ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিকো মেন্দেস: পৃথিবীর ফুসফুস বাঁচাতে প্রাণ দেয়া বিপ্লবী

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিকো মেন্দেস: পৃথিবীর ফুসফুস বাঁচাতে প্রাণ দেয়া বিপ্লবী

স্ত্রী ইলসেমার মেন্দেসের সঙ্গে চিকো মেন্দেস

অনার্য মুর্শিদ: ‘প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমি রাবার গাছ বাঁচাতে লড়াই করছি, এরপর ভেবেছিলাম আমি আমাজন রেইন ফরেস্ট বাঁচানোর জন্য লড়াই করছি। এখন বুঝতে পারছি আমি মানবতার পক্ষে লড়াই করছি।’ এই লড়াকুর নাম চিকো মেন্দেস। বিশ্বের পরিবেশবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আমাজনের জন্য যিনি প্রাণ দিয়েছেন। চিকোর ভালো নাম ফ্রান্সিসকো আলভেস মেন্দেস ফিলহো। জন্ম ১৯৪৪ সালে, ব্রাজিলের জাপাপুরিতে।

চিকোর ছেলেবেলা: পারিবারিক সূত্রে চিকো ছিলেন রাবার ট্যাপার। বনে হেঁটে রাবার ট্যাপিং করতেন। এ ছাড়াও ফলমূল, তালশাস সংগ্রহ করে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করতেন। বিক্রি করে কোনোদিন তারা টাকা চোখে দেখতেন না। কারণ মৌসুম আসার আগেই ফড়িয়ারা রাবার সংগ্রহের জন্য তাদের টাকা ধার দিয়ে রাখত। রাবারগুলো কেনার সময় খুবই অল্প দামে তারা কিনত। যে কারণে ট্যাপারদের পাওনা টাকা কখনোই শোধ হতো না। কখনো সামান্য টাকা থাকলে তাই দিয়ে তারা ফাড়িয়াদের কাছ থেকে চিনি, কফি, ওষুধপত্র, টেপিংয়ের জিনিসপত্র কিনে নিত— অসম্ভব চড়া দামে।

নয় বছর বয়সি চিকো দেখতেন দেশজুড়ে রাবার শিল্প ধ্বংস হচ্ছে। গবাদি পশুর চারণভূমির জন্য প্রতিনিয়ত জমি বিক্রি ও পোড়ানো হচ্ছে। সরকার ও গবাদি পশু পালনকারী স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করছে। ফলে ধীরে ধীরে রাবার ট্যাপারদের কাজের অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল। অন্য সবার মতো চিকোর পরিবারও তখন দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।

চিকোদের দেবতা: চিকো তখন চৌদ্দ বছরের কিশোর। ব্রাজিল সরকার, ফাড়িয়া, গবাদি পশু পালক, ভূমিদস্যুদের অত্যাচার তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এর মাঝেই দেবদূতের মতো তাদের জনপদে আগমন ঘটে একজন বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীর। নাম ইউক্লিডজ ফর্নান্দেজ ট্যাভোরা। রাজনৈতিক কারণে পলাতক হয়ে ট্যাভোরা আমাজনে এসেছিল। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে চিকো পড়তে এবং লিখতে শিখেন। বুঝতে পারেন ফাড়িয়ারা আসলে ব্যবসায়ী নয়— মধ্যস্বত্বভোগী। চিকো আরো বড় হতে থাকেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশের গুরুত্ব সব তার কাছে আমাজনের স্বচ্ছ জলের মতো মনে হয়। ধীরে ধীরে তিনি তার গোষ্ঠীর জনগণকে সচেতন করতে থাকেন। তাদের স্বাক্ষর জ্ঞানও দিতে থাকেন চিকো।

চিকোর নেতা হয়ে ওঠা: ট্যাভোরার কাছ থেকে চিকোর রাজনৈতিক হাতেখড়ি নেয়ার পর্ব প্রায় শেষ। এখন কাজে নামার পালা। চিকো যোগ দেন ‘গ্রামীণ শ্রমিক ইউনিয়ন’-এ। চিকো শুধু ট্যাপারদের স্বার্থ নিয়েই কাজ করেন না। বন রক্ষা এবং বনে বসবাসরত আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও কাজ করেন। আলাদা করে তিনি ‘ট্যাপার ইউনিয়ন’ গঠন করেন। বনে কেউ গাছ কাটতে এলে ট্যাপারদের সঙ্গে নিয়ে করাত, শেকল, বুলডোজার ও ট্রাকের সামনে গিয়ে তারা দাঁড়াতেন। পরাস্ত হতো বনখেকোরা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তারা এরকম ৪৫টি অভিযান চালায়। এর মধ্যে ১৫টিতেই সফল হয়। কিন্তু ১৯৮০’র  দশকের মাঝামাঝি ব্রাজিল সরকার চিকোকে একজন উগ্রপন্থী ইউনিয়নবাদী হিসেবে আখ্যা দেয়। যদিও তিনি বেশ কয়েকটি স্থানীয় রাজনৈতিক পদ যেমন: রাজ্যের ডেপুটি এবং সিটি কাউন্সিলর পদেও প্রার্থী ছিলেন। এই সময় তিনি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব রাবার টেপার্স তৈরিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৫ সালে ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে যখন এই নতুন ইউনিয়নের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় তখন সারাদেশ থেকে রাবার ট্যাপাররা আসেন। সভায় তাদের জীবিকা নির্বাহের ঝুঁকি, গবাদি পশুর খামার গড়তে বন পোড়ানের মতো বিষয়গুলো দেশবাসীর সামনে বড় আকারে তুলে ধরা হয়। এই অনুষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

‘দ্যা বার্নিং সিজন’ চলচ্চিত্রে রাবার টেপিংয়ের দৃশ্য

 

দাতা সংস্থাগুলোর সাহায্য ও চিকোর স্বকীয়তা: চিকোর সংগঠন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অর্থ দ্বারা পরিচালিত হতো না। কিন্তু একটা সময় তিনি দেখলেন, সংগঠন এগিয়ে নিতে হলে তাকে অনুদানের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। তিনি বিশ্বব্যাংক থেকে আর্থিক অনুদান গ্রহণ করলেও তার আন্দোলন সংগ্রামে কখনোই তাদের আনুকুল্য প্রকাশ করেননি। তার আদিবাসীরা যাতে এর দ্বারা অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত না হয় সে বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। চিকো বিশ্বাস করতেন দানে কখনো আন্দোলন হয় না। বরং এটি কখনো কখনো সাহায্যের পরিবর্তে অলসতা ডেকে আনে। তিনি আদিবাসীদের শুধু রাবারের ট্যাপিংয়ের উপর নির্ভর ছাড়ার পরামর্শ দেন। বনজ বাদাম, ফল, তেল সংগ্রহের দিকে বেশি নজর দেন। পাশাপাশি তাদের বাচ্চাদের মানসম্মত শিক্ষাও দিতে থাকেন। কারণ ট্যাভোরার মাধ্যমে তার জানা হয়ে গেছে শক্তিশালী সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

চিকো যখন নিঃসঙ্গ: ১৯৮০ সাল। চিকোর আন্দোলন তখন চরমে। তার বন্ধু উইলসন পিনহোরেকে র‌্যাঞ্চাররা ইউনিয়ন অফিসে এসে গুলি করে হত্যা করে। চিকো একা হয়ে পড়েন। তিনি আখ্যায়িত হন কমিউনিস্টদের চর হিসেবে। কিছুদিন কারাভোগের পর চিকো আত্মগোপন করেন। আত্মগোপনে থেকেও তিনি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৮৮ সালের ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিশ্বপরিবেশ আন্দোলনের এই পথিকৃৎকে তার জাপুরির বাড়িতে স্থানীয় গো-খামারি ডারলিস দ্যা সিলভারের ছেলে ডার্কি গুলি করে হত্যা করে। হত্যার আগেও চিকো বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগের মাসগুলোতে তিনি দেখতেন বন্দুকধারীরা জোড়ায় জোড়ায় তার বাড়ি এবং টাউন ইউনিয়ন হলের কাছের কোনো জায়গা থেকে তাকে অনুসরণ করছে। ৪৪তম জন্মদিনেও তিনি সতীর্থদের জানিয়ে গেছেন, ‘আমি বোধহয় ক্রিসমাস অবধি বাঁচব না’। জন্মদিনের ঠিক এক সপ্তাহ পরেই চিকো তার নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচিয়ে গেছেন। সারাবিশ্বের মানুষ এখন চিকোর নিঃসঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গী।

চিকোকে নিয়ে চলচ্চিত্র ও সংগীত: চিকো প্রথম সারির মিডিয়ার বাইরে থেকে গেলেও তার আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকটি চলচ্চিত্র ও সংগীত তৈরি হয়েছে। যেগুলো বিশ্বের পরিবেশ আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। অ্যাড্রিয়ান কাউয়েল নামের একজন নির্মাতা তার প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৫ সালের ব্রাসিলিয়ায় অনুষ্ঠিত সভাটির কিছু দৃশ্য ধারণ করেন। যার মাধ্যমে আন্দোলনটি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যায়। চিকোর জীবন নিয়ে অ্যান্ড্রু রেভকিন নামের একজন মেক্সিকান চলচ্চিত্রকার ১৯৯৪ সালে ‘দ্য বার্নিং সিজন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। চিকোকে নিয়ে সরাসরি কিংবা তার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান। মেক্সিকোর ম্যানা নামের বিখ্যাত রক ব্যান্ড গেয়েছে ‘কুয়ান্ডো লস অ্যাঞ্জেলস লোলরান’। পল ম্যাককার্টনি প্রকাশ করেছে ‘ফ্লাওয়ার ইন দি ডার্টি’ নামের একটি অ্যালবাম। সেই অ্যালবামের ‘হাউ মেনি পিপল’ নামক গানটি চিকোকে নিয়েই। চিকোর নিজের দেশেও তার আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে অসংখ্য গান হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ব্রাজিলের মেটাল ব্যান্ডের ‘সিপুলতুরা রুটস’ নামের অ্যালবামটি। অ্যালবামে ‘অ্যাম্বুশ’ নামে একটি গান আছে। যা শুধু ব্রাজিলিয়ান এবং আমাজনের আদিবাসীদেরই উজ্জীবিত করে না, বিশ্বের মানুষকে একটি সাংগীতিক ঐক্যে নিয়ে যায়।

প্রজন্মের নিঃশ্বাসে চিকো: চিকো মরেও যে মরেনি তা এই চলচ্চিত্র এবং সংগীতগুলো বলছে। মৃত্যুর আগেও কর্মের জন্য চিকো বেশ ক’টি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে ব্রাজিলিয়ানরা চিকোর নামে একটি পাখির নাম দেয়। পাখিটির পুরো নাম জিমেরিয়াস চিকোমেন্দেসি। ব্রাজিলের পরিবেশ মন্ত্রকের অধীন একটি সংস্থা তার সম্মানে নামকরণ করেছে ‘চিকো মেন্দেস ইনস্টিটিউট ফর কনজার্ভেশন অব বায়োডাইভার্স’। পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজনের মতো চিকো মেন্দেসও বিশ্ববাসীর নিঃশ্বাস হয়ে বেঁচে থাকবে চিরদিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়