ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘কিডনি কানেকশন জয়পুরহাট টু ইন্ডিয়া’

সিদ্দিক আলম দয়াল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কিডনি কানেকশন জয়পুরহাট টু ইন্ডিয়া’

কিডনি বিক্রি করে অসুস্থ হয়ে পড়া বেউর গ্রামের রাজেশ।

দেশে মানব অঙ্গ-প্রত‌্যঙ্গ বিক্রয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেজন‌্য গোপনে চলছে মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি বিক্রির ব‌্যবসা। জয়পুরহাটে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট এ অবৈধ ব‌্যবসা চালাচ্ছে। সীমান্তবর্তী প্রত‌্যন্ত গ্রামগুলোয় সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে তাদের কিডনি কেটে নেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে সেইসব হতভাগ‌্য নানান জটিল রোগে ভুগে মরছে।

স্থানীয়রা এই অবৈধ ব‌্যবসাকে ‘কিডনি কানেকশন জয়পুরহাট টু ইন্ডিয়া’ বলে আখ‌্যা দিয়েছেন। জয়পুরহাটের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলো থেকে লোকজন সংগ্রহ করা হয়। পরে তাদের পাঠানো হয় ভারতের নির্দিষ্ট স্থানে। সেখানে কিডনি বিচ্ছিন্ন করার পর আবার দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাদেরকে। দেশে বসেই কিডনি বেচার নগদ টাকা পেয়ে যান ওই ব‌্যক্তি। এভাবেই চলছে অবৈধ‌্য কিডনি বিক্রির রমরমা ব‌্যবসা।

বেশ কয়েক বছর ধরে কিডনি বেচা-কেনার এই চক্রটি সীমান্তের রাজা বিরাট ও বেউর গ্রামে তাদের রাজত্ব চালাচ্ছে। এ ছাড়া গাইবান্ধার রাজাহাট ও শাখাহার ইউনিয়নের বেশ কিছু অঞ্চলে তাদের সিন্ডিকেট রয়েছে। কৌশল হিসেবে চক্রটি বেছে নিয়েছে মানুষের দারিদ্রতাকে। কেউ হয়তো রোগগ্রস্ত, কেউ এনজিওর ঋণে জর্জরিত, কেউ মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত আবার কেউ একটু স্বচ্ছল থাকার আশায় এই চক্রের পাতা ফাঁদে পা দেয়।

হতদরিদ্র এসব লোকগুলোকে টার্গেট করে তাদের সাথে সখ‌্য গড়ে তোলে চক্রটি। টাকা ধার দেয়। মিষ্টি করে সুন্দরভাবে কথা বলে। অন্তরাত্মা হয়ে পড়ে একসময়। তারপর যখন ফাঁদে আটকে যায়, তখন মুক্তির উপায় হিসেবে কিডনি বেচার কথা বলে। মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখায়। সমস‌্যা থেকে বাঁচতে অবশেষে সেইসব বন্ধুর (!) কথায় নিজের কিডনি বেচে দেয় হতভাগ‌্য লোকগুলো।

সীমান্তবর্তী এসব গ্রামে জন বসতি খুবই পাতলা। ক্ষেত্রবিশেষে একেকটি বাড়ি আধা কিলোমিটার দূরে। সেজন‌্য পরস্পরের খোঁজ রাখাও দুস্কর। এটাও ওই চক্রের জন‌্য একটি সুবিধা। পরস্পরের সাথে পরামর্শ বা একজোট হতে পারে না গ্রামবাসী। তাই বিচ্ছিন্ন লোকগুলোকে বিপথে নেয়া তাদের জন‌্য সহজই হয়।

অনেকেই কিডনি বেচে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।

প্রাপ্ত টাকা শেষ করে আবার অসহায় হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিডনি বেচে দিয়েছেন, তা বলতে নারাজ ভুক্তভোগীরা। জীবন গেলেও চক্রটির কারো নাম মুখে আনবে না বলে পণ করেছেন তারা। চক্রটি আসলে স্থানীয়ভাবে মারাত্মক শক্তি ও প্রভাবশালী। দিনে দুপুরে খুন বা ধর্ষণ তাদের কাছে মামুলি ব‌্যাপার। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত এসব লোকের ভয়ে তাই কেউ মুখ খুলতে চায় না।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুয়েকজন জানিয়েছেন, এই চক্রের মূল হোতাদের একজন হলেন ফুলচান নামের এক ব‌্যক্তি। জয়পুরহাট ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী কোনো এক গ্রামে তার বাড়ি। গ্রামের নাম কেউ বলেতে চাননি। এই ফুলচানের মাধ‌্যমেই কিডনি সিন্ডিকেটের ভারতীয় দালালরা লোকজন সংগ্রহ করে থাকে। যার কিডনি নেয়া হবে, তাকে গোপনে বর্ডার পার করে ভারতে নেন তিনিই। আবার কিডনি কেটে নেয়ার পর তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার কাজটিও তার মাধ‌্যমেই হয়।

ইতোমধ‌্যে এসব অঞ্চলের কয়েকশ মানুষ কিডনি বেচেছেন। তবে কাঙ্খিত মূল‌্য পাননি। ভারতীয় ওই চক্রটি বিক্রেতাকে আট থেকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। কিন্তু ফুলচানের চক্রটি ভুক্তভোগী ব‌্যক্তিকে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি দেয় না। বাকি টাকা রেখে দেন ফুলচান বা তার লোকজন। কেউ এ ব‌্যাপারে কথা বললে তাকে নানা হুমকি ধামকি দেয়া হয়। তাই ভয়ে মুখ খোলে না কেউ।

 

ফাঁদে পড়ে কিডনি বিক্রি বেঁচে অসহায় হয়ে পড়া রাজা বিরাট গ্রামের জয়নাল আবেদীন জহির

 

রাজা বিরাট গ্রামের জয়নাল আবেদীন জহির। চক্রটির খপ্পরে পড়ে কিডনি বেচেছেন। তিনি বলেন, ‘সাড়ে তিন লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেছি। তাই দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলের পড়ালেখার পেছনে খরচ করেছি। এখন হাতে পয়সা নাই। অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি, চিকিৎসাও করতে পারি না। কাজও করতে পারি না। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করে। সে যা নিয়ে আসে, তাই খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।’

চক্রটির ফাঁদে পড়া আরেক হতভাগ‌্য বেউর গ্রামের রাজেশ। কিডনি বিক্রি করে এখন সর্বশান্ত। কাজকর্ম করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘কিডনি বিক্রির পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। কাজ করতে পারি না। ছোট ছোট দু’টি ছেলে। তারা সারাদিন নদীতে মাছ ধরে। সামান‌্য টাকায় সেসব বিক্রি হয়। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করে। এভাবে জীবন আর চলে না।’

বুঝে বা না বুঝে কিডনি পাচার চক্রের ফাঁদে পা দেয়া লোকগুলো এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও লোক লজ্জার ভয়ে তারা মুখে কিছু বলেন না। চিকিৎসা না নিয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন অনেকেই। কেউ কেউ আত্মগোপন করেছেন।

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন আবু হানিফ বলেন, ‘দুটি কিডনিই যদি ভালো থাকে, তা থেকে একটি কিডনি দান করা যায়। তবে দানকারী ব‌্যক্তিকে অবশ‌্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিডনি দানের পরেও তার চিকিৎসা প্রয়োজন। এ ছাড়া ওই ব‌্যক্তি কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন।’

এদিকে দীর্ঘ দিন ধরে কিডনি পাচার চক্রটি সক্রিয় থাকলেও বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসেনি। তাই আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

সদ্য যোগদান করা গাইবান্ধার পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যদি কেউ না জেনে কিডনি বেচে প্রতারিত হন, তাহলে তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা ব‌্যবস্থা নেব। ক্ষতিগ্রস্তদের আইনি সহায়তাও দেয়া হবে। বিষয়টি আইনের আওতায় আনার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হবে। জড়িতদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হবে।‘

তিনি জানান, এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। সেজন্য জনপ্রতিনিধি আছেন, জেলা প্রশাসন আছেন। তাদের সহযোগিতায় স্থানীয়দের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে।


গাইবান্ধা/দয়াল/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়