ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

একাত্তরের এইদিনে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল কৃষ্ণপুর

জেলা সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একাত্তরের এইদিনে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল কৃষ্ণপুর

একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর। সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠার পূর্বেই বলভদ্র নদীর হাওরবেষ্টিত কৃষ্ণপুরে ১০/ ১২ জন পাকসেনা অষ্টগ্রাম ক্যাম্প থেকে স্পিডবোট যোগে প্রবেশ করেন।

হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত কৃষ্ণপুরে গ্রামটি ছিল দুর্গম। কিন্তু স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ও কতিপয় আলবদর বাহিনীর সদস্যের সহযোগীতায় এই দুর্গম গ্রামটিতে হানা দেয় পাকসেনারা।

তারা তাৎক্ষণিক কৃষ্ণপুর গ্রামের গদাইনগর, চন্ডিপুর, লালপুর, গকুলনগর, গংগানগর, সিতারামপুরসহ বিভিন্ন পাড়া ঘেরাও করে ফেলে। তাদের দাপটে কেঁপে উঠে কৃষ্ণপুরের মাটি। রূপ নেয় ভয়ানক পরিস্থিতি। তাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।

হানাদাররা নিরীহ লোকদের ঘুম থেকে তুলে এনে কৃষ্ণপুরের ননী গোপাল রায়ের বাড়ির পুকুরের ঘাটলা সংলগ্ন পাকা জায়গায় ও গদাইনগর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ির উঠানসহ চন্ডীপুর গ্রামের তিনটি স্পটে একত্রিত করে।

এ সময় অনেকেই পানিতে থাকা কচুরীপানার মধ্যে, ঘরের গোপনস্থানে, বাড়ির ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও পাকসেনাদের ব্রাশফায়ার থেকে রেহাই পাননি কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা কালী দাস রায়, ডাঃ ননী রায়, রাধিকা মোহন রায়, গোপী মোহন সূত্রধর, সুনীল শর্মা, মুকুন্দ সূত্রধর, যোগেন্দ্র সূত্রধর, মহেন্দ্র রায়, অনিল মাঝি, চন্দ্র কুমার রায়, জয় কুমার রায়, শান্ত রায়, কিশোর রায়, ননী চক্রবর্তী, সুনিল চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র দাস, জগদীশ দাস, ইশান দাস, ধীরেন্দ্র রায়, হরিচরণ রায়, মদন রায়, দাশু শুক্ল বৈদ্য, হরি দাশ রায়, শোক দেব দাস, অবিনাশ রায়, রামাচরণ রায়, শৈলেষ রায়, ক্ষিতিশ গোপ, নীতিশ গোপ, হীরা লাল গোপ, প্যারি দাস, সুভাষ সূত্রধর, প্রমোদ দাস, সুদর্শন দাস, গোপাল রায়, দীগেন্দ্র আচার্য্য, রেবতী রায়, শবরঞ্জন রায়, দীনেশ বিশ্বাস, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, রস রাজ দাস, জয় গোবিন্দ্র দাস, বিশ্বনাথ দাস, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, মহাদেব দাশ, মহেশ দাসসহ ৪৫ জন ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আশ্রয় নেয়া নিরীহ লোক মিলে ১২৭ জন।

এতে বলভদ্র নদী বেষ্টিত কৃষ্ণপুর শ্মশানে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়। তারপর পাক সেনারা লুন্ঠন, ধর্ষণেও করে নারকীয় তান্ডব চালায়।

কৃষ্ণপুরে আজও হানাদারদের অত্যাচারের নির্মমতার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। এলাকাবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই দিনের বিভিষিকাময় ঘটনাগুলো। আজও ননী গোপাল রায়ের বাড়ির টয়লেটের দেয়ালে, বাড়ির পাশের দুর্গা মন্দিরের দেয়ালে গুলির ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে সেই ভয়ানক হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি। স্বজন হারানোর বেদনায় অশ্রুসিক্ত স্বজনরা তাদের পরিজনদের হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। স্বাধীনতার অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। তারা এ হত্যাকান্ডের সুবিচার কামনা করেছেন।

সেই দিনের প্রত্যক্ষদর্শী চন্ডিপুর পাড়ার বাসিন্দা গোপাল চন্দ্র রায়ের ছেলে গোপেন চন্দ্র রায় জানান- সে সময় তিনি ছোট ছিলেন। পাক সেনারা তার চোখের সামনে রশি দিয়ে বেঁধে ব্রাশফায়ার করে হত্যাকান্ড চালায়। এ সময় তাদের ব্রাশফায়ার থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান গদাইনগরের দীন বন্ধু, পরিতোষ রায়সহ আরো অনেকেই। তবে পাকসেনারা চন্ডিপুরের কাউকেই ছাড় দেয়নি।  

একই গ্রামের বাসিন্দা জয়কুমার রায়ের ছেলে বেনুপদ রায় জানান, ওই দিন তার বয়স ছিল ১১ বছর। সে সময় তিনি নিজ চোখে দেখেছেন পাকদের কর্মকান্ড। তিনি জানান, হানাদার বাহিনীর চেয়ে রাজাকার, আলবদরদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তারা মিলে আমাদের নির্মমভাবে হত্যাচার চালায়। হানাদারদের হত্যাকান্ডে আমার বাবা জয় কুমার রায়, চাচা চন্দ্র কুমার রায়সহ ৭ জন আত্মীয়কে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল। হানাদাররা নিরীহ এসব ব্যক্তিদের হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এ স্মৃতি ভোলার নয়।

এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কৃষ্ণপুরের বাসিন্দা অমরেন্দ্র লাল রায় জানান- কৃষ্ণপুরে প্রবেশ করে ননী গোপাল রায়ের ঘাটলায় বসে পাক কমান্ডার হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে।  পরে তারা চলে গেলে একেএকে ১২৭ জনের মৃতদেহ একত্র করে গণকবর দেয়া হয়।

হবিগঞ্জ-লাখাই আসনের সংসদ সদস্য আলাহাজ্ব এডভোকেট মোঃ আবু জাহির  ২০১২ সালে ১৭ ডিসেম্বর শহীদদের স্মরণে বধ্যভূমির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মিত হয় বধ্যভূমি।

কৃষ্ণপুর কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লিটন চন্দ্র সূত্রধর জানান- পাকদের হাতে কৃষ্ণপুর গ্রামের ৪৭জনের স্মরণে স্কুল প্রাঙ্গণে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এ স্মৃতিস্তম্ভে আরো উন্নয়ন কাজ প্রয়োজন। তাছাড়া তাদের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এ স্কুলটি উন্নয়ন বঞ্চিত রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর নিহতদের স্মরণে আলোচনা সভাসহ নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন হয়ে আসছে। এবারও এভাবে অনুষ্ঠান হয়েছে। তিনি জানান- বধ্যভূমি রক্ষণাবেক্ষণে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছেন।


হবিগঞ্জ/মোঃ মামুন চৌধুরী/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়