ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জাতিগত রুচিবোধ, সৃজনশীলতার সঙ্গে গ্রন্থমেলা জড়িত

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতিগত রুচিবোধ, সৃজনশীলতার সঙ্গে গ্রন্থমেলা জড়িত

খ্যাতিমান স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর। চলচ্চিত্রকার হিসেবেও তার আলাদা পরিচিতি রয়েছে। গত দুবছর তিনি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। করছেন গ্রন্থমেলার নকশা পরিকল্পনা। এবার মেলার পরিসর বেড়েছে। সাজসজ্জাতেও মিলছে রুচি এবং নান্দনিকতার চমৎকার সমন্বয়। এত অল্প সময়ে এত বৃহৎ একটি পরিকল্পনা কীভাবে সফল হলো জানতে কথা হয় এনামুল করিম নির্ঝরের সঙ্গে। কথোপকথনে ছিলেন আমিনুল ইসলাম শান্ত

রাইজিংবিডি: একুশে গ্রন্থমেলার পরিকল্পনা, নকশা আপনি করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়েছেন?

এনামুল করিম নির্ঝর: পুরো আয়োজন কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায় সে কাজটি আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে করেছি। নাগরিক জীবনে আমাদের অনেক চাপ থাকে। যেমন ট্রাফিক জ্যাম। এজন্য আমরা কারো প্রতি মনোযোগ দিতে পারি না। স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারি না। এই পরিকল্পনায় প্রধান বিষয় ছিল বইমেলায় দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার বিষয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ রয়েছে। এর সঙ্গে যেন সবাই যুক্ত হতে পারেন- এমন আরো অনেক বিষয় ভাবতে হয়েছে। 

গ্রন্থমেলা এবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। এজন্য মেলা চার ভাগে ভাগ করেছি। বাংলা একাডেমির অংশকে করেছি শিকড়। জাতির পিতার জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল সংগ্রাম। সংগ্রাম নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছি। মুক্তি নামে একটি জায়গা আছে। এসব মিলিয়ে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হতেখড়ি নামে একটি জায়গা করেছি। যেখানে বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে বিশিষ্ট কারো হাত ধরে লেখালেখির শুরুটা করতে পারে। এতে ঐতিহ্যগত একটি বিষয় আছে। এরকম ছোট ছোট অনেক কিছু মেলায় রয়েছে। চেষ্টা করেছি নতুনত্ব আনার। মেলার পরিধি বেড়েছে, এক্ষেত্রে আমরাও মানুষের হাঁটাচলার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জায়গা বাড়িয়েছি। দেখবেন— ‘লেখক বলছি মঞ্চ’ আগের চেয়ে অনেক বড় করা হয়েছে। পার্ক দখল করে যে মেলা হতো সেটা না করে, পার্কের মধ্যে একটি মেলা কীভাবে হতে পারে সেই চেষ্টা করেছি।

রাইজিংবিডি: পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?

এনামুল করিম নির্ঝর: আমি স্বেচ্ছাশ্রমে কাজটি করেছি। বাংলা একাডেমি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমাকে কাজটি করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য বাংলা একাডেমির প্রতি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। এ কাজের বড় চ্যালেঞ্জ বাস্তবতা। সময়সীমার মধ্যে অনিশ্চয়তা থাকে। কারণ মেলার সঙ্গে অনেক কিছু সম্পৃক্ত। প্রশাসন এর সঙ্গে জড়িত। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়, সংস্থার মন রক্ষা করে কাজ করতে হয়। দুই বছর আগে মেলা যেভাবে হয়েছে এখনো সেভাবে হচ্ছে। কারণ মেলার জন্য নির্ধারিত বাজেট নেই। অদ্ভুত কায়দায় এটি হয়। একটি স্পন্সর কোম্পানি দয়া করে যে টাকা দেয়, সেই টাকা দিয়ে যেভাবে ম্যানেজ করা যায়, সেভাবে কাজটি করতে হয়। অথচ জাতিগত রুচিবোধ, সৃজনশীলতা অনেক কিছুর সঙ্গে এই মেলা জড়িত।

বইমেলার সঙ্গে তিনটি বিষয় জড়িত। এক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। যেখানে দেশের রাজনৈতিক সব বড় ঘটনা ঘটেছে। দুই ভাষা। মানে বাংলা একাডেমি। তিন বই। এই মেলার সঙ্গে দেশ, ভাষা ও বই জড়িত। অথচ মেলার জন্য নির্ধারিত কোনো বাজেট নেই। এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে সরকার থেকে যদি কোনো নিয়ম-কানুন করে দেয়, তবে আমরা কিছু কাজ করতে চাই। যেমন কিছু স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করতে চাই। যাতে এগুলো প্রতিবার তৈরি করতে না হয় এবং ভাঙতে না হয়। লেখক সত্তা ও শিল্পী সত্তার জায়গা থেকে বইমেলার প্রতি আমার আলাদা আবেগ কাজ করে। সেখান থেকে দুই বছর শ্রম দিয়েছি। এখান থেকে কোনো কিছু চাই না- সম্মান পেলেই খুশি। 

রাইজিংবিডি: এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বাংলা একাডেমি আপনাদের কতটুকু সহযোগিতা করতে পেরেছে?

এনামুল করিম নির্ঝর: এই ধরনের সৃজনশীল কাজে যদি ভাবনার স্বাধীনতা পাওয়া যায়, তবে সেটাই সবচেয়ে বড় সহযোগিতা। এই সহযোগিতা তারা ভীষণভাবে করে। সবসময় আমাদের উৎসাহ দেয়। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও সদস্য সচিব জালাল ভাইয়ের কথা স্মরণ করতে চাই। এই আয়োজনের প্রত্যেকটি জায়গায় আমাদের সহযোগিতা করেছেন তারা। একটি সরকারি কাজে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে, এ কাজ করতে গিয়ে তার মুখোমুখি হইনি। বরং প্রচণ্ড স্পৃহা পাচ্ছি।

রাইজিংবিডি: আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কী এবার ব্যয় বেড়েছে?

এনামুল করিম নির্ঝর: কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় ততটা বাড়েনি। মেলার যে ঘনত্ব ছিল সেটা এবার আলগা করে দিয়েছি। এমন নয় যে অনেক সংখ্যা বাড়িয়েছি। যেভাবে জায়গা বেড়েছে সে তুলনায় ব্যয় অতটা বাড়েনি।

রাইজিংবিডি: আগে স্টল সাইজ ৮×৮ ছিল। এখন সেটা কমিয়ে ৮×৬ করা হয়েছে। এদিকে মেলার পরিধি বাড়ছে, ওদিকে স্টলের আকার কমছে।

এনামুল করিম নির্ঝর: এটা বাংলা একাডেমির বিষয়। মেলায় কয়টি স্টল হবে, সেগুলোর আকার কেমন হবে- এসব বিষয় একাডেমি এবং প্রকাশকরা নির্ধারণ করেন।

রাইজিংবিডি: লোগো ডিজাইন করার ক্ষেত্রে কোন ভাবনা মাথায় রেখে কাজটি করেছেন?

এনামুল করিম নির্ঝর: গত বছরের লোগো নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। লোগো ডিজাইনের বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২০ সাল। লোগোতে তিনটি বিষয় যুক্ত করেছি। এক ২০২০ সাল। দুই একশ সংখ্যা। এবার এই সংখ্যাটি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একটু অন্যভাবে লোগোতে এটি লেখা আছে। এটা যেন মানুষ মাথা খাটিয়ে বের করেন। তিন লাল-সবুজ রং। লাল-সবুজ তো আমাদের রং। এখন থেকে প্রতি বছর নতুন লোগো তৈরি হবে। আর আগামী বছর ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ থাকছে না। বরং ‘অমর একুশে বইমেলা’ লেখা হবে। 

রাইজিংবিডি: ডিজাইনগত দিক থেকে গত বছরের গ্রন্থমেলা ও এবারের মেলার পাথর্ক্য কী?

এনামুল করিম নির্ঝর: গত বছর যখন কাজটি করি তখন অনেক কিছু জানতাম না। বাংলা একাডেমির সঙ্গে বোঝাপড়ার জায়গা তত ছিল না। সব মিলিয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু এবার এই স্বাচ্ছন্দ্যটা পেয়েছি। বর্তমানে সড়কে কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। এটা এবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। গতবার এই চ্যালেঞ্জটা ছিল না। এবার প্রবেশ পথ দুটো করেছি। গতবার একটি ছিল। জায়গা ডিস্ট্রিবিউট করে সরিয়ে দিয়েছি। গ্রন্থ উন্মোচনের জায়গা এবার পার্কে করেছি। এসব বিষয়ে এবার অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। 

রাইজিংবিডি: গতবার দর্শনার্থীদের অভিযোগ ছিল স্টল খুঁজে না পাওয়ার। এবার এই সমস্যা কতটা নিরসন করেছেন?

এনামুল করিম নির্ঝর: এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ দিক নির্দেশনা রাখা হয়েছে। এবার এটা হওয়ার কথা না। এখন অনলাইনের যুগ। যে কেউ সহজেই স্টল খুঁজে বের করতে পারেন। তারপরও গ্রাফিক্যালি পরিবর্তন করেছি। আর স্টল খুঁজে বের করার বিষয়টি চর্চারও বিষয়। বলছি না এবার খুবই স্মার্ট জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। তবে আগেরবারের চেয়ে অনেক সহজ করার চেষ্টা করেছি। একজন দর্শনার্থী যেখানেই দাঁড়িয়ে থাকুক না কেন এবার ভিজ্যুয়ালে সমস্যা নেই। যদি ম্যাপ দেখে কেউ যেতে চান পারবেন, আবার লেন দেখে যেতে চাইলে সেটাও সম্ভব।

রাইজিংবিডি: স্বেচ্ছাশ্রমে কাজটি করতে উদ্যোগী হলেন কেন?

এনামুল করিম নির্ঝর: আমাকে হঠাৎ করে পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়েছিল। একজন স্থপতিকে তাদের কেন দরকার প্রথমে বুঝতে পারিনি। হাবীবুল্লাহ সিরাজী আমাকে একদিন বললেন, ‘আপনার যা মনে হয় তাই করেন।’ তারপর একে একে অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। অর্থাৎ স্বাধীনতা এবং অনুপ্রেরণা দুটোই আছে। আমরা সবকিছু এত বেশি বাণিজ্যিক করে ফেলেছি যে, আমাদের মানসিকতা বদলে গেছে। স্বেচ্ছাশ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তার মাধ্যমে আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান সিস্টেম আর্কিটেক্টস চেষ্টা করছি বইমেলাকে একটি অর্থপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যেতে। যাতে অন্যরা এ কাজে উৎসাহ পায়। আরেকটি বিষয় হলো—স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছি এটা অনেকে জানেন না। বাংলা একাডেমির দুজন ব্যক্তি সেদিন জানতে চাইলেন- ‘আপনি সত্যি সত্যি স্বেচ্ছাশ্রমে কাজটি করছেন?’ আসলে আমি কাজটি করছি এই মানসিক জায়গা পরিবর্তনের জন্য।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়