ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

৭ই মার্চ থেমে গেল যে ব্যতিক্রম যোদ্ধার জীবনঘড়ি

তরিকুল ইসলাম জেন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ২৫ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৭ই মার্চ থেমে গেল যে ব্যতিক্রম যোদ্ধার জীবনঘড়ি

আদমদীঘির মানুষের কাছে তার পরিচয় তিনি কবি।তিনি বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন।

যুদ্ধ থেমেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার সেই ভালবাসা জীবনের শেষাবধি অটুট ছিল ।

কবি সুলতান মাহমুদ। যৌবনদীপ্ত বয়স থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে মনে ধারণ করেছেন।তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন ৫শ কবিতা। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লিখেছেন  ১০হাজারেরও অধিক কবিতা, গান ও গল্প। এসব কবিতা তিনি বিভিন্ন জায়গায় নিজের কন্ঠে আবৃত্তি করেও শোনাতেন। প্রচার করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি এ বিরল ভালোবাসার জন্য সংসার জীবনে তাকে কখনো কখনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে, আবার তার চেয়ে বেশি সম্মানিতও হয়েছেন। তবে শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি তার।

মুক্তিযোদ্ধা ও কবি সুলতান মাহমুদের জন্ম ১৯৫১ সালের ১১ নভেম্বর আদমদীঘি উপজেলার করজবাড়ী গ্রামে। বাবা কৃষক কাবেজ উদ্দিন প্রামানিক ও মা আলতাফুন নেছার প্রথম সন্তান তিনি। আদমদীঘি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি, নওগাঁর বিএমসি কলেজ থেকে ১৯৬৮সালে এইচএসসি এবং দেশ স্বাধীনের পর নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে বিএসসি পাশ করেন।

তখনকার শিক্ষিত এ যুবকটি দেশ ও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গণে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে দেশবাসিকে জানাতে লিখতে শুরু করেন কবিতা, গল্প ও গান।

জানা যায়,  জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে বাবা-মাকে ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যান। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর কড়া পাহারার  মধ্যদিয়ে ২৯ সদস্যের একটি টিমে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান। কিন্তু ভারতে পৌঁছাতেও পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। তিনি সান্তাহার থেকে রওনা হয়ে হিলি আটাপাড়া সীমান্ত অতিক্রম করার সময় পাকিস্তানি বাহিনী টের পেয়ে গুলি ছুড়তে থাকে তার টিমকে লক্ষ্য করে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে টিমের ছয়জন সদস্য হারিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত  তাদের আর খোঁজ মিলেনি। পরে তিনিসহ ২৩ জন সদস্য বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলির মধ্যেই বালুঘাটে পৌঁছে যান। এরপর কামাড়পাড়া রিসিভশন ক্যাম্পে ভর্তি হয়ে তিনিসহ তারা সাতদিনের ট্রেনিং নিয়ে পরে উচ্চ ট্রেনিংয়ের জন্য শিলিগুড়ি পৌঁছে ১৪ দিন ট্রেনিং নেন। দেশে ফিরে তিনি ও তার সহযোদ্ধা এলকে আবুল হোসেন, আজমল, মুনছুর আলী, ফজলুল করিমসহ আরো অনেকেই রণাঙ্গণে সরাসরি অংশগ্রহন করেন এবং রাণীনগরের চকের ব্রিজ, ছাতিয়ান গ্রাম স্টেশন, সাঁতাহারসহ বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। দিশেহারা পাক বাহিনী সান্তাহার ছেড়ে নওগাঁ শহরের দিকে পালিয়ে যায়।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু ভক্ত সুলতান মাহমুদ জীবিকার তিাগিদে কাজ করেন সান্তাহারে বিভিন্ন চাতালে ম্যানেজার ও সার্ভেয়ার (আমিন) হিসেবে। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার খবর শুনে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং রাজাকার, আলবদর ও আল শামসদের বিচারের দাবি করেও লিখেন নানা কবিতা। এসব কবিতা আবৃত্তি করতেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে।

কবি হিসেবে দেশ-বিদেশ থেকে বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। ২০১৭ এবং ১০১৮ সালে ভারতের কলকাতায় আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে মহাত্মা গান্ধী স্বর্ণপদক পান ও কবিরত্ন খেতাবে ভূষিত হন। ছায়াবীথির আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে ৬ জানুয়ারি তাকে সম্মাননা দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাকে পুরষ্কৃত করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনে গত ৭ই মার্চ থেমে যায় তার জীবনঘড়ি। মৃত্যুর একসপ্তাহ তার আগে কথা হয় বঙ্গবন্ধু পাগল এই কবির সাথে। দীর্ঘ আলাপে তিনি বলেছিলেন- বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়ে পূরণ হয়েছে তার স্বপ্ন। কিন্তু পূরণ হয়নি তার শেষ ইচ্ছেটা। তার সামান্য এই ইচ্ছেটি ছিল রেলওয়ে কোয়ার্টারের সরকারি বাসা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার।

সুলতান মাহমুদের ছেলে মোহাম্মদ মেজবাহ্ বলেন, ‘বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। তিনি বঙ্গবন্ধু ও দেশকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালো বাসতেন। আমিও বঙ্গবন্ধুকে বাবা মতো ভালোবাসি।আমার চাওয়া পাওয়া বলতে তেমন কিছু নেই, বাবার মতো বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের মূল্যায়ন করা হোক শুধু এটুকুই চাওয়া।'


আদমদীঘি (বগুড়া)/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়