ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শিকলবন্দি দাদন, স্ত্রী-সন্তান কোথায়?

বেলাল রিজভী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিকলবন্দি দাদন, স্ত্রী-সন্তান কোথায়?

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর : ছোট্ট একটি ঘর। টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা সেই ছোট্ট ঘরটিতে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। তোষকহীন একটি তক্তপোষ। মাথার কাছে তক্তা দিয়ে বানানো টেবিল, তাতে পানির পাত্র। ঘর, চৌকাঠ, দরজা। এই হলো দাদন হাওলাদারের (৩৭) জগৎ।

দরজার ওপাশের সুবিশাল আকাশ আর সবুজে ছাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ তাকে হাতছানি দেয়। কিন্তু এই জগতেই বাঁধা পড়েছে সে লোহার শিকলে। সভ‌্য সমাজে আর ঠাঁই নেই দাদন হাওলাদারের।

দাদন হাওলাদারকে সবাই পাগল বলে। বলবেই না কেনো? সম্বিত হারিয়ে একে তাকে দাবড়ানি দেয়। পরনের পোষাক ঠিক রাখে না। ভুলভাল বকে। এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়ায়। হাসে-কাঁদে আর স্ত্রী-ছেলে মেয়েকে খুঁজে বেড়ায়।

সভ‌্য সমাজের হৃদয়বান ব‌্যক্তিরা তাই তাকে পাগল আখ‌্যা দিয়েছে। সেজন‌্য অত‌্যাচার থেকে সমাজকে বাঁচাতে দাদনের বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলেকে লোহার শিকলে বেঁধেছেন। একদিন দু’দিন নয়, একবছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে।

অথচ কী সুন্দর জীবন ছিল তাঁর। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ভরপুর সংসার। অভাব অনটন থাকলেও জীবনে কোনো ঘাটতি ছিল না দাদনের। হঠাৎ যেনো এক ভংয়ঙ্কর ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল।

মাদারীপুর কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের জায়গির গ্রামের আব্দুল জব্বার হাওলাদারের ছেলে দাদন হাওলাদার। ছোট বেলা থেকেই সহজ সরল প্রকৃতির। অন্যের জমি বর্গা চাষ করতেন। কখনো অন্যের ক্ষেতে দিনমজুরী, আবার কখনো বিভিন্ন এলাকায় আচার বিক্রি। এই তার পেশা। স্ত্রী মোকসেদা বেগম, বড় মেয়ে জান্নাত (১২), ছোট মেয়ে মিমি (৮) ও ছেলে ইয়ামিন (৪)। এদের নিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মাসহ ভালোই ছিলেন দাদন।

দাদনের ছোট ভাই খবির হাওলাদার (৩২)। বড় ভাই দাদনের সংসারেই ছিলেন। বিয়েও করেছিলেন তিনি। বিয়ের কয়েক বছর পার হলেও বাবা হতে পারেনি। প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এর কিছুদিন পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেও কিছুদিন পরে চলে যায়। দেড় বছর আগে তৃতীয় বিয়ে করেন খবির। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু তৃতীয় বিয়ের কয়েক মাস পর খবিরের মতিভ্রম হলো। স্ত্রীকে ফেলে রেখে ছেলে-মেয়েসহ দাদনের স্ত্রী মোকসেদাকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ‌্যে পাড়ি জমালেন তিনি।

এ ঘটনা সহ‌্য করতে পারলেন না দাদন। সমাজের কাছে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়লো তার। একদিকে সমাজ, অন‌্যদিকে স্ত্রী সন্তান হারানোর দুঃখ। একেবারে আক্ষরিকভাবেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সহজ সরল দাদন।

কাজ কর্মে মন নেই, খাওয়া-দাওয়া নেই, ঘুম নেই, যেদিকে মন চায় সেদিক চলে যান। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে এলোমেলো উত্তর দেন। মাঝে মধ্যে একে তাকে মারধর করতেন। শরীরে পোষাক রাখতেন না। এভাবেই কিছু দিনের মধ্যে তিনি পুরোপুরি মানসিক ভারসাম‌্যহীন হয়ে পড়লেন। সমাজের দৃষ্টিতে যাকে বলে পাগল।

এদিকে দাদনের এ অবস্থা দেখে এলাকার লোকজন তাকে জিনে ধরেছে বলে প্রচার করলেন। তাঁকে বেঁধে রাখা না হলে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কোনো উপায় না পেয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা তাই দাদনের পায়ে লোহার শিকল পরালেন। বেঁধে রাখলেন একটি ছোট্ট ঘরে। সেই থেকে বন্দী দাদন।

দাদনের চিকিৎসা প্রয়োজন। অসহায় বাবা-মা ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন সাধ‌্যমতো। ফকিরের ফু, হুজুরের পানি পড়া, নানা কবিরাজি কায়দা। কিন্তু কিছুতেই জিন নামেনি দাদনের ঘাড় থেকে।

হাসি খুশি দাদনকে দেখলে কেউ বলবে না সে মানসিক ভারসাম‌্যহীন। পায়ের শিকল চোখে পড়ার আগে কেউ বুঝতেও পারবে না। সহজ সরলভাবেই তিনি কথা বলেন। বন্দী জীবন নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দেন। আমি হাটে-বাজারে যাব, ঘুরেফিরে জীবন কাটাব। শিকল পরা অবস্থায় আমার থাকতে ভালো লাগে না।’

এদিকে প্রতিবেশীরা দাদনকে পাবনায় পাঠানোর কথা ভাবছেন। সেখানে গেলেই সে ভালো হয়ে যাবে। এটাই তাদের বদ্ধমূল ধারণা।  অনেকেই বলছেন, মানসিক চিকিৎসকের ছোঁয়া পেলে দাদন ভালো হয়ে যাবে। সবাই পরামর্শ দিলেও সেখানে পাঠানো বা সঠিক চিকিৎসার দায়ভার কেউ নিতে রাজি নয়। দাদনের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পক্ষেও কাজটি করা একেবারেই অসম্ভব।

দাদনের মা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, নিজেরাই ঠিকভাবে খেতে পারি না। টাকার অভাবে ছেলেটাকে চিকিৎসাও করাতে পারি না। আমি আর ওর বাবা দুজনেই বৃদ্ধ হয়ে গেছি। কোথায় নিয়ে চিকিৎসা করাব, কার কাছে নিয়ে যাব তাও জানি না। সরকার যদি আমার ছেলের চিকিৎসা করায় তা হলে আমার ছেলেটা ভালো হয়ে যাবে। আমি আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাই, সরকার যেন আমার ছেলের চিকিৎসা করায়।’

দাদনের মায়ের এই চাওয়া কখনো পূরণ হবে কি না জানি না। তবে দাদনকে নিয়ে পরিবারের অনেকেই ভাবেন। দাদনের চাচা তাদের মধ‌্যে একজন।

দাদনের চাচা নূর মোহাম্মদ হাওলাদার বলেন, ‘গত বছরের কোরবানির পর ওর আপন ভাই খবির দাদনের স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পালায়। তারপর থেকেই দাদন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। শুরুরদিকে ছাড়াই থাকতো। তবে ওর আচরণের কারণে বাধ্য হয়ে বেঁধে রাখতে হচ্ছে। দাদনের চিকিৎসা করানোর মত টাকা আমাদের কাছে নেই। ওর বাবাও বৃদ্ধ মানুষ। এখন সরকারিভাবে যদি চিকিৎসা করানো যায় তা হলে ছেলেটি সুস্থ হয়ে যাবে। ’

দাদনের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমার চাচা দাদন হাওলাদার দেড় থেকে দুই বছর আগেও সুস্থ মানুষ ছিলেন। এখন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। তাকে ভালো ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করালে সে আবারো সুস্থ হয়ে যাবে।’’

লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী তোফাজ্জেল হোসেন (গেন্দু কাজী) বলেন, ‘শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি দুঃখজনক। যেহেতু বেশি দিন হয়নি, সেক্ষেত্রে পাবনার সরকারি মানসিক হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করলে সে ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে আমার সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমি তা করব।’

কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমিতো বিষয়টি জানতাম না, আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। তার পরিবার যদি অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করব। জোরপূর্বক যদি কেউ শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে তা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

অনেকেই দাদনের চিকিৎসা সহায়তা করতে চাইলেও তার পরিবার সেটা সমন্বয় করতে অক্ষম। দায়িত্ব ও হৃদয়বান ব‌্যক্তি ছাড়া তাকে নিয়ে কেউ পাবনা বা দূরে কোথাও চিকিৎসার জন‌্য যেতে সম্মত হবে না। মানসিক ভারসাম‌্যহীন ব‌্যক্তিকে সামলাতে সবাই কিছুটা হলেও ভয় পায়।

অনেকেই হয়তো আন্তরিকভাবেই চাচ্ছেন দাদন সুস্থ হয়ে উঠুক। তবে বাইরে থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁর মনের ভেতরের ভারসাম‌্য কী কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন? বিনা দোষে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার যে কষ্টে তিনি আজ মানসিক ভারসাম‌্যহীন, সেই কষ্টের ক্ষতে ওষুধ লাগাবে কে? আদরের ছোট ভাই আর সোহাগী স্ত্রীর বিচার কে করবে?


রাইজিংবিডি/মাদারীপুর/১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯/বেলাল রিজভী/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়