ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কেউ শুনছে না ট্যানারি শ্রমিকদের কান্না

আরিফুল ইসলাম সাব্বির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেউ শুনছে না ট্যানারি শ্রমিকদের কান্না

আরিফুল ইসলাম সাব্বির, সাভার : টানা কয়েক মাস ধরে বেতন ভাতা পাচ্ছেন না সাভার ও রাজধানীর হাজারীবাগের তিনটি ট্যানারি কারখানার দুই শতাধিক শ্রমিক। বর্তমানে তারা অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

শ্রমিকদের অভিযোগ, রাজধানীর হাজারীবাগে অবস্থিত লেচকো ট্যানারির শ্রমিকরা বেতন-ভাতা পান না সাত মাস ধরে। সাভারে অবস্থিত রোমা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শ্রমিকরা বেতন-ভাতা পান না গত পাঁচ মাস ধরে। ক্রিসেন্ট টেনারির শ্রমিকরা বেতন ভাতা পান না গেল দেড় মাস।

শ্রমিকরা বলছেন, মালিক পক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন না। কলখানা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ করেও বেতন ভাতা পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে হতাশ তারা।

সম্প্রতি সাভারে অবস্থিত রোমা লেদার ও ক্রিসেন্ট ট্যানারির শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ট্যানারি দু’টিতে শতাধিক শ্রমিক রয়েছেন।

রোমা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ এ ১৯ বছর ধরে কাজ করেন শ্রমিক আস্তাহার তালুকদার। তিনি বলেন, ‘মালিক কারখানার কাজ না থাকার কারণ দেখিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে গত পাঁচ মাস ধরে তাদের ৫০ জন শ্রমিককে বেতন-ভাতা দিচ্ছেন না। ‘

তিনি জানান, রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে বাসে করে প্রতিদিন সাভারের হরিনধারা এলাকায় কারখানায় যাতায়াত করেন। এতে তার প্রায় ১২০ টাকা করে প্রতিদিন খরচ হয়। পাঁচ মাস ধরে বেতন-ভাতা না পেলেও নিজ পকেটের টাকা খরচ করে নিয়মিত কারখানায় আসতে হচ্ছে। গত পাঁচ মাসে তার পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে নিজের জমানো টাকা খরচ করেও ৩৩ হাজার টাকা দেনা হয়েছে।

শ্রমিক প্রতিনিধি আস্তাহার বলেন, ‘কাজ না থাকার কারণে এর আগে ১৫ জন শ্রমিককে বেতন ভাতা পরিশোধ করে বিদায় করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্ত আমরা ৫০ জন শ্রমিক কোন বেতন ভাতা পাচ্ছি না। মালিকপক্ষ আমাদের বিদায়ও করছেন না।’

তিনি আরো বলেন, ‘কারখানার প্রতি শ্রমিক গড়ে ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা মালিকের কাছে পাওনা রয়েছে বলে জানান আস্তাহার। মালিক পক্ষ যদি কারখানা চালায় ভাল করে চালাক আর যদি চালাতে না পারে আমাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে বিদায় করে দিক এটাই আমাদের দাবি।’

১০ বছর ধরে রোমা লেদারের কাজ করা শ্রমিক মন্জুয়ারা বেওয়া বলেন, ‘বেতন ভাতা না পেয়ে পাঁচ মাস ধরে বাসা ভাড়া দিতে পারছি না। বাড়ির মালিক বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে। গত পাঁচ মাসে বেতন ভাতা না পেয়ে ৫০ হাজার টাকা দেনার বোঝা বইতে হচ্ছে।’

চার সন্তানের জননী মন্জুয়ারা বলেন, ‘সন্তানদের নিয়ে আমি কীভাবে চলছি সেটা এক মাত্র আল্লাহ্ জানে। বেতন না পেলে আমাদের প্রাণে মরতে হবে।’

ক্রিসেন্ট ট্যানারির শ্রমিক মাসুদ রানা জানান, তাদের কারখানায় প্রতি পনের দিন পরপর বেতন দেওয়া হতো। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে কাজ না থাকার অজুহাতে কর্তৃপক্ষ কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছেন না।

কারখানায় মোট ৬০ জন শ্রমিক রয়েছে উল্লেখ করে মাসুদ রানা বলেন, ‘আমাদের বেতন পরিশোধ করা হোক এটাই আমাদের দাবি।’

রাজধানীর হাজারীবাগের লেসকো ট্যানারির শ্রমিক এসএম মন্জুরুল হক বলেন, ‘বেতন ভাতা পরিশোধের বিষয়ে মালিকপক্ষ, কলকারখানা অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশসহ স্থানীয় সাংসদকে বিষয়টি জানিয়েও বেতন ভাতা পরিশোধের কোনো আশ্বাস মেলেনি। এ অবস্থায় ১৩২ জন শ্রমিক গত সাত মাস ধরে মানবেতর জীবন-যাপন করছি।’

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধের বিষয়ে ট্যানারি কর্তৃপক্ষকে বার বার চাপ দিয়েও লাভ হচ্ছে না। মালিক পক্ষ চাচ্ছেন, বেতন ভাতা দীর্ঘ দিন না দিলে শ্রমিকরা এমনিতেই চলে যাবে।’

আবুল কালাম আজাদ জানান, কাজ না থাকার অজুহাতে ক্রিসেন্ট ট্যানারি ও রোমা লেদারের শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না।  রাজধানীর হাজারীবাগের লেসকো ট্যানারির শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না শ্রম আইনে মামালা চলার অযুহাতে।

তিনি বলেন, ‘বেতন না পেলে শ্রমিকরা কীভাবে চলবে? বিষয়টি ট্যানারি কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বেতনসহ বিভিন্ন পাওনাদি পরিশোধ করবে এটাই প্রত্যাশা।’

এদিকে ক্রিসেন্ট ও লেসকো ট্যানারির মালিক এমএ কাদের ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলায় কারাগারে রয়েছেন। সে কারণে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ট্যানারি দুটির লেদার টেকনিশিয়ান গিয়াস উদ্দিন বাহার বলেন, ‘ব্যাংকের কিছুটা ঝামেলা থাকার কারণে সাভারের ক্রিসেন্ট ট্যানারি শ্রমিকদের দেড় মাসের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়নি। আমরা দ্রুত বেতন ভাতা পরিশোধ করব।’

লেসকো ট্যানারির বিষয়ে জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘বেতন ভাতা না দেয়ার অভিযোগ তুলে শ্রমিকরা কলকারখানা অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন। ওই ঘটনায় শ্রম আদালতে মামলা চলছে। বিষয়টি এখন কোর্টের এখতিয়ারে।‘

শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে রোমা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আবু তাহের বলেন, ‘কাজ নেই। ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছি না। তাই শ্রমিকদের বেতনও দিতে পারছি না। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও জুতার দাম কম। অপরদিকে ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে খারাপ সময় পার করছি।’

নিজের জমি বিক্রি করে হলেও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে বলে আশ্বাস দেন আবু তাহের।

 

রাইজিংবিডি/সাভার/১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/সাব্বির/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়