ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আয়নাবাজি ও কিছু কথা

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫১, ৯ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আয়নাবাজি ও কিছু কথা

আয়নাবাজি সিনেমার পোস্টার

রুহুল আমিন : আয়নাবাজি মুক্তির আগে চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ জোড়ছে প্রচারণা চালানো হয়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়েও বেশ প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। এতে চলচ্চিত্রটি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। আর মুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত আয়নাবাজির পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছে।

 

এই ফাঁকে বলে রাখি- অমিতাভ রেজা চৌধুরী নির্মিত এই সিনেমাটি মুক্তির পর, অমিতাভ রেজার একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা তৈরি হয়। সাক্ষাৎকারে অমিতাভ নিজেকে বাঙালি মুসলমানের চলচ্চিত্র নির্মাতা বলায় এই সমালোচনা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটিকে চলচ্চিত্রের প্রচারণার স্টান্টবাজি হিসেবেই ধরে নিয়েছি।

 

আয়নাবাজি মুক্তি পাওয়ার দিন চলচ্চিত্রটি দেখেছেন এমন একজন নাট্যনির্মাতার সঙ্গে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে আলাপ হয়। এই নাট্যনির্মাতা আবার সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। টেলিভিশন নাটকে মোটামুটি পরিচিত নির্মাতাও তিনি। ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম এই কারণে যে, আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য এইরকম তরুণ নির্মাতারা গুরু্ত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। তেমনিই আয়নাবাজি সম্পর্কে তার মতামত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। তিনি আয়নাবাজি দেখে বললেন তার ভালো লাগেনি। খানিকটা হতাশই হলাম।

 

এ ছাড়াও আরো দুয়েকজন নির্মাতাকে আয়নাবাজি দেখার পর নেতিবাচক মতামত দিতে দেখলাম ফেসবুকে। সব মিলিয়ে হলে গিয়ে আয়নাবাজি দেখার কৌতূহলটা দ্বিগুণ হলো। গত বুধবার হলে গিয়ে দেখলামও। এক কথায় বলতে গেলে চলচ্চিত্রটি আমার ভালো লেগেছে। যদিও আমি চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নই। কিংবা চলচ্চিত্র সমালোচকও নই। তারপরও মনে হয়েছে দর্শক হিসেবে নির্মাতা অমিতাভ রেজার কাছে যা প্রত্যাশা করেছিলাম তা তিনি পুরোপুরি না হলেও, বেশখানিক পূরণ করতে পেরেছেন। যেটুকু পূরণ হয়নি বলে মনে হয়েছে তা নিয়েই কয়েকটি কথা।

 

প্রথমত অমিতাভ রেজা সিনেমাটি মুক্তির আগে বলেছিলেন, সিনামার গল্প আমাদের গল্প। আসলেও গল্পটি আমাদের বলতে অমিতাভ কী বুঝাতে চেয়েছেন ঠিক বুঝতে পারিনি। যদি স্টান্টবাজির জন্য, সিনেমার প্রচারণার জন্য অমিতাভ এই কথা বলে থাকেন তবে ঠিক আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই যদি তিনি গল্পটিকে আমাদের বলে থাকেন, তবে ‘আমাদের গল্প’ হতে হলে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

 

আয়নাবাজির প্রথম অর্ধেক কিছুটা স্লো মনে হয়েছে। প্রচুর লং শট ও সাবজেক্টের দীর্ঘ উপস্থিতি কিছুটা এক ঘেয়েমির জন্মও দিয়েছে কখনো কখনো। যেমন সাংবাদিকের মোটরসাইকেল চলার দৃশ্য কিংবা গাড়ি চলাচলের কিছু দৃশ্য। আর চরিত্র হিসেবে সাংবাদিকের চরিত্রটা একেবারে বিরক্তির মনে হয়েছে। যেহেতু আমি নিজে সাংবাদিকতায় আছি সুতরাং পরিচালকের উপস্থাপিত সাংবাদিককে নিয়ে আমার আপত্তি আছে। দেশে এমন সাংবাদিক তাও আবার ক্রাইম বিটে কাজ করেন, কথায় কথায় নিজের পরিচয় এভাবে দেওয়াটা বিরক্তিকর লেগেছে। ক্রাইম রিপোর্টার যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করেন। সোর্সের ব্যাপারে, সোর্সের নিরাপত্তা ও ইনফরমেশন গ্যাদারিংয়ে তাকে সব সময় স্মার্টলি ডিলিং করতে হয়। নিজের পরিচয় ডিসক্লোজের ব্যাপারেও তাকে সতর্ক হতে হয়। কিন্তু আয়নাবাজির হতাশাগ্রস্ত সাংবাদিক সাবেরকে (পার্থ বড়ূয়া) দেখে মনে হয়েছে এমন সাংবাদিক কোথায় পেলেন অমিতাভ? হয়তো অমিতাভ রেজা এই রকম সাংবাদিকের দেখা পেয়েছেন। তা ছাড়া সাবেরের পার্সোনাল লাইফেরও ডিটেইল নাই। শুধু বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তা বুঝতে পেরেছি।

 

শুধু সাংবাদিকের চরিত্র নয়, হৃদি (নাবিলা)চরিত্রটিরও ডিটেইল নেই। আমি মনে করি ভালো সিনেমার কাহিনি এগিয়ে যায় অনেকগুলো ঢাল-পালা বিস্তার করে। জট পাকিয়ে তোলা হয় দর্শকদের সামনে। সিনেমার শেষের দিকে ধীরে ধীরে সব জট খুলে দেন পরিচালক। সেই অর্থে এই সিনেমায় অমিতাভ শুধু একটি চরিত্র শরাফত করিম আয়নার (চঞ্চল চৌধুরী) ব্যাপারটিতে বেশি নজর দিতে আর সব যেন ভুলে ছিলেন। সহযোগী আর কোনো গল্প দাঁড় হয়নি বা দাঁড় করাননি তিনি। এক আয়না ছাড়া আর কোনো শক্তিশালী চরিত্রও ছিল না। আয়নাকে দিয়েই গল্পটা বলেছেন অমিতাভ। যে কারণে সিনেমার শেষের দিকে ঠিক সিনেমাটিক সমাপ্তি হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে। দর্শকদের উত্তেজনা হঠাৎ করে মাটিতে আছরে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছে। ধীরে ধীরে নামানোর চেষ্টাটা ছিল না।

 

আর নাবিলার বাবার চরিত্রটা দেখে কলকাতার অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর অন্তহীন সিনেমার রনো তথা রঞ্জনের (কল্যাণ রায়) কথা মনে পড়েছে বার বার। কেন পড়েছে তা জানি না। নাবিলার চরিত্রটিও আরো ডিটেইল হতে পারত। নাবিলার অভিনয় মোটামুটি ভালো লেগেছে। নতুন হিসেবে খারাপ করেননি। এ ছাড়া লুৎফর রহমান জর্জ, গাউসুল আলম শাওন, বৃন্দাবন দাশ, শিশু অভিনেতা ও অতিথি চরিত্রে আরেফিন শুভ ভালো অভিনয় করেছেন।

 

এই সিনেমার মূল চরিত্র শরাফত করিম আয়না (চঞ্চল চৌধুরী)। নাগরিক সংকট সৃষ্ট চরিত্র। বিভিন্ন অপরাধীর চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে সে। জাহাজের কুকের ছদ্মবেশে চঞ্চল খুব ভালোভাবে সে অভিনয়টুকু করেছেন। অমিতাভের এই চরিত্রটি আমার কাছে এই সময়ে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। বিশেষ করে আমরা যখন ভালো মানুষের ভণিতা করে তার আড়ালে ভেতরে ভেতরে অপরাধমূলক মনোবৃত্তি জারি করে রাখি। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা আমাদের গল্প না, আমাদের সময়ের গল্প। যা রূপকধর্মী নান্দনিক উপস্থাপন হয়েছে।

 

চলচ্চিত্রটির ক্যামেরার কাজ ভালো লেগেছে। রাশেদ জামান বেশ সুন্দর কিছু শট নিয়েছেন যা চোখে লেগে থাকার মতো। বিশেষ করে পুরান ঢাকার লোকেশন ও কারাগারের দৃশ্যগুলো মনে হয়েছে জীবন্ত। ইন্দ্রদীপ দাশ গুপ্তের করা আবহ সংগীত অনেক দিন পর মনে হয়েছে দেশীয় সিনেমায় নুতনত্বের স্বাদ। মিউজিকে অর্ণব, ফুয়াদ, হাবিব ও চিরকুট সব মিলিয়ে বেশ ভালো লেগেছে।

 

সব মিলিয়ে অমিতাভ গল্পটি বলতে পেরেছেন। পুরো সিনেমায় একটা পরিমিতি বোধ লক্ষ্য করা গেছে। কোথাও খুব বেশি এক ঘেয়েমি বা কোথাও কোনো রকম অতিরঞ্জিত ব্যাপার ছিল না। যতটুকু রঙ্গ-রসের দরকার ছিল ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক রিল্যাক্স করেছেন পরিমিত রঙ্গরসে। কিছু চরিত্রের ডিটেইলের অভাব ছাড়া স্টোরি টেলিংয়ে অমিতাভ নিজের নামের সুবিচার করেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে।

 

কেউ কেউ বলছেন, বাংলা সিনেমার ব্রেক থ্রো আয়নাবাজি। আয়নাবাজি ঠিক সিনেমা হয়ে উঠেনি এমন কথাও শুনছি আবার। কথা উঠেছে ব্যবাসায়িক লাভ-অলাভ নিয়েও। মাত্র ২১টি সিনামা হলে মুক্তি পেয়ে কতটা ব্যবসা সফল এই সিনেমা তা সংশ্লিষ্টরাই কেবল বলতে পারবেন। যদিও প্রায় প্রতিটি শোতেই হাউস ফুল থাকছে হলগুলোতে। বাংলা সিনেমার সর্বভুক দর্শক হিসেবে আয়নাবাজি দেখে একটি কথাই বার বার মনে হয়েছে, চলচ্চিত্রটি নিয়ে যত তর্ক-বির্তকই হোক না কেন, এই রকম সিনেমাও যদি নিয়মিত হয় ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে আমাদের হুমকির মুখে থাকা হলগুলো অন্তত পক্ষে আর শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। ব্যক্তিগত মতামত ভিন্ন থাকতে পারে, পছন্দ ভিন্ন থাকতে পারে, থাকতে পারে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের দলাদলি। কিন্তু সব ধরনের সিনেমা হোক এটা চাই। সব সিনেমারই দর্শক তৈরি হোক, সিনেমার জন্য দরকার। তবে না প্রত্যেকে প্রত্যেকের পছন্দের সিনেমাটা দেখতে পারব। হল থেকে বের হওয়ার পর দর্শকদের পরিতৃপ্ত মুখ দেখে অন্তত আমার মনে হয়েছে আয়নাবাজি সফল। সিনেমা হিসেবে আয়নাবাজি টিকে থাকবে কি থাকবে না সেটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু দর্শকদের পরিতৃপ্তি দেখে বলতে পারি, আয়নাবাজি দর্শকদের কাছে পছন্দ হয়েছে। এটাই আয়নাবাজির ভেলকি!

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৬/রুহুল/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়