ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ছোটগল্প: ধরনে ও ধারণায়

হামীম কামরুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১১, ২৫ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ১৬:০৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
ছোটগল্প: ধরনে ও ধারণায়

প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরে গল্পের নমুনা পাওয়া যায়। কিন্তু ছোটগল্পের ইতিহাস মাত্র সেদিনের। তিনশ’ও নয়, বলতে গেলে দেড় কি দুইশ বছরের ইতিহাস। কারণ গল্পমাত্রই ছোটগল্প নয়। হ্যাঁ, আরব্যরজনীর ভেতরে গল্প আছে, কথাসরিৎসাগর বা জাতক কি ইশপের গল্প তো গল্পই, কিন্তু সেসব ছোটগল্প নয়। ছোটগল্পের লেখা হলো লেখকের ব্যক্তিত্ব-প্রকাশের তীব্রতায় ও তার সেই প্রখর ব্যক্তিত্বজাত জীবনবোধের আলো আঁধারে কি ধূসরতায়।

উনিশ শতকের এক ‘পিকিউলিয়ার প্রোডাক্ট’ হলো ছোটগল্প। পড়ুন মোপাসাঁ কি চেখভ বা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প- দিব্যি অনুভব করতে পারবেন ফরাসি, রুশ ও বাঙালি জীবনের রং রূপ স্বাদ গন্ধ স্পর্শ ধ্বনি। ইহুদি না হয়েও পড়তে পড়তে দুমড়ে মুচড়ে যাবেন ক্রোখমালনা স্ট্রিটের যে গল্পগুলি তুলে আনছেন আইজাক বেশিভিচ সিঙ্গার। এমন সূক্ষ্মতা তীক্ষ্মতা গভীরতা আর উচ্চতার সন্ধান ছোটগল্পে পাওয়া যায় যা রীতিমতো বিস্ময়কর! আবেগের আবহ দিয়ে তৈরি তবু আবেগাক্রান্ত নয়, এমন নৈর্ব্যক্তিক ছাঁচে রচিত হতে পারে কিন্তু কেবলই নৈর্ব্যক্তিক নয়। শিল্প মতবাদের কত লক্ষণ এতে পাওয়া যাবে, বাস্তববাদ, অভিব্যক্তিবাদ, অস্তিত্ববাদ থেকে জাদুবাস্তববাদ- কিন্তু সবকিছুর ওপরে ছোটগল্প সব ছক পাড়ি দিয়ে কোথাও হয়ে ওঠে ছোটগল্প তা ধরা খুব সোজা নয়, যেন কবিতার মতো- পেয়ে বসলে তবে দুম করে হয়।

কথায় বলে, কবিতা টাটকা টাটকাই লিখে ফেলতে হয়। ছোটগল্প অনেকটা তেমনই টাটকা টাটকা বোধ করতে হয়, কিন্তু অপেক্ষা করতে হয় মোক্ষম সময়ের জন্য। সেটা পেলেই আর দেরি নয়, দুম করে লেখা। অবশ্য শিল্পসৃষ্টি কীভাবে কে করেন আগে থেকে দাগিয়ে তো দেওয়া যায় না। তারপরও ছোটগল্প লেখার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ছোটগল্পের রসায়নটা সত্যিই কবিতার সঙ্গে মেলে।

কী করে ছোটগল্প ছোটগল্প হয়ে ওঠে- এ যেন একটি মানুষ কী করে মানুষ হয়ে ওঠে- এরই মতো জটিল প্রশ্ন। ছোটগল্প লিখতে এমন একটি ঘটনা লাগে যার ভেতর দিয়ে লেখকের কোনো একটি দৃষ্টিকোণ, পর্যবেক্ষণ, অনুভব বা স্রেফ একটি মনোভাব আকার পায়। কখনো সেটা একটা পরিসমাপ্তি লাভ করে, কখনো এর অভিমুখ মুক্তই থেকে যায়। অর্থাৎ অসমাপ্তই রয়ে যায়।

তবে ছোটগল্প তখনই প্রকৃত ছোটগল্প হয়ে ওঠে যেখানে এর ভেতরে থাকা সব কিছু ছোটগল্প ছাড়া অন্যকোথাও গিয়ে প্রকৃতভাবে প্রকাশিত হতে পারে না। হলেও তা নড়বড়ে হয়ে যায়। এর সময়সীমা যা-ই হোক, মূলত দেখা যায় একটি বিন্দুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ছোটগল্প। যেমন মোপাসাঁর ‘দ্যা নেকলেস’। গল্পের সময়সীমা কয়েক বছরের। কিন্তু গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে মাত্র একটি বিন্দুর ওপর- যখন জানা গেল ওটা সত্যিকারের দামি পাথরের গহনা ছিল না। ছিল নকল। নিয়তি ও ঠাট্টা যেন একযোগে সেখানে ঝাঁকি দিয়ে বেজে ওঠে। এমন গল্প একবার শুনলে সারা জীবন ভোলা যায় না। করুণার এমন এক রস এসে মনকে ধুয়ে দিয়ে যায়, জীবনের অসহায়ত্ব, সময়ের অপচয়- সামান্য একটা শখ পূরণ করতে গিয়ে  কোথা থেকে কোথায় নেমে যায়, এই গল্প তার প্রমাণ। খাঁটি জিনিস চিনতে না পারার খেসারত দিতে হয়, দিতে হয় জেনে বুঝে কোনো কিছু গ্রহণ না করলে।

আরো কিছু দিক থেকে একে দেখা যায়। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ প্রায় ঘটনাহীন। কিন্তু এর ভেতরে মানবমন ও অস্তিত্বের এক সুগভীর সংকট উঠে এসেছে। দুজন মানুষ দুজনকে এমন দুটি দিক থেকে দেখে যা মেলে না। রতনের আন্তরিকতার সঙ্গে পোস্টমাস্টারের প্রয়োজনের দিক থেকে রতনকে দেখাটি মেলে না। প্রিয়জন ও প্রয়োজনের দ্বন্দ্ব চিরন্তনভাবে বাজতে থাকে। ঘটনা সামান্যই কিন্তু কি কারণে এই গল্প হাজারবার পড়লেও পুরোনো হয় না? সেটি কি কেবল লেখকের বর্ণনাভঙ্গির জন্য? নাকি এর গীতময়তার জন্য? অল্প কয়েকটি আঁচড়ে যেন লেখা হয়েছে এ গল্প। নিকোলাই গোগলের ‘দ্যা ওভারকোট’ পড়া শেষ করলে থমথম করা একটা আলোহীন অবস্থার ভেতরে যেন প্রবেশ করি আমরা। বারবার পড়েও স্বাদ মেটে না।

ছোটগল্পের এই জাদু আসলে জাদুই। এর রহস্য ভেদ করা যায় না। কারো কারো ভাষা ভঙ্গি চরিত্র নির্মাণের ক্ষমতা উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে যেমন করে দেখা দেয়, সেই একই সামর্থ্য নিয়ে ছোটগল্প লেখা তিনি পেরে ওঠেন না। যে-কারণে হেমিংওয়ে আদতে ছোটগল্পকার হয়ে থাকেন, আর ফকনার হয়ে যান মূলত ঔপন্যাসিক।

ছোটগল্প ঠিক কোন বিন্দু থেকে ছোটগল্প হতে শুরু করে- এটিকে যেমন সাহিত্যের ইতিহাসের জায়গা থেকে দেখা যায়, তেমন একজন লেখকের ব্যক্তিগত জায়গা থেকেও দেখা যায়। এর সঙ্গে আবার মিলিয়ে দেওয়া যায় প্রমথ চৌধুরীর দুটো কথা। তার মতে, ভারতবর্ষে জীবনকে দেখা হয় সামগ্রিকভাবে, কিন্তু সেখানে বিপুল ফলন হলো গল্পের। আর পশ্চিমে যেখানে জীবনকে দেখা হয় খণ্ড-বিখণ্ড করে অনুপুঙ্খভাবে- সেখানে জন্ম নিল উপন্যাস। আরেকটি কথা হলো, ছোটগল্পকে গল্প হতে হবে এবং ছোট হতে হবে।

এখানে প্রথমটি হলো ছোটগল্পকে ইতিহাসের জায়গা থেকে দেখা, দ্বিতীয়টি হলো আঙ্গিকের জায়গা থেকে দেখা। আঙ্গিকের জায়গা থেকে দেখা মানে একজন লেখক গল্প লেখার সময় তার বিবেচ্য বিষয়টি নিয়ে আগাম বুঝে বোধে রাখবেন যে, ছোটগল্পকে তিনি কীভাবে নির্মাণ করতে চান। আর এজন্য এর ইতিহাস কতটুকু কাজে আসবে, সেটা খুব বড় বিষয় নয়। তবে সামগ্রিক ও অনুপুঙ্খভাবে- প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভেদ করার ভেতরে দিয়ে গল্প ও উপন্যাসের দুটো ধরন জীবনকে যেভাবে ধারণ করতে চায়, তার দিকে একটু নজর বোলানো যেতেই পারে।

ভারতবর্ষে বা প্রাচ্যের জীবন দৃষ্টি সামগ্রিক, কিন্তু সেখানে তৈরি হলো গল্প। এই গল্প জীবনের ছোট ছোট বিষয় বা দিক নিয়ে নাড়াচাড়া করে। বৃহৎকথা বা পরে কথাসরিৎসাগর, পঞ্চতন্ত্র, বেতালপঞ্চবিংশতি, জাতকের গল্প এমন কি হিতোপদেশের মতো সাহিত্যিক নির্দশনগুলিতে গল্পই আসলে নীতিকথা ও জীবন সম্পর্কে নানান সতর্কতার জানান দেয়। আরব্যরজনী বা পারস্যরজনীর মতো গল্পসংগ্রহগুলিই প্রায় তাই। একটিতে নারীর প্রতি পুরুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনা, অন্যটিতে পুরুষের প্রতি নারীর হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য গল্প বলে যাওয়া হয়। সবমিলিয়ে নিদারুণ দুর্ভাগ্যের ভেতরেও জীবনের ভারসাম্য খুঁজেছে  এসব গল্প। কিন্তু তা নিশ্চয়ই ছোটগল্প বলতে যা বুঝি তা নয়। এমন কি প্রতীচ্যে ডেকামেরন, হেপ্তামেরন, বা ক্যান্টরবেরি টেলস ব্যক্তির জায়গা থেকে রচিত হলেও এ-ও গল্প। সেখানেও জীবন সম্পর্কে নৈতিকবোধ জাগানো কি তার ক্ষয় সম্পর্কেই ধারণা তৈরি হয়। সেখানে সম্পর্ক ও তাতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল প্রবল। কিন্তু তাও ছোটগল্প হয়ে ওঠেনি।

সবমিলিয়ে মানবসম্পর্ককে খতিয়ে দেখার কাজই করেছে গল্প। মানুষের চারিত্রিক স্খলনই এর প্রধানতম দিক। কিন্তু আধুনিক ছোটগল্প মূলত জোর দিল জীবন সংকটের ওপর। আগের গল্পগুলি মূলত স্খলনের কারণে সংকটকে হাজির করল, আর পরে গল্প যখন ছোটগল্প হয়ে উঠল, তাতে সংকটের কারণে স্খলনের দিকে মানুষকে নিয়ে গেল। আগের গল্পগুলিতে ‘স্বভাবের কারণে অভাব’-এর আবহ তৈরি হলো, যেমন অত্যাচারী শাহরিয়ারের জন্য আর বিয়ের পাত্রী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

ছোটগল্প হলো ‘অভাবে স্বভাব নষ্টে’র বাস্তবতায়। তা সে ‘দ্য নেকলেস’ বলি বা বুলি ‘দ্য সুইফ’-ই বলি। বিষয়টি একজন লেখকের জায়গা থেকেও দেখা যেতে পারে। তিনি সংকটে পড়ে ছোটগল্প যতটা লেখেন, তার চেয়ে নিজের কোনো একটি শূন্যতা পূর্ণ করতে গল্প লেখেন। অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছেন ‘ট্রমা’র কথা। এ এক বিশেষ ধরনের পলায়ন। এক ধরনের আশ্রয়গ্রহণ- দৈনন্দিন সব অপছন্দনীয় বাস্তবতার হাত থেকে পালিয়ে গিয়ে নিজের কাছে ফিরে আসার উপায়। সোজা কথা বলা যায়- নিজের জগৎ সৃষ্টি করা। এমন এক জগৎ নির্মাণ করা যেখানে নিজের মতো থাকা যায়, বিচরণ করা যায়।

ছোটগল্পের আকার ছোট হতেই হবে এই শর্ত অমিয়ভূষণ গ্রহণ করেন না। তিনি বলেন, যেখানে তিনি ছোটগল্পের ইতি টানতে চাইবেন, সেখানেই মূলত ছোটগল্প আকার পাবে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের একটি সূত্র দিয়ে তাঁর ভাষ্য থেকে আমরা একটি চমকপ্রদ দিক ছোটগল্প সম্পর্কে পাই। সেটি হলো- ছোটগল্পের কোনো পরিধি নেই, কিন্তু কেন্দ্র আছে সর্বত্র। এতে পূর্ববর্তী ছোটগল্পের ধরন ও ধারণা দুটোই এক ধাক্কা খায়। তাহলে ছোটগল্প কি এক লক্ষ শব্দে লেখা হতে পারে? বা উপন্যাসের মতো এর অসংখ্য কেন্দ্র থাকতে পারে? তাও নিশ্চয়ই নয়। এখানেই ছোটগল্পের অনন্যতা।

আমরা ছোটগল্পের ধরনে দেখে এসেছি যে ছোটগল্প মূলত কোনো একটি বৃত্তকে সম্পন্ন করে। একটি ঘটনা বা একটি কি খুব বেশি হলে দুটি চরিত্রকে উদ্ভাসিত করে। ছোটগল্প একমুখী হয়েই গড়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে দেখতে পাই ছোটগল্পও বহুমুখী হয়ে গেছে। গল্পের একমুখীতা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গল্পহীন গল্প, প্লটহীন গল্প লেখা হচ্ছে। এসব লক্ষণ আগেও কম বেশি ছিল কিন্তু মূল লক্ষণে গল্পের গুরুত্ব কখনো কমে যায়নি। এখন ছোটগল্প হতে পারে, স্রেফ একটি বলার ভঙ্গি। যেমন, জাঁ লুক গোদারের চলচ্চিত্রের অন্যতম দিক হলো- বলাটাই যখন বিষয় হয়ে ওঠে। লেখার ধরনই যখন বিষয় হয়ে ওঠে- এমন মাত্রায় পৌঁছে গেছে ছোটগল্প। সুবিমল মিশ্র যেমন গোদারের এই ধারণা থেকে নিজের গল্প-উপন্যাসকে জারিত করেছেন। কিন্তু পাঠক যদি আগের রুচিতে তাঁর ছোটগল্প পড়তে যায়, তাহলে সেটিকে গ্রহণই করতে পারবে না।

খুশবন্ত সিংয়ের ভাষ্য থেকে পেয়েছিলাম, যে আমেরিকায় ছোটগল্প বিচিত্রমুখীতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, কিন্তু বৃটেনে সেটি এখনো এর ধ্রুপদী মেজাজ ধরে রেখেছে। ‘নিউ ইয়র্কার’ ও ‘গ্রান্টা’য় মুদ্রিত ছোটগল্পের ধরন তাই আলাদা। সত্যি বলতে গেলে ছোটগল্পে নতুনত্ব আনতে গেলে কোনো নতুন ধরনের অভিব্যক্তির প্রয়োজন দেখা দিতেই পারে। যেমন কোনো শিল্পমতবাদ তৈরি করে সেমতো গল্পকে চালিত করা। সেটি প্রতীকবাদ বা অভিব্যক্তিবাদের  হাতে যেমন তৈরি হয়, তেমন তৈরি হয়েছিল বাংলাভাষায় হাংরি বা শাস্ত্রবিরোধী ছোটগল্পকারদের হাতে। শাস্ত্রবিরোধীদের স্লোগানই ছিলো: ‘গল্পে এখন যারা কাহিনি খুঁজবে তাদের গুলি করা হবে।’ তাদের অন্যতম বিষয় হলো প্লট বা কাহিনিবিরোধিতা। তাদের গল্প কিছু দেখা, পর্যবেক্ষণ ও অনুভব আত্মতার (সাবজেক্টিভিটি) প্রতিসরণ। প্রতিফলনও নয়। হ্যাঁ, প্রতিসরণ। একটু সরে যাওয়া প্রচলিত ছকের বাইরে। নিজস্ব ভঙ্গিই তাদের ভঙ্গি, আন্তরিক জীবনের প্রতিসরণই তাদের গল্প।

আর অনেক আগে থেকেই ছোটগল্প বিষয়ের বেলায় মুক্ত। আন্তন চেখভ বলেছিলেন, একটি আপেল নিয়েই হতে পারে গল্প। ফলে বিষয় ছোটগল্পের প্রধান বিবেচ্য নয়। তাহলে? ছোটগল্পের মূল বিষয় তাহলে মনে হয় তিনটি- এক গদ্য, দুই লেখার ভঙ্গি বা বয়ান, তিন কোনো পরিস্থিতি বা পর্যবেক্ষণ।

গদ্যের বুনন আর বয়ান দুটো একটু হলেও আলাদা। যেমন শহীদুল জহিরের বয়ানকৌশল এতই মনোমুগ্ধকর যা তার গদ্যের দুর্বলতা ঢেকে দেয়। আবার কারো কারো গদ্যের শক্তি এতটাই যে, তার বয়ানকৌশল এমনকি বিষয়ের দুর্বলতা ঢেকে দেয়। যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্পে এটি লক্ষ্য করা গেছে। বিষয় বলতে কিছুই নেই, কিন্তু গদ্যভঙ্গির শক্তি সেটিকে আড়ালে ফেলে দেয়। পড়ার আনন্দেই পড়া হয়ে যায় তেমন গল্প।

২.

কল্পনা, অনুভব ও ভাষাবোধ- বোধ করি এই তিনটি বিষয় পাঠকের দিক থেকে তাকে একটি চর্চার ভেতরে রাখে। ছোটগল্প পড়া মানে ভাষার সবচেয়ে তীক্ষ্ম-তীব্র বয়ানভঙ্গির মধ্যে থাকা। অবিরাম বা মাঝেমধ্যেই ছোটগল্প পড়া মানেই ভাষার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারো যদি ভাষার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে, তাতে এমন এক গভীর ক্ষতি ও ক্ষত তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী। সেই লোক আর ভাষার স্রোতের ভেতরে আসতেই পারে না। বা নামতেই পারে না। যেমন সাঁতার না জানা লোক জলে নামতে চায় না, তেমন হয় তার দশা।

আমরা টের পাই যে, পত্রপত্রিকা পড়া কেবল তথ্য জানার জন্য নয়। এর সঙ্গে নিহিত আছে সময়ের ভাষা ও ভাষ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের পরিচয়। যেমন একজন ব্যক্তি কিছু বিষয় তথ্য হতে পারে। সে কবে জন্মেছে, কবে কোন স্কুলে পড়ছে, এসএসসিতে তার ফল কেমন ছিল, কলেজ জীবন কোথায় কেটেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবে ভর্তি হয়েছিল, কোন বিষয় পড়েছিল- এসবই তথ্য, কিন্তু ব্যক্তিটি কেমন তার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে না মিশলে সে পরিচয় পাওয়া যায় কি?  ভাষা হচ্ছে মানুষের সেই দৈনন্দিনতার অন্তরঙ্গ বিষয়। সেই বিষয়ের আরো অন্তরঙ্গ দিক উঠে আসে সাহিত্য থেকে বিশেষ করে ছোটগল্প থেকে। কারণ ছোটগল্প উপন্যাসের চেয়েও মনে হয় সমকালীন খুঁটিনাটি বিষয়গুলিকে আরো অনুপুঙ্খভাবে হাজির করে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চেয়ে তার ছোটগল্প অনেক বেশি সমকালীনতার ভেতরে খুঁটি গেড়েছে। এজন্য একজন লেখকের উপন্যাসে জীবনের বড় দিকে কথা থাকতে পারে। থাকতে পারে হিমালয় জয়ের কাহিনি। কিন্তু ছোটগল্প দেয় পাহাড়ের পাদদেশের বয়ান। উপন্যাসের শিখরমুখী অভিযানে সে ব্যস্ত নয়। তার লক্ষ্য স্থির কোনো বিন্দু ধরে সেটির পরিধির পরিচয় তৈরি করা।

উপন্যাস যেখানে বর্গীয় গণ্ডি পেরিয়ে একটি পরিসর হয়ে ওঠে, ছোটগল্প সেই পরিসরের ভেতরে কোনো একটি কোণ থেকে বিরাট পরিসরের দিকে তাকিয়ে থাকার কৌশল হয়ে ওঠে। উপন্যাস ও ছোটগল্পে তফাৎটি রমাপদ চৌধুরী তার গল্পসমগ্রের শুরুতে সুন্দর করে দেখিয়েছেন, যেখানে ঔপন্যাসিক একটি যুদ্ধের বর্ণনা ও ফল দেখতে সব কিছু টুকে নিচ্ছেন সেখানে কেবল একটি নারীর অশ্রুবিন্দুর ভেতরে পুরো যুদ্ধের অভিব্যক্তি তৈরি করছেন ছোটগল্পকার।

ছোটগল্পকার দেখতে পান কেন একটি দেশে রেলব্যবস্থার বদলে বেশি বেশি রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আবার তিনি যদি দেখতে না পান যে নৌ-যোগাযোগের মাধ্যমে সবচেয়ে সুন্দর করে প্রকৃতির অপূর্বলীলাভূমি পাকভারত উপমহাদেশের প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দরভাবে রক্ষা করার প্রস্তাবটি নাচক হয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে কী গভীর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পড়তে হচ্ছে বিশাল একটি অঞ্চলকে, তাতে তার গল্পের খুব ক্ষতি হয়ে যায় না, কিন্তু তিনি যদি ছোটগল্পে দেখাতে না পারেন ব্র্রিজ তৈরির কারণে কী করে নদী শুকিয়ে গেছে, আর তাতে করে এককালের মাঝি ও জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন শহরে এসে কুলিমজুরে পরিণত হচ্ছে, আর এতে করে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর মাছ, নদীতে থাকা জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে হাজার হাজার বছর ধরে সে যে জ্ঞান অর্জন করেছিল বংশ পরম্পরায়- তার ক্ষতি, তাহলে বলতে হবে ছোটগল্পকার সময়কে দেখতে পাননি।

প্রকৃত ছোটগল্পকার দেখতে পাবেন ব্যবসা ও বাণিজ্য নিয়ে পড়ালেখার গড্ডলিকা প্রবাহে কত কত মেধাবী ও সৃষ্টিশীল ছাত্রছাত্রীদের জীবনের অপচয়। সে ঝাঁকের কৈ হয় বুঝে না-বুঝে; বিবিএ এমবিএ পড়ে দেখা যায় মাত্র আট হাজার টাকায় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি করছে, চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করছে, তার কোনো সংস্কৃতি নেই, তার কোনো গল্প নেই, আলাপ আড্ডার পরিসর নেই, থাকার মধ্যে আছে কিছু ভার্চুয়াল সম্পর্ক, একটি অনলাইনে পাওয়া বান্ধবী- এই জীবনকে ছোটগল্পকার দেখতে পাবেনই।

আগের জীবনের সঙ্গে বর্তমান জীবনের কতটা ব্যবধানও অন্তর্গত মিল- ছোটগল্পে এর ছাপ স্পষ্টভাবেই পড়ে। ছোটগল্পকার পালন করে গণচিন্তকের (পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল) ভূমিকা। তিনি তৈরি করেন মনের ও কল্পনার একটি গণপরিসর (পাবলিক প্লেস)। দুটিই বলতে গেলে আমাদের জীবন থেকে ক্রমে হারিয়ে গেছে। ছোটগল্পকার এমন অনেক হারিয়ে যাওয়া বিষয়কে আমাদের সামনে এনে হাজির করেন। তার গদ্যের বুননে ও নিজস্ব বয়ানে তৈরি হতে থাকে আমাদের জীবনের প্রত্নঅভিযানগুলি। ফলে ছোটগল্পকারের দায় মোটেও ছোট নয়। বিরাট সে দায়। আর সে দায় বহন করা খুব সহজ বিষয় নয়। সরল বিষয় তো নয়ই। সাহিত্যের ইতিহাসের পরম্পরায় ছোটগল্পের ধরন ও ধারণায় তিনি স্নাত হয়ে তৈরি করবেন এমন এক পথ যা তার নিজস্ব, কিন্তু নিজস্ব হয়েও তিনি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারবেন তার গল্পের বীজ, যে বীজ তিনি সংগ্রহ করে তার নিজের মনের জমিতে পুঁতে জন্ম দিয়েছিলেন গল্পবৃক্ষ, সেই বৃক্ষ থেকে ফের ফল থেকে তৈরি হবে যে বীজ- পাঠক তা গ্রহণ করে নিজের মনোভূমি তৈরি করবেন জীবনকে দেখার বোঝার বোধ করার চোখ। এই দেখতে পাওয়ার ভেতর দিয়েই ছোটগল্পকার পাবেন তার দেখানোর সার্থকতা।

 

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়