ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘খুলনা অ‌্যাটাক’র চিঠি বহন করেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১২ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘খুলনা অ‌্যাটাক’র চিঠি বহন করেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ

মুক্তিযোদ্ধা শহিদ জমাদ্দার

১৯৭১ সাল। চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে। মানুষের মনে আতঙ্ক। রাজাকার ও আল-বদরের সদস‌্যরা সংগঠিত হচ্ছে। তাদের ঠেকাতে প্রস্তুত হন মুক্তিযোদ্ধারাও। দেশপ্রেমের শক্তিতে বলিয়ান মুক্তিসেনারা নানা যুদ্ধে জয়ী হন। তবে সেজন‌্য তাদেরকে নানা ত‌্যাগ স্বীকার ও অত‌্যাচার সইতে হয়। ওই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ‌্যে ছিলেন এক কিশোর। তার নাম শহিদ জমাদ্দার। 

সময়ের পরিক্রমায় শহিদ জমাদ্দার এখন প্রবীণ। বয়স ৬৪ বছর। নীরবে-নিভৃতে কেটে যাচ্ছে তার জীবন।

মুক্তিযোদ্ধা শহিদ জমাদ্দার খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামের মৃত রফি উদ্দিন জমাদ্দারের ছেলে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিন বোন বিবাহিত। বড় ভাই হারুনার রশিদ জমাদ্দারও মুক্তিযোদ্ধা। জেলা মুজিব বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন। বর্তমানে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা তিনি।

শহিদ জমাদ্দার তিন মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। বাস করছেন নিরালা প্রান্তিকা মসজিদ সংলগ্ন কাশেমনগরে। শহীদ হাদিস পার্কের কাছে ‘শহিদ মাইক সার্ভিস’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রূপসা উপজেলা শাখার সহকারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি শহিদ জমাদ্দার এ প্রতিবেদকের কাছে তার যুদ্ধকালীন স্মৃতি, অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা এবং যুদ্ধজয়ের কাহিনি তুলে ধরেন।

শহিদ জমাদ্দার জানান, ১৯৭১ সালে তার চাচা শফি আহমেদ জমাদ্দার খুলনার মহসিন জুটমিলের শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। ওই সময় মিল-মালিক মহসিন হোসেন স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী হন। চাচার অনুরোধে বড় ভাই হারুনার রশিদ জমাদ্দার ও তিনিসহ ১৩/১৪ জন কিশোর-তরুণ মহসিন হোসেনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নামেন। তার পক্ষে মিছিল বের করলে মুসলীম লীগের সিদ্দিক আহমেদ জমাদ্দার (তৎকালীন শ্রীফলতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) ও মজিদ শেখ তাদের ওপর হামলা চালান। হারুনার রশিদ জমাদ্দার তখন খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঘটনার পর বড় ভাই ভয়ে স্থানীয় পালের বাজারের পাশে নন্দনশ্রী গ্রামের হাশেম হালদারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কয়েকদিন পর সেখান থেকে আরো কয়েকজনকে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে চলে যান।

কিশোর শহিদ জমাদ্দারও বাড়ি ছেড়ে তেরখাদার পাতলা স্কুলে চালু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে চলে যান। সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন ফহম উদ্দিন, বোরহান উদ্দিন মাস্টার, তৎকালীন তেরখাদা থানার ওসি নিরঞ্জন কুমার এবং তৎকালীন কোদলা ইউপি চেয়ারম্যান নওশের আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন।

একদিন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর লেখা ‘খুলনা অ‌্যাটাক’ সংক্রান্ত একটি চিঠি অপর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ হোসেনের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় শহিদকে। নওশের চেয়ারম্যান কারো নাম উল্লেখ না করে একটি খাম ‘সাদা ও গোলাপী রঙের শার্ট-প্যান্ট পরিহিত’ একজনকে জেলখানা ঘাটে পৌঁছে দিতে বলেন। খামটি পৌঁছানোর পর তাকে আরেকটি খাম দিয়ে সেটি পাতলা ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলা হয়। তিনি খাম নিয়ে নৌকায় করে নদীপথে বর্তমান বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে গেলে পাকিস্তানি নৌবাহিনী তাকে আটক করে। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটকের পর ট্রেনিং ক্যাম্প এবং সহযোগীদের বিষয়ে জানতে চায় তারা। তা না বলায় সিগারেট এবং জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাকা দেওয়া হয়। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তেরা ফৌজ কাহা? সাচ বাতা, ছোড় দেঙ্গে (তোদের বাহিনী কোথায়? সত্যি কথা বল, ছেড়ে দেব)।’

এক পর্যায়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর লঞ্চে থাকা স্থানীয় আলাউদ্দিন লস্করের ছেলে রাজাকার লিয়াকত লস্করকে (পরবর্তীতে এরশাদ শিকদারের সহযোগী) খোঁজ নিতে শহিদ জমাদ্দারের বাড়িতে পাঠানো হয়। তখন তার চাচাতো ভাই সিদ্দিক আহমেদ জমাদ্দার এবং তার ছেলে নজরুল জমাদ্দার জানায়, শহিদরা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তীতে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অনুরোধ করলেও পাকিস্তানি নৌবাহিনী তাকে ছাড়েনি। শহিদকে বর্তমান খালিশপুর নেভি ক্যাম্পে নিয়ে ছয় দিন আটকে রাখা হয়। সে সময় নৌ কমান্ডার আসলাম উদ্দিন খানসহ অন্যরা শহিদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালান। কিন্তু কমান্ডার আসলামের ভাইয়ের নামও ‘শহিদ’ হওয়ায় তিনি তার প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হন।

একদিন পর বেলা ১১টায় শহিদকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে বলে জানানো হয়। সে মোতাবেক ওই দিন তাকে প্রস্তুত হতে বলা হয়। শহিদকে নৌবাহিনীর মেজরের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি দেখতে পান, খালিশপুর চরেরহাটের ঠিকাদার (পাকিস্তানি নৌবাহিনীর খাদ্য সরবরাহকারী) আব্দুর রউফ শেখ বসে আছেন। রউফ শেখের অনুরোধে শহিদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি জোড়াগেট মোড়ে আসার পর দুজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। শহিদ বাড়ি ফেরার পথে তার সঙ্গে চাচাতো ভাই নজরুলের দেখা হয়। নজরুল হত্যার হুমকি দেয় শহিদকে। শহিদ বাড়িতে গিয়ে এ হুমকির কথা মাকে জানালে প্রতিবেশী আউয়ুব শেখ ও রশিদ সরদারকে নিয়ে পাতলা ক্যাম্পে ফিরে যান। ক্যাম্পে তাদেরও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন শহিদ। পরে আলাইপুর, বাতিখালকুলি এবং পোলেরহাটে যুদ্ধে অংশ নেন শহিদ।

শহিদ জমাদ্দার জানান, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি প্রথমে সম্মানি হিসেবে ৩০০ টাকা ভাতা পেতেন। এখন তা ১০ হাজার টাকা হয়েছে। কিন্তু এ টাকা পর্যাপ্ত নয়। সম্মানির পরিমাণ বাড়িয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা করা হলে মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন শহিদ জমাদ্দার। বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

 

খুলনা/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়