টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে ফাঁদের ছড়াছড়ি
আল আমিন || রাইজিংবিডি.কম
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে এখন ফাঁদের ছড়াছড়ি। পুরো হাওরজুড়েই পেতে রাখা হচ্ছে- কারেন্ট জাল, কোনা জাল, প্লাষ্টিকের মাছ ধরার গুই (চাই) সহ নানা ধরনের ফাঁদ।
এসব ফাঁদে মাছ ও পাখি ধরা পড়ছে প্রতিদিন। এতে একদিকে হ্রাস পাচ্ছে হাওরের মাছ, অন্যদিকে নির্বিচার শিকারের কারণে এখানের জীববৈচিত্রও বিনষ্ট হচ্ছে।
এমনও অভিযোগ উঠেছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ আনসারদের ম্যানেজ করে রাতের আঁধারে চুরি করে মাছ ধরা ও অতিথি পাখি শিকার অব্যাহত রয়েছে।
দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় জলাভূমি তাহিরপুরের এই টাঙ্গুয়ার হাওর।
সরজমিনে এই হাওর ঘুরে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমেও দিনের বেলা অবাধে মাছ শিকার চলছে। মৎস্য শিকারিরা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এছাড়াও মাছ ধরার একধরণের গুই (চাই) ব্যবহার করছেন তারা। এসব গুইতে প্রচুর ছোট মাছের সাথে ক্ষুদ্র জলজ প্রাণিও মারা যাচ্ছে। আবার হাওরের অনেক স্থানেই অপ্রয়োজনীয় গুই ও কারেন্টজাল পরিত্যাক্ত পড়ে আছে। মালিকহিীন পরিত্যাক্ত জালে লেগেও মারা যাচ্ছে মাছ ও জলে থাকা অনেক ক্ষুদ্র প্রাণ।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা এবং স্থানীয়রা জানান, গোলাবাড়ি গ্রামের উত্তর দিকে টাঙ্গুয়ার হাওরের গভীর এলাকা হওয়ায় পর্যটকদের নৌকা প্রবেশ নিষেধ। অতিথি পাখি ও হাওরের সৌন্দর্য্য দেখার জন্য আলাদা ছোট নৌকা করে যেতে হয় পর্যটকদের। এসব গভীর এলাকায় পানির নিচে অসংখ্য কারেন্ট জাল পাতা রয়েছে। হাতিরগাঁতা, রউয়া, লেচ্ছচুয়া মারা, ছডাইন্না, বেরবেরিয়া, নোয়াল, কাজ্জুয়াউরির মতো বড় বড় বিলেও রয়েছে কারেন্ট জাল। পুরনো অনেক কারেন্ট জালে মাছ লেগে মরে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
পরিবেশ সংগঠন ও স্থানীয়দের অভিযোগ, হাওরের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বহনকারী নৌকার মাঝি ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের ম্যানেজ করে প্রায় প্রতি রাতেই চলছে অবৈধভাবে মাছ ও অতিথি পাখি শিকার। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাওরে অভিযানে যাবার আগেই আনসার ও নৌকার মাঝিরা মুঠোফোনে সংকেত পাঠিয়ে দেন। এসময় দুর্বৃত্তরা বনে-ঝোপঝাড়ে কিছুক্ষণ আত্মগোপন করে থাকার পর ম্যাজিস্ট্রেট ফিরে আসার সাথে সাথেই ফের অবৈধভাবে হাওরে নেমে যান। মাঝে মধ্যে দুই একজন মাছ ও পাখি শিকারী ধরা পড়লে কিছু জাল, নৌকা ও পাখি আটকের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে লঘু দণ্ড ও জরিমানা আদায় করা হয়। কিন্তু কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না মাছ ও পাখি শিকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা ও হাওর পাড়ের একাধিক বাসিন্দা জানান, নিত্য রাতে চুরি করে শিকারের কারণে হাওরের জলমহালই এখন মাছ ও পাখি শূন্য হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পিযুষ রঞ্জন পুরকায়স্থ টিটু বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে কিছু অসাধু জেলে অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে। তারা দিন-দুপুরে কারেন্ট জাল, কোনা জাল ও প্লাস্টিকের গুই দিয়ে পোনা মাছসহ ছোট বড় সব মাছ শিকার করছেন। এছাড়াও রাতের আঁধারে শিকারিরা পাখিও শিকার করছেন। হাওরে মাছ শিকার শেষে প্লাস্টিকের গুই ও পরিতেক্ত কারেন্ট জাল হাওরে ফেলে রাখায় অনেক মাছ মারা যায় এবং পাখি ভয়ে চলে যায়। এরকম চলতে থাকলে কয়েক বছর পর হাওরে মাছ ও পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বিজের ব্যানার্জী বলেন, ‘আমরা হাওর পাড়ের মানুষদেরকে নিয়ে উঠান বৈঠক ও সমাবেশ করেছি। সমাবেশে তাদেরকে মাছ ও পাখি না ধরার জন্য বলেছি। তাদেরকে নানা সহযোগিতাও করা হচ্ছে। তবে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে হবে। তারা সচেতন হলে হাওরে মাছ ও পাখি শিকার কমে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু অসাধু জেলে আছে তারা দিনে ও রাতে মাছ শিকার করছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা বিভিন্ন সময় কারেন্ট জাল আটক করে ধ্বংস করি। তবে কোনো আনসার সদস্য’র বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণ পেলে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
আল আমিন/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন