ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

‘যারা যুদ্ধে রাইফেল ছুঁয়ে দেখেনি, তারাও আজ মুক্তিযোদ্ধা’

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৩, ২৫ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘যারা যুদ্ধে রাইফেল ছুঁয়ে দেখেনি, তারাও আজ মুক্তিযোদ্ধা’

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার। স্বাধীন দেশে তিনি সাতক্ষীরার তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯নং সেক্টরে মেজর জলিল এবং পরে ক্যাপ্টেন শফিউল্লার অধীনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন। ৬৭ বছর বয়সে তিনি অবসর সময় কাটাচ্ছেন। যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক এবং শিক্ষামূলক কাজে।

জনপ্রিয় নিউজপোর্টাল রাইজিংবিডিকে সেই অগ্নিঝরা দিনের কথা তুলে ধরেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন ব্যবস্থা ও সচ্ছল জীবনের দাবি জানিয়েছেন। জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বাঁচতে চান।

রাইজিংবিডির সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি শাহীন গোলদার কথা বলেন আলাউদ্দীন জোয়াদ্দারের সঙ্গে। সেই আলাপচারিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

রাইজিংবিডি: কেমন আছেন?

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: ভালো আছি।

রাইজিংবিডি: যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন?

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: ১৯৭০ সালে যখন নির্বাচন হয়, তখন আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তান শাসকচক্র আমাদের দাবিয়ে রাখতো। তারা আমাদের ক্ষমতা দিতে রাজি ছিল না। দেশের মানুষ অধিকার আদায়ের জন্য ভোট দেন। এর মধ্যে ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা দাবি উন্থাপন করা হয়, এতে এদেশের জনগণ সোচ্চার হয়ে উঠল। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন, তাতে আমি উজ্জীবিত হই। তিনি ভাষণে বলেন- যার যা আছে, তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। তিনি আরো বলেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

রাইজিংবিডি: পাকিস্তানের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আপনাদের যুদ্ধ ছিল, বলা চলে অসম শক্তির যুদ্ধ। এর মধ্যে কীভাবে মনোবল ধরে রাখলেন।

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: যুদ্ধচলাকালে আমার আত্মবিশ্বাস প্রবল ছিল। দেশের সকল মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিল। সব সময় ভাবতাম দেশ স্বাধীন হবেই হবে। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জীবনের বিনিময় হলেও পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবো ইনশাল্লাহ। আমরা ৮ এপ্রিল যুদ্ধ করতে ঘর থেকে বের হয়ে ভারতের তকিপুর ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে তিন দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তৎকালীন এমএলএ স ম আলাউদ্দীন আমাদের বলেন- এ প্রশিক্ষণে হবে না। আমাদের বিহারে যেতে হবে। তখন তকিপুর থেকে বিহারে চলে যাই এবং ১ মাস ৮ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বাকুন্ডিয়া ক্যাম্পে ফিরে আসি।

রাইজিংবিডি: দেশের কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন সেই সব স্মৃতি এখনো কি তাড়া করে?

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার : জীবন বাজি রেখে ৯নং সেক্টরের কলারোয়া উপজেলার হাওয়ালখালী, কাকডাঙ্গা এলাকায় পাক সেনাদের সঙ্গে তুমুল সম্মুখযুদ্ধ করি। এরপর আমরা সেখান থেকে ভারতের বিতরে গিয়ে আবার গোলাবারুদ নিয়ে দেশে প্রবেশ করি। পরবর্তীতে আমরা মাগুরা, বারোহাড়ে ও কপিলমুনিতেও সম্মুখযুদ্ধ করি। পরে খুলনায় উঠে যাই, তখন দেশ স্বাধীন হয় এবং বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরায় ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর অধীনে মিলিশিয়া ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দেই। সাতক্ষীরা জেলা ৭ ডিসেম্বর পাক-হানাদার মুক্ত হয়।

রাইজিংবিডি: আপনার চোখের সামনে কতজন সহযোদ্ধাকে শহীদ হতে দেখেছেন?

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: এক যুদ্ধে পাইকগাছার মতলেব ও মাগুরাযুদ্ধে তিনজন শহীদ হয়। এরা হলেন, শহীদ আব্দুল আজিজ, শহীদ সুশীল, শহীদ আবুবক্কর। আবুবক্করের বাড়ি কলারোয়া উপজেলায়, বাকি দুইজন তালা উপজেলার। সহযোদ্ধা মন্টুর পায়ে গুলি লাগে, তাকে চিকিৎসা দিয়ে ভারতে পাঠাই। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরে কিন্তু অর্থ অভাবে তার করুণ মৃত্যু হয়।

রাইজিংবিডি: আপনি তো যুদ্ধে ছিলেন, সে সময় আপনার পরিবারের উপরে হামলা হয়েছে কিনা?

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: যখন আমি যুদ্ধে ছিলাম, তখন পাক-হানাদার বাহিনী আমার পরিবারের উপর হামলা করেনি। তবে আমাদের স্থানীয় নকশাল বাহিনী বাড়ি লুটপাট করে এবং আমার মাকে মারধর করে। যেটি আমি যুদ্ধ থেকে ফিরে মার মুখ থেকে শুনেছি। আজ ভাবতে অবাক লাগে, যারা যুদ্ধের সময় রাইফেল ছুয়ে দেখেনি, তারাও আজ মুক্তিযোদ্ধা।

রাইজিংবিডি: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের কাছে আপনার আর কোনো প্রত্যাশা আছে?

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: সকল মুক্তিযোদ্ধা সামাজিক মর্যাদা পাচ্ছেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটি আমার অহংকার। মুক্তিযোদ্ধারা সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকতে চায়। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতাসহ বছরে তিনটি উৎসব ভাতা দিচ্ছে; তাতে আমরা খুশি এবং গর্বিত। তবে একটু দাবি না করলেই নয়; আমার দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা আরো বৃদ্ধি করা এবং এলাকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে, যাদের ঘর-বাড়ি নেই; তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে সরকার প্রধান বলেছেন, দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধা গৃহহীন থাকবে না। আমরা তার এই উদ্যোগ সাধুবাদ জানাই। এলাকায় যে খাস জমি আছে, তার থেকে কিছু অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের বরাদ্দ দিলে তারা স্বাবলম্বী হবে।

রাইজিংবিডি: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার: রাইজিংবিডি বেঁচে থাকুক মানুষের হৃদয়ে। ধন্যবাদ আপনাকে। 


ঢাকা/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়