ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’

সুমনকুমার দাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ১৮ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’

লালন আখড়া, ছেউরিয়া। ছবি: আজমাইন আবিদ

এক বিকেলে কালী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। লম্বা চুল-দাড়িওয়ালা ফকির। পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই ফকিরের নাম নাঈম সাঁই। শোনালেন সাঁইজির গান-

‘ও আমি অপার হয়ে বসে আছি

ওহে দয়াময়

লয়ে যাও আমায়

পারে লয়ে যাও আমায় ॥

আমি একা রইলাম ঘাটে

ভানু সে বসিল পাটে

দয়াল তোমা বিনে ঘোর সংকটে

না দেখি উপায় ॥

নাই আমার ভজন সাধন

চিরদিন কুপথে গমন

আমি নাম শুনেছি পতিত পাবন

তাইতে দোহাই দিই তোমায় ॥

অগতির না দিলে গতি

ওই নামের হইবে অখ্যাতি

ফকির লালন কয় অকূলের পতি

কে বলবে তোমায় ॥’

আমার অনুরোধ নয়- নাঈম সাঁই নিজে থেকেই এ গান শোনালেন। কেন এ গান তিনি বেছে নিলেন, তা-ও জানি না। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে কেবল। চারপাশে জ্বলছিল বৈদ্যুতিক বাতি। গান শেষ হলে আমি তাঁর বাউল-তরিকায় প্রবেশের গল্প শুনতে চেয়েছিলাম। তিনি সে খেদ মেটালেন। জানালেন তাঁর সাধনপথে আসার গল্প। বললেন তাঁর সাধনসঙ্গিনীর কথাও।

নাঈম সাঁইয়ের সঙ্গে গল্প-গানে কেটে যায় ঘণ্টাখানেক। পরে জনস্রোত ঠেলে দুজন হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছাই লালনপন্থী ভাবশিষ্য করিম শাহ (১০ জুলাই ১৯২৯-১০ জুন ২০১৪)-এর কাছে। তিনি লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মূলমঞ্চ থেকে নেমেছেন। এরপর তাঁকে নিয়ে মঞ্চের অদূরে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে গল্প জমে ওঠে। বাউল-দর্শনের মূল বক্তব্য কী?- এমন প্রশ্নের জবাবে করিম শাহ অতি সংক্ষেপে বলেন, ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/ সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার। মানুষ ভজনাই বাউল দর্শনের মূল সত্য।’ তাহলে তো লালনও একই পথের পথিক? ‘হ্যাঁ, তাই-ই তো! তাই তো কলাম!’ বললেন করিম শাহ।

আলাপেই জানতে পারি, ১৯২৯ সালের ১০ জুলাই কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার অঞ্জনগাছি গ্রামে করিম শাহ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ঝুমুর আলী জোয়ার্দার বাউলশিল্পী ছিলেন। সাত বছর বয়সে বাবার কাছেই তাঁর গানের হাতেখড়ি। এরপর থেকে আমৃত্যু লালন সাঁইয়ের গান ছিল তাঁর কণ্ঠে। আদিসুরে লালনের গান তিনি ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তিনি লালনের গান পরিবেশন করেছেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১১ সালে একুশে পদক, ২০০৭ সালে লালন একাডেমি থেকে লালন সম্মাননা এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে লালন মেন্টর ফেলোশিপ অর্জন করেন।

শৈশবে বাবার সঙ্গে পালাগান গাইতেন করিম শাহ। তাঁর যখন চৌদ্দ বছর বয়স, তখন বাবা মারা যান। এরপর গুরু ধরেন যথাক্রমে অঞ্জনগাছির আব্দুল মকদেস, দৌলতপুরের তছের ফকির, আলমডাঙ্গার বিহাল শাহকে। তাঁদের কাছে বাউল মতবাদ, দর্শন ও তত্ত্ব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। পরে খিলাফতও অর্জন করেন। তাঁর সহধর্মিণী রিজিয়া বেগম পথচলার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলেও গান গাইতেন না। করিম শাহ জানান, সাঁইজির আদি সুরে এখন অনেকেই পদগুলো গান না। এটা অনুচিত। শুদ্ধ সুর অন্তরে ধারণ করতে পারলেই ভাব উদয় হবে। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই যেন-বা বলেন, ‘সাঁইজির মৌখিক ভক্ত তো বহুই আছে। আশিকি ভক্ত তো কম। তাঁরা ভাবের সন্ধান পাবে কেমনি?’ আলাপে-আলাপে লালন সাঁইজির গানের সবকটি পর্যায়ের কথাও তিনি উল্লেখ করলেন। বললেন, সাঁইজির হাজারও গান আদিসুরে তাঁর আত্মস্থ থাকার কথাও। এ কথা বলেই করিম শাহ গান ধরেন আপন মনে-

‘কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ, পরাইল বলো শুনি

জিন্দা দেহে মরার বশন, খিলকা তাজ আর ডোর-কোপনি ॥

জিন্দা-মরার পোশাক পরা

আপন ছুরাৎ আপনি সারা

ভব-রোগকে ধ্বংস করা

দেখে অসম্ভব করণী ॥

জীবনও থাকিতে মরে

শমনে ছোঁবে না তারে

শুনেছি এই সাধুর দ্বারে

তাই বুঝি করেছো ধনী ॥

সেজেছো সাজ ভালই তর

মরে যদি বাঁচতে পারো

লালন বলে যদি ফেরো

দুকূল হবে অপমানি ॥’

সম্ভবত শ্বাসকষ্ট করিম শাহের, গান শেষে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর বুক ক্রমশ ওঠানামা করছিল। আমি তাঁকে থামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি সে বাধা অগ্রাহ্য করে অনবরত কথা বলতে থাকেন। বলতে শুরু করেন, ‘সাঁইজিরে চেনা যায় তাঁর পদে। এ পদের মধ্যেই সাঁইজিরে ধরা যায়, দেখা যায়। সাঁইজির জীবনী তো এসব পদই!’ এরপর করিম শাহের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা হয়। বিশেষত লালন শাহের দর্শন ও বাউলতত্ত্ব নিয়ে। তিনি জানান, জাত-পাতহীন মানবধর্ম প্রতিষ্ঠাই ছিল লালন সাঁইয়ের মূল লক্ষ। সাঁইজির গানের মূল বক্তব্যই হচ্ছে- সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

আমরা যখন আলাপ শুরু করি, ঠিক তখন থেকেই করিম শাহকে ঘিরে রেখেছিলেন লালনপন্থী বেশ কয়েকজন ভাবশিষ্য আর অনতিতরুণ শিল্পী। তাঁদের উসখুশের কারণেই সম্ভবত করিম শাহ দ্রুত বিদায় নিতে চাইলেন। এই উসখুশজনিত অস্বস্তির মধ্যে আরও সামান্য একটু সময় কথা বলে তাঁকে বিদায় জানাই। লম্বা গড়নের মানুষটি আখড়াবাড়ির রাস্তা ধরলেন। কিছুক্ষণ আগের মূলমঞ্চের দৃশ্য আমার চোখে ভাসে। করিম শাহ নিবেদিত ভঙ্গিতে গাইছিলেন- ‘এলাহি আলামিন গো আল্লাহ বাদশা আলমপনা তুমি’।

করিম শাহের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটুকু ছিল ২০১১ সালের। এরপর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। ২০১৪ সালে হঠাৎ তাঁর প্রয়াণের খবর পাই। রোগে-শোকে টাকার অভাবে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু হয়। গণমাধ্যমে এ সংবাদও প্রচার হতে দেখেছি, করিম শাহের অর্ধাঙ্গিনী ওষুধের খরচ জোগানোর জন্য মানুষের কাছে হাত পেতেছেন পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি। যে ব্যক্তি লালনের আদিসুর প্রতিষ্ঠা করতে সেই বালক বয়স থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গেলেন, সেই মানুষটিই কি না জীবনযুদ্ধে এক পরাজিত সৈনিকের উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন!

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়