ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘উয়ারী-বটেশ্বর’ দেশের প্রথম দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর

গাজী হানিফ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ৩০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘উয়ারী-বটেশ্বর’ দেশের প্রথম দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর

নরসিংদীর দুটি গ্রামের নাম উয়ারী-বটেশ্বর। গ্রাম দুটি নরসিংদী সদরের ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেলাবো উপজেলার আমলাব ইউনিয়নে।

এই দুই গ্রামের নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর’ এখানে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন।

প্রাচীন মহা-জনপদ, রাজধানী ও একটি দুর্গ নগর নিয়ে উয়ারি-বটেশ্বর। দুই হাজার সাল থেকে পর্যায়ক্রমে খননে পাওয়া গেছে আড়াই হাজার বছরের পুরনো ইট-সুরকির রাস্তা, আর্য আমলের নিদর্শন, নান্দনিক অলঙ্করণ সমৃদ্ধ বৌদ্ধ মন্দিরসহ নানা প্রাচীন নিদর্শন।

অর্থের অভাবে অনেক দিন মাটিচাপা ছিল আবিষ্কৃত এসব নিদর্শন। এতে পর্যটকরা উয়ারি-বটেশ্বর পরিদর্শনে এসে কিছুই দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতেন। পর্যটকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে 'উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর' প্রতিষ্ঠা করে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র 'ঐতিহ্য অন্বেষণ'।

বাংলাদেশের প্রথম এ উন্মুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরটি উন্মুক্ত করা হয় ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।

স্থানীয় প্রত্ন সংগ্রাহক হানিফ পাঠানের ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠান জানান, উয়ারী-বটেশ্বর প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের অনন্য প্রত্ন নিদর্শন। উয়ারী-বটেশ্বরের সন্ধান মেলে ১৯৩০ সালে। তারও প্রায় ৭০ বছর পর ২০০০সালে এর খননকাজ শুরু হয়। এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।

১৯৩৩ সালে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান সেখান থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিল বঙ্গভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। এটিই উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের প্রথম চেষ্টা। হানিফ পাঠান সেই সময়ের সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ‘প্রাচীন মুদ্রাপ্রাপ্তি’ শীর্ষক সংবাদ পাঠালে তা ছাপা হয়।

১৯৫৫ সালে বটেশ্বর গ্রামে স্থানীয় শ্রমিকেরা দু’টি লৌহপিন্ড পরিত্যাক্ত অবস্থায় ফেলে যান। ত্রিকোণ আকারের ও একমুখ চোখা ভারী লৌহপিন্ড দু’টি হাবিবুল্লাহ পাঠান তার বাবাকে নিয়ে দেখালে তিনি অভিভূত হন। ওই বছরেই ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’ শিরোনামে হানিফ পাঠান একটি প্রবন্ধ লিখন তা ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়। পরে এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি সুধী সমাজের গোচরে আসে। পরবর্তীতে তার পুত্র হাবিবুল্লাহ পাঠান স্থানটির গুরুত্ব উল্লেখ করে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন।

এর প্রেক্ষিতে ১৯৮৮-৮৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী উয়ারী-বটেশ্বর পরির্দশনে এসে প্রাচীন সভ্যতার অনুমান করেছিলেন।

১৯৯৬ সালে স্থানটি জরিপ করা হয়। জরিপ শেষ হলেও অর্থসঙ্কটের কারণে আরো ৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল খননকাজের জন্য। পরবর্তিতে ২০০০সালে বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তায় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক অধ্যাপক ড.সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম উয়ারীতে পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে দি ডেইলি স্টার পত্রিকার সহযোগিতায় একটি খননকাজ পরিচালনা করা হয় এবং ২০০৩ সালে খননকাজ পরিচালনা করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

২০০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের আওতায় অধ্যাপক ড.সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি খনন কাজ পরিচালিত হয়। একই সালে এপ্রিল মাসে ঝড় বৃষ্টির কারণে খনন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেই সময় প্রত্নস্থানটি অস্থায়ীভাবে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে মাটি চাপা দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। ২০০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় খননকাজ শুরু হয় কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানকে উয়ারী-বটেশ্বর এলাকায় খনন কাজ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। এর পর থেকে দীর্ঘদিন খনন কাজ বন্ধ থাকে। পরে ২০০৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ফোনের আর্থিক সহায়তায় পুনরায় খননকাজ শেষে একটি জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়।

২০০৮ সালে প্রাইম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এবং ২০০৯ সালে প্রগতি ইন্সুরেন্স লিমিটেড ও এফবিসিআই’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল আউয়াল মিন্টুর আর্থিক সহযোগিতায় ফের খনন কাজ হয়।

২০১০ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় পূণরায় খননকাজ চলে। ২০১১ সালে গ্রামীণ ফোনের সহযোগিতায় আবার খনন কাজ হয়। এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উয়ারী-বটেশ্বরের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে ১২তম ও একই বছর আবার ১৩ তম খনন কাজের সমাপনী ঘোষণা করেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

 

 

পরবর্তীতে ২০১৫ সালে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলের টঙ্গীরটেকে ১৪তম খনন কাজ শুরু করে। ২০১৪-১৫‘র আবিস্কারসমূহ নিয়ে ৫ জুন খনন কাজের সমাপনী ঘোষণা করা হয়। ঐতিহ্য অন্বেষণের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেনিন এর সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

আবিষ্কার:

উয়ারী-বটেশ্বর খনন করতে গিয়ে বের হয়ে এসেছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরের সমসাময়িক মানব বসতির বিশাল দুর্গ এলাকা, ইটের স্থাপত্য, প্রশস্ত রাস্তা,পার্শ্ব রাস্তা, দুর্গ প্রাচীর, পরিখা, অসম রাজার গড়, লৌহ নির্মিত হস্ত-কুঠার, বল্লম, পোড়া মাটির নিক্ষেপাস্ত্র, তাবিজ, ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, কাচের পুঁথি, বাটখারা, গর্তনিবাস, মুদ্রা ভান্ডার, নবযুক্ত মৃৎপাত্র, ধাতব চুড়ি বা তাম্র বলাই, পোড়া মাটির চাকতি ইত্যাদি জিনিসপত্রের নিদর্শন।

উয়ারী-বটেশ্বরে হানিফ পাঠানের সংগ্রহ শালায় রয়েছে নব্য প্রস্তুর যুগের অনেক নির্দেশন। খ্রিষ্টপূর্ব ২ হাজার থেকে ১২শ’ সালের নব্য প্রস্তুর যুগের পাথরের ছুড়ি, খ্রিষ্টপূর্ব ১২শ’ ও তার আগের পাথরের ছুড়ি, খ্রিষ্টপূর্ব ১ হাজার বছর আগের লৌহ বল্লম, পাথরের দু’ধারী কুঠার, পাথরে খোদাই করা লকেট- যা নারীপুরুষ সবাই মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত, আর্য আমলের লৌহ কুঠার ১৫ সের ওজনের লৌহ হাতুড়ি, ছোটদের ব্যবহার্য মিনি লৌহ কুঠার, ধনুকের গোলক, পোড়া মাটির শিবলিঙ্গ, পোড়া মাটির স্ত্রী লিঙ্গ, নকশি প্রস্তর গুটিকার মালা- যা মূল্যবান সোলেমানী পাথর বলে পরিচিত। স্রষ্টার আরাধনায় এ গুলো দিয়ে জপ করা হতো। আদি বাংলার প্রথম ধাতব মুদ্রা, যা খাদ মিশ্রণ রূপার তৈরি। এমন আরো নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে, ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, ৫০ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্ব ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, ইসলাম শাহের সময়কালের রৌপ্য, বাদশাহ আকবরের সময়কালের ব্রোঞ্জ মুদ্রা, গিয়াস উদ্দিন জামাল শাহ আমলের রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা।

উয়ারীতে পাওয়া অনেক প্রাচীণ অস্ত্র- ধারণা করা হয় তা লোহা থেকেই তৈরি। আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে লোকবসতি ছিল। তার এ বিপুল সংগ্রহের একটি বড় অংশ ১৯৭৪ সালে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এসে নিয়ে যায়।

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে আড়াই হাজার বছরের পুরনো ইট-সুরকর নির্মিত রাস্তা আবিষ্কিৃত হয়েছে এ আবিস্কারের ফলে দেশের সভ্যতার ইতিহাসে নতুন উপাদান পাওয়া গেছে। কিন্তু সভ্যতার পর উপ-মহাদেশের সম্ভবত প্রাচীনতম নগরী এ উয়ারী-বটেশ্বর।

ঐহিত্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের প্রত্ন জাদুঘর বাংলাদেশে এই প্রথম। উয়ারী-বটেশ্বরে এসে পর্যটকদের এখন আর বিমুখ হয়ে ফিরতে হবে না। পর্যটকরা মডেল গর্ত-বসতিতে নেমে ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগের বাংলাদেশ কেমন ছিল তা দেখতে পারবেন। শিশু কিশোররা প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করার অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। সেই সাথে প্রতিঘন্টায় উয়ারী-বটেশ্বর ডকুমেন্টারি ও ধারণকৃত প্রত্ন নাটক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনও প্রত্নস্থানে পর্যটকদের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা এটাই প্রথম।



নরসিংদী/ হানিফ/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়