যদি বন্ধ হয়ও তবে সেই নিউ ইয়ার্সের পরে। অতএব ওঁরা যেন ওর আসার অপেক্ষায় না থাকেন।

এটা ও করল কেন? এমন নয় যে ওর অন্য কোনও পরিকল্পনা ছিল। ম’রিকে ও বলে রেখেছিল যে ওর মনে হয় এবছরটা ওর কাকার কাজেই সহায়তা করা উচিত, বেতের কাজ শেখার মত আর কারুকে পাওয়া যায় কিনা সেই খোঁজও চালাতে পারে তখন, পাশাপাশি ম’রিও তখন কলেজে ওর ফাইনাল ইয়ারের পড়াটা চালিয়ে যেতে পারে। এমনকি কথাও দিয়ে রেখেছিল যে ক্রিসমাসের সময় দেখা করতে আনিয়ে ম’রির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে পরিবারের অন্যদের। আর ম’রি বলেছিল যে ওদের বাগদানটা পাকা করার জন্য ক্রিসমাসের সময়টা বেশ উপযুক্ত সময়। গ্রীষ্মের কাজের মাইনে থেকে ও টাকা জমিয়ে রাখছিল গ্রেসকে একটা হীরের আংটি কিনে দেবে বলে।

 গ্রেসও তার মাইনে থেকে টাকা জমিয়ে রাখছিল। ম’রির যখন কলেজ খোলা থাকবে তখন যাতে ও কিংসটনের বাস ধরতে পারে।

ও অনায়াসেই একথা বলেছিল, কথাও দিয়েছিল। কিন্তু এটা সত্যিই হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করেছিল কি, এমনকি সেভাবে চেয়েছিল কি?

মিসেস ট্র্যাভার্স বলেছিলেন, “ম’রির স্বভাবের কোনও তুলনা হয় না। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ। ওর বাবার মতই ও খুব সাদামাটা লোক হবে, সবারই ভাল লেগে যায় এ ধরনের মানুষদের। ওর দাদাটা অন্যরকম। নিইল খুব বুদ্ধিমান, মেধাবী। বলছি না যে ম’রি বুদ্ধিমান নয়, মাথার ভিতরে ভালোরকম একটা বা দু’টো মগজ না থাকলে তো আর ইঞ্জিনীয়ার হওয়া যায় না। কিন্তু নিইল হচ্ছে— নিইল হচ্ছে গভীর।’’ নিজেই হেসে উঠেছিলেন, বলে। “সমুদ্র-ভল্লুকের গভীর অতলান্ত গুহা— কী বলছি বলো দেখি? বহুদিন ধরে আমরা দুজনে ছাড়া নিইল আর আমার কেউ ছিল না। তাই ও খুব স্পেশাল বলে আমার মনে হয়। আমি বলছি না যে ও মজা করতে জানে না। কিন্তু কখনও কখনও এরকমও হয় যে যারা সবচেয়ে বেশি মজা করতে পারে, তারাই হয়তো আসলে বিষাদগ্রস্ত, হয় না এরকম? আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় তাদের কথা ভেবে। কিন্তু ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে গেলে, তখন তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করে আর লাভ কী? নিইলকে নিয়ে আমি খানিকটা চিন্তায় থাকি, ম’রিকে নিয়ে খুবই সামান্য পরিমাণ। গ্রেচেনকে নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই। কেননা মেয়েদের মধ্যে এমন একটা জিনিস থাকে, যাতে তারা সব সামলে সুমলে নিয়ে ঠিকই এগিয়ে চলতে পারে, থাকে না? ছেলেদের সেটা থাকে না।

 

থ্যাংকস-গিভিং পর্যন্ত লেকের পাড়ের বাড়ি সরগরমই ছিল। তারপর গ্রেচেন আর তার বাচ্চাদের তো অটাওয়াতে ফিরতেই হত, ওদের স্কুল আছে। আর ম’রির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল, ওকে কিংসটনে ফিরে যেতে হল। মিস্টার ট্র্যাভার্স কেবলমাত্র উইকএন্ডের দিনগুলোতে বেরোতেন। মিসেস ট্র্যাভার্স গ্রেসকে বলেছিলেন যে উনি সাধারণত থেকেই যেতেন, কখনো সখনো অতিথিরা আসত, কখনও উনি একাই থাকতেন।

কিন্তু ওঁর পরিকল্পনা সব পাল্টাতে হল। সেপ্টেম্বরে মিস্টার ট্র্যাভার্সের সঙ্গে উনি অটাওয়াতে চলে গেলেন। অপ্রত্যাশিতভাবেই এটা ঘটল—উইকএন্ডের ডিনার বাতিল করা হল।

 ম’রি বলেছিল যে ওঁর নাকি স্নায়বিক কী একটা সমস্যায় মাঝেমাঝে এই বিপত্তিতে পড়তে হত। বলেছিল, “তখন বিশ্রাম নিতে হয়। কয়েক সপ্তাহের জন্য হাসপাতালে গিয়ে থাকতে হয়, ওরা সেখানে ওকে সারিয়ে তোলে। প্রত্যেকবারই দিব্যি সেরে গিয়ে ফিরে আসে।”

গ্রেস ম’রিকে বলল, “তোমার মা কিন্তু একেবারে শেষ ব্যক্তিটি, যার এরকম হতে পারে বলে আমি ভাবতে পারি। এরকম হয় কেন?”

 “সেটা ওরা জানে বলে মনে হয় না,” ম’রি জানাল।

 তার একমুহূর্ত পরেই বলল, “মার স্বামীর জন্য হতে পারে। মানে, প্রথম স্বামী। নিইলের বাবা। ওঁর যা হয়েছিল, সেইসব নিয়ে আর কি।”

 যেটা হয়েছিল, সেটা হল যে নিইলের বাবা আত্মহনন করেছিলেন।

 ‘‘ওর কিছু মানসিক সমস্যা ছিল।’’ আমার অনুমান।

 “কিন্তু সেই কারণে না-ও হতে পারে,” ম’রি বলে চলে। “অন্যকিছুও হতে পারে। মার বয়েসি মহিলাদের যেসব সমস্যা হয়। অবশ্য তত চিন্তার কিছু নেই—আজকাল সহজেই ওকে সারিয়ে তোলে ওরা, ওষুধ টষুধ দিয়ে। দারুণ সব ওষুধ বিষুধ আছে ওদের। ও নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।”

 

ম’রির কথা মতোই থ্যাংকস-গিভিং নাগাদ মিসেস ট্র্যাভার্স হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গেলেন, দিব্যি চাঙ্গা তখন। থ্যাংকস-গিভিং উপলক্ষে নৈশভোজ যথারীতি লেকের পাড়ের বাড়িতেই হচ্ছিল। দিনটা ছিল একটা রবিবার— সচরাচর সেটাই হয়ে থাকে, সোমবার বাড়ি বন্ধ করে দেওয়া, আর গোছগাছ ইত্যাদি করা হয়। গ্রেসের পক্ষেও এতে ভালোই হল, কেননা ওর ছুটির দিন হল রবিবার।

পুরো পরিবারই উপস্থিত থাকবে। গ্রেসকে না ধরলে, কোনও অতিথির বালাই নেই। নিইল, মাভিস আর ওদের ছেলেমেয়েরা মাভিসের বাবা মা’র ওখানেই থাকবে, ওখানেই সোমবার নৈশভোজে যোগ দেবে, কিন্তু রবিবারটা ট্র্যাভার্সদের এখানেই সারাদিন কাটাবে।

রবিবার সকালে ম’রি যতক্ষণে গ্রেসকে নিয়ে লেকের ধারের বাড়িতে হাজির হল, টার্কি ততক্ষণে ওভেনে চড়ানো হয়ে গেছে। বাচ্চারা আছে, তাই একটু আগে আগেই ডিনার সেরে নেওয়া হবে, পাঁচটা নাগাদ। রান্নাঘরে কাউন্টারের ওপর রাখা আছে পামকিন পাই, অ্যাপল পাই, বুনো ব্লুবেরির পাই। হেঁসেলের ভার গ্রেচেনের ওপর— যেমন ছিল সে অ্যাথলীট হিসেবে, রাঁধুনি হিসেবেও তেমনই গুছিয়ে সবকিছুর মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে পারে। কিচেন-টেবলে বসে কফি খেতে খেতে মিসেস ট্র্যাভার্স গ্রেচেনের ছোটমেয়ে ডানার সঙ্গে জিগস পাজল নিয়ে ব্যস্ত রইলেন।

 “আঃ গ্রেস,” বলে জড়িয়ে ধরার জন্য লাফ দিয়ে উঠলেন উনি— সেবারই কিন্তু প্রথম, আগে কখনও এটা করেননি— বেমক্কা হাত নাড়ায় জিগস’র টুকরোগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল।

 “দিদা,” বলে ডানা আর্তনাদ করে ওঠে, ওর বড়বোন জ্যানি এতক্ষণ খুব মন দিয়ে দেখছিল, সে টুকরোগুলোকে একত্র করে তুলে নিল।

 বলল, “আবার এগুলোকে জায়গামতো বসিয়ে নিলেই হবে, দিদা তো আর ইচ্ছে করে করেনি।”

 “ক্র্যানবেরি সস কোথায় রাখ?” গ্রেচেন জানতে চাইল।

 মিসেস ট্র্যাভার্স বললেন, “দেরাজে’’, তখনও উনি গ্রেসের হাত চেপে ধরে আছেন, ছত্রাকার হয়ে যাওয়া পাজ্ল্কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে।

 “দেরাজের কোন জায়গায়?”

 “ওহো, ক্র্যানবেরি সস, তাই না?” এবার মিসেস ট্র্যাভার্স বলেন। “ইয়ে— আমি তো বানিয়ে নিই। একটু জলের মধ্যে ঢেলে দিই ক্র্যানবেরিগুলোকে। তারপর অল্প আঁচে গরম করতে থাকি— না না, ওগুলো বোধহয় একটি ভিজিয়ে রাখতে হয় প্রথমে—”

 “অত সময় নেই আমার। তার মানে, কৌটোয় পাওয়া যাবে না?” গ্রেচেন বলে।

 “মনে হয় নেই। কী করে থাকবে, আমি তো বানিয়ে নিই?”

 “কারুকে একটা পাঠিয়ে এখনকার মতো আনিয়ে নিতে হবে তাহলে।”

 “মিসেস উডসের কাছে আছে কিনা, জিজ্ঞেস করতে পার তো?”

 “না, তেমন একটা কথাই বলা হয়নি এযাবৎ। কোন মুখে বলব? কারুকে দোকানে যেতে হবে।”

 “সোনামণি—থ্যাংকস গিভিং চলছে এখন। কোথাও কিচ্ছু খোলা পাবে না,” মিসেস ট্র্যাভার্স শান্তভাবে বলেন।

 “হাইওয়ে ধরে গেলে ঐ যে জায়গাটা, ওটা সবসময় খোলা থাকে,” গ্রেচেন গলা তুলে বলে। “ওয়াট কোথায়?”

 “ও রোয়িং-এ গেছে,” পিছনের শোয়ার ঘর থেকে মাভিস জানিয়ে দেয়। এমনভাবে বলে যে শুনে মনে হয় যেন সাবধান করে দিচ্ছে, আসলে ও বাচ্চাকে ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা করছিল। “নৌকোয় মাইকিকেও নিয়েছে।”

 মাভিস নিজের গাড়ি চালিয়ে এসেছে, মাইকি আর বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে। নিইল পরে আসবে— কয়েকটা ফোন সেরে আসতে হবে ওকে।

আর মিস্টার ট্র্যাভার্স গিয়েছিলেন গলফ খেলতে।

“যেকেউ একজন দোকানে গেলেই হবে,” গ্রেচেন বলে। বলে ও অপেক্ষা করছিল, কিন্তু শোয়ার ঘর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ও এবার ভুরু তুলে গ্রেসের দিকে তাকাল।

“তুমি তো গাড়ি চালাতে পার না বোধহয়, পার?”

গ্রেস জানাল যে পারে না।

মিসেস ট্র্যাভার্স এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের চেয়ারটা খুঁজে পেয়ে, যেন বাধিত হয়েছেন, এমনভাবে শ্বাস ফেলে গিয়ে সেটায় বসলেন।

“ঠিক আছে, ম’রি চালাতে পারে। ম’রি কোথায়?”

 ম’রি সামনের দিকের শোয়ার ঘরে ওর সাঁতারের পোশাকটা খুঁজছিল, সবাই ওকে বলেছিল অবশ্য যে সাঁতারের পক্ষে জল কিন্তু ভয়ঙ্কর ঠান্ডা হবে। ও বলে দিল যে ঐ দোকানটা খোলা থাকবে না।

 “থাকবে। কেননা ওদের ওখানে গাড়ির তেল পাওয়া যায়। আর ওখানে না হলে, ঐ যে রাস্তাটা পার্থ থেকে আসার পথে, আইসক্রীম-কোন পাওয়া যায় যেখানে—”

 ম’রি চাইছিল যে গ্রেস ওর সঙ্গে আসুক, কিন্তু ছোট মেয়ে দু’টো জ্যানি আর ডানা, ওরা গ্রেসকে টানাটানি করছিল ওদের সঙ্গে গিয়ে দোলনাটা দেখার জন্য। বাড়ির পাশের নরওয়ে-মেপল গাছটার নিচে ওদের দাদু একটা দোলনা খাটিয়ে দিয়েছে।

 সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গ্রেস টের পেল যে একটা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। দুটো চটিই খুলে ফেলে ও অনায়াসে হেঁটে চলে গেল, পায়ের নিচে বালি মেশানো মাটি, চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কাঁচাকলা, মাটিতে ঝরে পড়ে কুঁকড়ে যাওয়া গাছের পাতা বেশকিছু।

প্রথমে বাচ্চা দুটোকে দোলনায় চড়িয়ে ও ঠেলল, তারপর ওরা ওকে ঠেলে ঠেলে দিল। খালি পায়ে লাফিয়ে মাটিতে নামতে গিয়ে ওর একটা পা কেমন দুমড়ে গেল, কিছু বোঝার আগেই ও ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।

পা নয়, পায়ের পাতায়। বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে ব্যথাটার উৎপত্তি, একটা ধারালো শামুকের খোলে পা’টা কেটে গেছে।

 জ্যানি জানালো, “ডানা এনেছিল ঐ খোলগুলো। ওর শামুকটার জন্য বাসা বানাতে ওগুলো এনেছিল।”

“এটা এখানে চলে এসেছে,” ডানা বলল।

 বাচ্চাদের কেউ আর্তনাদ করে উঠেছে ভেবে গ্রেচেন, মিসেস ট্র্যাভার্স, এমনকি মাভিস পর্যন্ত বাড়ির ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিল।

ডানা বলে উঠল, “ওর পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। মাটিয়ে রক্ত লেগে আছে এখানে ওখানে।”

জ্যানি জানিয়ে দিল, “শামুকে কেটে গেছে। ডানা এই খোলগুলোকে রেখে গিয়েছিল এখানে, ইভানের জন্য বাসা বানিয়ে দেবে বলে। ইভান, ওর ঐ শামুকটা।”

একটা গামলা নিয়ে আসা হল, কাটা জায়গাটা ধুতে জল, একটা তোয়ালে, সকলে জানতে চাইছিল কতটা ব্যথা করছে।

 “তেমন কিছু নয়’’ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে গ্রেস বলল, বাচ্চাদু’টো প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিল সোজা হয়ে থাকায় ওকে সাহায্য করতে, এবং সেই করতে গিয়ে ওর পথরোধই করে ফেলছিল অধিকাংশ সময়।

“ইস কী বিচ্ছিরিভাবে কেটেছে! পায়ে জুতো রাখনি কেন?’’ গ্রেচেন বলে।

 “স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গিয়েছিল।’’ ডানা আর জ্যানি একসঙ্গে বলে ওঠে, আর এইসময় একটা ওয়াইনের রঙের কনভার্টিবল গাড়ি, যার ছাদটা ঢেকেও দেওয়া যায়, খোলাও রাখা যায়, প্রায় কোনও আওয়াজ না করে, সুচারুভাবে বাঁক নিয়ে এসে ঢুকল পার্কিং-এর জায়গায়।

“একেই বলে যোগাযোগ,” মিসেস ট্র্যাভার্স বলে ওঠেন। “ঠিক যাকে এইসময় প্রয়োজন, সে এসে হাজির। ডাক্তারবাবু।”

 এই প্রথম গ্রেস নিইলকে দেখল। মেদহীন, দীর্ঘদেহী, চটপটে।

 উল্লসিতভাবে মিসেস ট্র্যাভার্স চেঁচিয়ে বললেন, “তোমার ব্যাগটা লাগবে। অলরেডি তোমার জন্য একটা কেস রয়েছে এখানে।”

“জিনিসটা বাজে, কিন্তু সুন্দর দেখতে। নতুন?” গ্রেচেন বলে।

“ঝকমারিই করে ফেলেছি,” নিইল বলে।

“বেবি এবারে জেগে গেছে,” একটা অনির্দিষ্ট অভিযোগের দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাভিস বাড়ির ভিতরে ফেরত চলে যায়।

জ্যানি কঠোর গলায় বলে, “যা-ই করতে যাও, বেবি জেগে যাবেই।”

“তুমি চুপ কর তো,” গ্রেচেন তাকে বলে।

“এনেছো তো আবার ব্যাগটা, সঙ্গে করে?” মিসেস ট্র্যাভার্স বলেন। কিন্তু নিইল ব্যাকসীট থেকে একঝটকায় একটা ব্যাগ টেনে বের করে। তখন উনি বলে ওঠেন, “যাক, এনেছো তাহলে, কিছু বলা তো যায় না।”

“রোগী কে, তুমি? হয়েছেটা কী? ব্যাঙ গিলে ফেলেছ?” ডানাকে বলে নিইল।

“না, ওর। গ্রেসের,” ভারিক্কি চালে ডানা জানায়।

“বুঝেছি। ও ব্যাঙ গিলে ফেলেছে।”

“পা কেটে গেছে ওর। কেবল রক্ত বেরোচ্ছে, রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে।”

 “শামুকে,” জ্যানি বলে দেয়।

 “তোমরা সরো তো,” বলে নিইল এবার গ্রেসের থেকে সিঁড়ির একধাপ নিচে বসে পড়ে, তারপর সাবধানে পা’টা তুলে ধরে বলে, “ওই কাপড়ের টুকরোটা দাও তো, বা কিছু একটা ওরকম।’’  তারপর কাটা জায়গাটা ভালো করে নজর করে দেখতে সযত্নে রক্তটা মুছে নেয়। ও এতটা কাছে এসে পড়ায় গ্রেস একটা গন্ধ পায়, যে গন্ধটা এবারের গ্রীষ্মে হোটেলে কাজ করতে গিয়ে ও চিনেছে— মদের গন্ধ, সঙ্গে খানিকটা মিন্ট।

 “রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে, বেরিয়েই যাচ্ছে। ভালো হচ্ছে, পরিষ্কার হয়ে যাবে সব। ব্যথা করছে?” নিইল বলে।

 “একটু’’ গ্রেস জানায়।

 খুব অল্পসময়ের জন্য হলেও, কী যেন একটা খোঁজে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিইল। হয়তো বুঝতে চাইল গ্রেস গন্ধটা পেয়েছে কি না, পেয়ে কী ভাবছে।

 “বুঝেছি। এই যে চলতা উঠে আছে, দেখেছো? ওর নিচে কী আছে দেখতে হবে, পরিষ্কার করে ফেলতে হবে সেসব। তারপর একটা কি দু’টো সেলাই দিতে হবে ওতে। আমার কাছে একটা জিনিস আছে সেটা একটু ঘষে দিলেই আর যতটা ভাবছ, অতটা লাগবে না।’’ বলে মুখ তুলে গ্রেসের দিকে তাকায়। “অ্যাই, এই সমবেত দর্শকম-লীকে সরাও তো এখান থেকে।”

তখনও অবধি মার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি নিইল। মিসেস ট্র্যাভার্স এবার আরেকবার বললেন, কী যে ভালো হয়েছে, ঠিক এইসময় যে ও এসে পড়েছে।

 “বয়-স্কাউট। সবসময় প্রস্তুত হয়েই আছে,” নিইল বলে।

ওর হাত দেখে মনেই হল না যে নেশার ঘোরে আছে, চোখ দেখেও না। অবশ্য বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলার সময় যে ফূর্তিবাজ মামার রূপ ধারণ করেছিল, সেটা এখন আর নেই, বা গ্রেসকে ভরসা দিতে একথা সেকথার যোগানদার সেজেছিল যে, সেও অনুপস্থিত। একটু উঁচু ফর্সা কপাল, তার ওপরে কোঁকড়ানো ঘন কাচাপাকা চুল, একটু সাদাটে উজ্জ্বল দুটো চোখ, পাতলা ঠোঁটের চওড়া মুখটা যেন কোনও জোরালোরকম ধৈর্যচ্যুতি, কিংবা খিদে, অথবা বেদনাবোধে বিকৃত হয়ে আছে।

সিঁড়ির ধাপে বসে কাটা জায়গাটায় যখন ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গেছে— গ্রেচেন ততক্ষণে রান্নাঘরে ফিরে গেছে এবং বাচ্চাদের ওর সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছে, কিন্তু মিসেস ট্র্যাভার্স তখনও আছেন, মন দিয়ে দেখছেন, ঠোঁট দুটো এমনভাবে দৃঢ়নিবদ্ধ যেন কথা দিয়েছে যে উনি এর মাঝখানে কোনও কথা বলবেন না—নিইল বলল যে ওর মনে হচ্ছে গ্রেসকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

 “একটা ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন দিতে হবে।”

 “এখন আর খুব একটা ব্যথা করছে না তো,” গ্রেস বলে।

 “কথা সেটা নয়,” নিইল তাতে বলে।

 “ঠিকই বলেছে। ধনুষ্টংকার—  বড়ো ভয়ানক জিনিস,” মিসেস ট্র্যাভার্স বলেন।

 “বেশি সময় লাগবে না। এই যে। গ্রেস? আমি তোমায় গাড়ি অবধি নিয়ে যাচ্ছি,” বলে ওর হাতের ওপরদিকটায় ধরে নিইল। একটা চটি পরাই ছিল, আরেকটাতে কোনওক্রমে কয়েকটা আঙুল ঢুকিয়ে দিল গ্রেস, যাতে অন্তত সেটাকে পায়ের সঙ্গে টেনে টেনে নেওয়া যায়। ব্যান্ডেজটা বাঁধা হয়েছে নিখুঁতভাবে, যথেষ্ট আঁটসাঁট করে।

 “একটিবার ছুট্টে ভেতর থেকে ঘুরে আসি। একটু বুঝিয়ে বলে আসি,” গ্রেস গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসার পর নিইল বলে।

 গ্রেচেনকে? না মাভিসকে।

 মিসেস ট্র্যাভার্স বারান্দা থেকে নেমে এলেন, স্বাভাবিকভাবেই ওর মধ্যে একটা অস্পষ্ট উদ্যমী ভাব থাকে, আর এরকম একটা দিনে তো সেটা কিছুতেই চাপা থাকছে না। এসে গাড়ির দরজায় হাত রাখলেন।

 “ভালোই হল। খুব ভালো হল। গ্রেস, আজকের দিনে তুমি একেবারে দৈবপ্রেরিত। আজকের দিনটায় ওকে মদ খাওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখবে তুমি, পারবে না? তুমিই পারবে সেটা,” উনি বললেন।

 কথাটা গ্রেস শুনল, কিন্তু খুব একটা কিছু ভাবল না সেই নিয়ে। মিসেস ট্র্যাভার্সের মধ্যে কী যেন একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, যেটা ওকে বেশ নাড়া খাইয়ে দিয়েছে, যেন আরো আলুথালু হয়ে পড়েছেন উনি, সবরকম নড়াচড়ায় একটা আড়ষ্টতা, কেমন একটা হঠাৎ হঠাৎ মরীয়া শুভাকাঙ্ক্ষী ভাব, চোখ ভিজে যাওয়া খুশির ভাব চোখ থেকে যেন গড়িয়ে পড়ছে। মুখের দু’কোণে সাদা মত সামান্য কী যেন জমেছে, চিনির মত।

 

হাসপাতাল কার্লটন প্লেসে, ওখান থেকে তিনমাইল দূরত্বে। রেলওয়ে লাইনের ওপরে উঁচু দিয়ে হাইওয়ের খানিকটা গেছে, সেই রাস্তায় এমন গতিতে গেল ওরা যে গ্রেসের মনে হল যেন সর্বোচ্চ গতির সময়টায় গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে একটু উঁচুতে উঠে গিয়েছিল, ওরা যেন উড়ছিল। গাড়িঘোড়া তেমন ছিল না আশেপাশে, ও তাই ভয় পায়নি, পেলেও কিছুই করার ছিল না ওর।

ইমার্জেন্সি ডিউটিতে ছিল যে নার্স, সে নিইলের পরিচিত, ফর্মটর্ম নিইল ফিল আপ করে দেওয়ার পর সে যখন গ্রেসের পা’টা একবার একটু দেখে গেল (“ভালোভাবেই করেছে ব্যান্ডেজটা’’, অন্যমনস্কভাবে বলেছিল সে), নিইল তখন উদ্যোগ করে নিজেই ধনুষ্টংকারের ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দিল। (“এখন ব্যথা করবে না আর, কিন্তু পরে একটু হতে পারে।’’) ইঞ্জেকশনটা দেওয়া হতে না হতেই সেই নার্স কিউবিকলে ফিরে এসে বলল, “ওয়েটিংরুমে একজন এসে বসে আছে, ওনাকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে।’’

গ্রেসকে উদ্দেশ্য করে বলল, “উনি বলছেন, উনি আপনার ফিয়াঁসে।”

 “ওকে বলে দিন এখনও উনি রেডি নন। না না, বলে দিন যে আমরা তো চলে গেছি,” নিইল বলেছিল।

 “আমি তো বলেছি যে আপনারা এখানে রয়েছেন।”

 “কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন যে আমরা চলে গিয়েছি,” নিইল বলে দেয়।

 “উনি তো বলছেন যে উনি আপনার ভাই হন। পার্কিং লটে আপনার গাড়িটা চোখে পড়বে না?”

“আমি তো পিছনেরটায় পার্ক করেছি, ডাক্তারদের পার্কিং লটে পার্ক করেছি।”

“খুবই গোলমেলে ব্যাপার,” ফিরে যেতে যেতে নার্স বলে গেল।

“তুমি নিশ্চয়ই এক্ষুণি বাড়ি ফিরে যেতে চাইছিলে না, চাইছিলে কি?” গ্রেসকে নিইল বলে।

“না,” গ্রেস বলে। এমনভাবে বলে যেন ওর সামনে দেওয়ালে শব্দটা লেখা রয়েছে, ওর সেটা চোখে পড়েছে। যেন ওর চক্ষুপরীক্ষা হচ্ছে।

আবার ওকে সাহায্য করা হল গাড়ি অবধি যেতে, পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে ঝুলে আছে একটা চটি, গাড়ির মাখনের মতো নরম মেঝেতে সেটির একটা গতি হল। পিছনদিকের একটা রাস্তা দিয়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে এল ওরা, ওখান থেকে একটা পথ ধরে শহরে যাওয়া যায়, যে পথটার কথা খুব বেশি লোক জানে না। গ্রেসের কেমন মনে হচ্ছিল যে ম’রির সঙ্গে ওদের আর দেখা হবে না। ওর আর ম’রিকে নিয়ে ভাবতে হবে না, মাভিসকে নিয়ে তো আরোই না।

 এই যাত্রাটা নিয়ে বলতে গিয়ে, ওর জীবনে আসা এই পরিবর্তনটা নিয়ে পরে কখনো ও বলতেই পারত— বলেওছিল— যেন ঘটাং করে একটা গেট বন্ধ হয়ে গেল ওর পিছনে। কিন্তু ঠিক সেই সময়টায় ঘটাং করে কোনও আওয়াজ হয়নি— নির্লিপ্তভাবে একধরনের মেনে নেওয়া যেন খুব ছোট একটু ঢেউ তুলে বয়ে গিয়েছিল ওর ভিতর দিয়ে, যারা পিছনে পড়ে রইল তাদের অধিকারগুলো তখন বাতিল হয়ে গেছে।

এই দিনটার স্মৃতি ওর মনে এখনও খুঁটিনাটি সহকারে স্পষ্ট, তবে যে অংশগুলোতে ও ছিল, সেগুলো একটু পালটেছে।

আর, এমনকি সেই খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোর ক্ষেত্রেও ওর নিশ্চয়ই কিছু ভুল হয়েছিল।

 

প্রথমে ওরা গাড়ি চালিয়ে গেল হাইওয়ে সেভেন দিয়ে। গ্রেসের মনে পড়ছে, হাইওয়েতে আর কোনও গাড়ি ছিল না, হাইওয়ের যে অংশটা উঁচু দিয়ে গিয়েছিল সেখান দিয়ে যেতে ওরা যেমন প্রায় উড়তে উড়তে গিয়েছিল, এবারও ওদের গতি পৌঁছোল প্রায় সেখানে। কিন্তু সেটা তো সত্যি হতে পারে না—রাস্তায় নিশ্চয়ই লোক ছিল, রোববারের সেই সকালে যে লোকেরা বাড়ি যাচ্ছিল, পরিবারের সঙ্গে থ্যাংকস-গিভিং কাটাতে যাচ্ছিল। যারা চার্চে যাচ্ছিল, কিংবা চার্চ থেকে ফিরছিল। শহরের প্রান্তে গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে নিইল নিশ্চয়ই গতি খানিকটা কমিয়েছিল, পুরনো হাইওয়েতে অনেক বাঁক ছিল, সেখানেও নিশ্চয়ই গতি কমিয়েছিল খানিকটা। কনভার্টিবল গাড়ির ছাদটা খুলে দিয়ে চালানোর সঙ্গে অভ্যস্ত ছিল না গ্রেস, চোখে এসে লাগছিল বাতাস, চুলগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল বাতাসের হাতে। এতেই ঐ অপরিবর্তিত গতির, একেবারে উড়ানের বিভ্রম তৈরি হয়েছিল ওর মধ্যে— উদ্দাম কিছু নয়, চমকপ্রদ, স্থিতিশীল।

 ম’রি আর মাভিস, সঙ্গে পরিবারের বাকি সবার কথা যদিও মুছে গিয়েছিল ওর মন থেকে, মিসেস ট্র্যাভার্সের কথা কিন্তু কিছুটা কিছুটা তখনও রয়ে গিয়েছিল, বাতাসে ভর করে, একটা অদ্ভুত লজ্জিত হাসির মিশেল দিয়ে ফিসফিসিয়ে ওঁর শেষ কথাগুলো পৌঁছে দিচ্ছিল গ্রেসের কাছে।

‘...তুমিই পারবে সেটা’।

 অবশ্যই কোনও কথা হচ্ছিল না নিইল আর গ্রেসের মধ্যে। ওর যা মনে পড়ছে, কথা বলতে হলে চিৎকার করে বলতে হত। আর যেটা মনে পড়ছে, যদি সত্যিকথা বলতে হয়, সেটা আর সেক্স কেমন হওয়ার কথা সেই সম্বন্ধে ওর ধারণা, ওর কল্পনার মধ্যে তেমন একটা ফারাক নেই। সেই আকস্মিক দেখা হয়ে যাওয়া, কথায় না প্রকাশ করে জোরালো সব সংকেত, সেই নিঃশব্দ উড়ান, যার মধ্যে ওর নিজের ভূমিকাটা মোটামুটি বন্দিনীর মতই। বাতাসে ভর রেখে আত্মসমর্পণ, শরীর তখন আর কিছুই নয়, কামনার একটা প্রবাহ।

 শেষটায় ওরা থামল গিয়ে ক্যালাডারে, হোটেলে গিয়ে ঢুকল—পুরনো দিনের সেই হোটেলটা এখনও আছে। গ্রেসের হাতটা নিয়ে আঙুলগুলোর মাঝখানে নিজের আঙুলগুলো প্রবেশ করিয়ে অল্প মোচড় দিতে দিতে, ওর একটু অনিয়মিত পদক্ষেপের সঙ্গে তাল রাখতে নিজের গতি একটু কমিয়ে, নিইল ওকে নিয়ে ঢুকল একটা বার-এ। আগে কখনও যায়নি যদিও, তবু গ্রেস বুঝতে পারল যে এটা একটা বার। (বেইলিজ ফলসের হোটেল তখনও বারের লাইসেন্স পায়নি— মদ খেতে হলে লোকে যার যার ঘরে গিয়ে খেত, নতুবা রাস্তার উল্টোদিকে একটা নেহাতই জরাজীর্ণ নাইটক্লাবে গিয়ে।) ও যেমন ভেবেছিল, জায়গাটা ঠিক সেরকমই— বাতাস চলাচল নেই এমন একটা অন্ধকার বড় ঘর, তড়িঘড়ি করে ঝাড়পোঁছ করার পরে চেয়ার টেবিলগুলো এলোমেলো ভাবে সরিয়ে রাখা, লাইজলের গন্ধ, কিন্তু তাতে বীয়ার, হুইস্কি, চুরুট, পাইপ, মানুষের গন্ধ চাপা পড়েনি।

 সেখানে তখন কেউ ছিল না— হয়তো বিকেলের আগে খুলত না। কিন্তু তখনও কি বিকেল হয়নি? সময় সম্বন্ধে ওর ধারণায় মনে হয় গন্ডগোল হচ্ছিল।

 এবারে একটা লোক বেরিয়ে এল অন্য একটা ঘর থেকে, এসে নিইলের সঙ্গে কথা বলল। বলল, “আরে, ডাক্তারবাবু যে!”, তারপর বারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।

 গ্রেসের মনে হচ্ছিল, এরকমই হতে থাকবে— ওরা যেখানে যেখানে যাবে, কেউ না কেউ, দেখা যাবে যে আগে থেকেই নিইলের পরিচিত। (চলবে)

** অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (সূচনা পর্ব)


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়