ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বালু মাটি দিয়ে হাওর রক্ষা বাঁধ!

আল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বালু মাটি দিয়ে হাওর রক্ষা বাঁধ!

পাহাড়ি ঢল হাওরবাসীদের জন্য অভিশাপ। সর্বনাশা এই ঢলে বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে মানুষও হয়ে পড়ে জলবন্দি।

হাওরবাসীদেরকে পাহাড়ি ঢলের বিপদ থেকে রক্ষায় তৈরি করা হচ্ছে ‘হাওর রক্ষা বাঁধ’। কিন্তু উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, এই বাঁধ তৈরি হচ্ছে বালুমাটি দিয়ে। যা পাহাড়ি ঢলে ধসে বিপদ বাড়াবে আরো।

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্ত এলাকার নদী খাসিয়ামারার ডান তীর এবং বাঁ তীরের ৩২ নং উপ-প্রকল্পের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)’র সভাপতি তমিজ উদ্দিন সম্পূর্ণ বাঁধের কাজ বালু মাটি দিয়ে করাচ্ছেন। এছাড়াও একই অবস্থা ৩১, ৩৩, ৩৪ নং উপ-প্রকল্পেও।

দ্রুত এই বালুর বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, 'নীতিমালা অনুযায়ী খাসিয়ামারা নদীর ডান তীর ও বাঁ তীরের বাঁধের কাজ হচ্ছে না। তাই ৩১ ও ৩২ নং প্রকল্পের কাজ বন্ধ করা হয়েছে।

সরজমিনে দেখা গেছে, দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বাংলাবাজার থেকে রাবার ড্যাম্প পর্যন্ত খাসিয়ামারা নদীর ডান তীর ৩২ নাম্বার উপ-প্রকল্পের ৫৭৭ মিটার বাঁধের ভাঙা বন্ধকরণ ও মেরামত কাজের সম্পূর্ণ বাঁধ বালু মাটি দিয়ে করা হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে বালু মাটিতে পা ফেললেই পা গেড়ে যাচ্ছে। এসময় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের সাথে কথা বললে তারা জানান, এখানে বালু মাটি আছে, ভালো মাটি কোথা থেকে পাবেন! তাই তারা বালু মাটি দিয়েই কাজ শেষ করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও কাজ দেখে গেছেন।

মেঘালয়ের কোল-ঘেঁষে সুনামগঞ্জ সদর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বিস্তৃত কাংলার হাওর এবং নাইন্দার হাওর। দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ও লক্ষীপুর এবং বোগলাবাজার ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের কৃষকরা এই দুই হাওরে চাষাবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ পাহাড়ি নদী খাসিয়ামারার ডান তীর উপ-প্রকল্পের। বাঁম তীরও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।

স্থানীয় ও উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এই দুই ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ উঁচু করার জন্যই চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) কে এ বছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬২ লাখ টাকা। পিআইসি দায়িত্বশীলরা বাঁধের কাজ করেছেন বাঁধের নিচের বালু মাটি দিয়ে। অথচ গত বছর সরকার এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিল ৪৪ লাখ টাকা। সেবছরও এই প্রকল্পের কাজ বালু মাটি দিয়ে হয়েছিল।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, যেভাবে হাওর রক্ষা বাঁধ বালু মাটি দিয়ে করা হচ্ছে- এরকম বাঁধ নির্মাণ হলে বর্ষার এক সপ্তাহের বৃষ্টিতেই ভেঙে যাবে বাঁধ। তাতে এই বাঁধ হাওরের কোন কাজে আসবে না। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ কর্তৃপক্ষ যেন দায়সারাভাবে কাজ করাচ্ছেন। বাঁধের কাজ সঠিকভাবে করতে হলে এখানে ‘জিও টেক্সটাইল’ ছাড়া এই বাঁধগুলো টিকবে না। বাঁধের কাজে সরকারের টাকাই ব্যয় হবে কিন্তু ফসল রক্ষার কাজে আসবে না। তাই কতৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় একাধিক কৃষক জানান, খাসিয়ামারা ডান তীর আর বাঁম তীরের নামে প্রতিবছরর কাজ হচ্ছে কিন্তু কৃষকদের কাজে আসছে না। এবছর খাসিয়ামার নদীর আশপাশের এলাকায় বোরো আবাদ হবে না। কিন্তু ডান তীর আর বাম তীরের নামে প্রকল্প বানিয়ে সরকারের টাকা অপচয় করা হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ‘এবছর খাসিয়ামারা নদীর দু’পারে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ হচ্ছে। কিন্তু বাঁধের কাজ হচ্ছে বালু মাটি দিয়ে। এই মাটি এক মাসও টিকবে না। বাঁধের মাটি বর্ষার বৃষ্টিতে ভেঙে নদীতে চলে যাবে। এই বাঁধের নামে সরকারের টাকা লুটপাট করা হচ্ছে।’

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মোকবুল হোসেন বলেন, ‘দুই তীরের বাঁধের মাটিতেই বালুর মিশ্রণ আছে। জিও টেক্সটাইল ছাড়া এই বাঁধগুলো টিকবে না।’

জাকির হোসেন বলেন, ‘যেভাবে বালুর বাঁধ দেওয়া হয়েছে একটু ভারি বৃষ্টি হলেই বাঁধ ভেসে যাবে।’

খাসিয়ামারার ডান তীরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. তমিজ উদ্দিনের কাছে বালুর বাঁধ কেন দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে মাটি পাওয়া যায় না। বাঁধের পাশে বালু মাটি পেয়েছি তাই এই মাটি দিয়ে বাঁধের কাজ করাচ্ছি। প্রায় ৬৫ শতাংশ বাঁধের কাজ শেষ। কিছুদিন আগে অডিট এসেও দেখে গেছে বালু দিয়ে বাঁধের কাজ করছি।’

দোয়ারাবাজার উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী (এসও), উপজেলা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব সমশের আলী বলেন, ‘আমি ও আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম স্যার এই বাঁধগুলো পরিদর্শন করেছি। বালু মাটি দিয়ে বাঁধ করা হলে বালু সরিয়ে নতুন করে বাঁধের কাজ করা হবে। বর্তমানে কাজটি বন্ধ রয়েছে।’ 

এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া সুলতানা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমরা খাসিয়ামারা ডান তীর দুইটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ করেছি। বালু মাটি দিয়ে কাজ করলে আমরা পিআইসিদের বিল দেব না।’ 

এ ব্যাপারে পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-২) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এই খাসিয়ামারা নদীর ডান তীর ও বাম তীর প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছি। বাঁধটি বালু দিয়ে করছিল। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) কে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।’



সুনামগঞ্জ/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়