ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘বীরত্ব বা ভীরুতা কোনটাই মরে না’

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৬ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বীরত্ব বা ভীরুতা কোনটাই মরে না’

মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আহমেদ

ভারতের চব্বিশ পরগনার টেট্টা ট্রেনিং ক‌্যাম্প। এই ক‌্যাম্পে প্রশিক্ষণ  নিয়েছেন বাংলাদেশের হাজারো মুক্তিযোদ্ধা। প্রশিক্ষকদের সবাই হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন। বাঙালী প্রশিক্ষণার্থীরা হিন্দি বুঝতেন না, অসুবিধা হতো। হিন্দিতে ভালো দখল থাকায় অনুবাদ করে বাংলায় বুঝিয়ে দিতেন শুকুর আহমেদ শেখ। ধীরে ধীরে তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন শুকুর ভাই।

শুকুর আহমেদ দু’টি যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। থানা লুট করে হাতিয়ার তুলে দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। জীবন বাজি রেখেছেন দেশ স্বাধীন করতে।

দেশ স্বাধীনের পর চার দশক ধরে একে একে রক্ষী বাহিনী, সেনা বাহিনী এবং মংলা বন্দরে চাকরি করেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে অবসরে। বার্ধক্যের পাশাপাশি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। এখন উঠে দাঁড়াতেও পারেন না।

বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার আটজুরী ইউনিয়নের কাহালপুর গ্রামের কৃতি সন্তান শুকুর আহমেদ শেখ। ওই গ্রামের মরহুম মো. আব্দুল জব্বারের ছেলে। তারা দুই ভাই-বোন। একমাত্র বোন মারা গেছেন।

বর্তমানে পরিবার-পরিজন নিয়ে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের পূর্ব বয়রায় (পোর্ট স্কুলের বিপরীতে) থাকেন তিনি। ছয় মেয়ে ও পাঁচ ছেলের বাবা তিনি। বড় মেয়ে মারা গেছেন। ২০১৫ সালে স্ত্রীও চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার চার ছেলে পুলিশ বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত।

রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা অভিজ্ঞতার কথা। অসুস্থ‌তা স্বত্ত্বেও প্রাণ খুলে কথা বলেন তিনি। স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন পুরনো সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনগুলোর নানা কথা। আক্ষেপ করেছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট নিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শুকুর আহমেদ শেখ জানান, ১৯৭১ সালে তার বয়স আনুমানিক ২২ থেকে ২৫ বছর ছিল। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের আলম নগর এলাকায় থাকতেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন।

উত্তাল ওই সময়ে একদিন বিকেলে প্রতিবেশি আব্দুর রাজ্জাক ও মোখলেসসহ কয়েকজনকে নিয়ে বৈকালী এলাকায় পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে অংশ নেন। ওই মিছিলে পাক সেনা গুলি চালায়। গুলিতে অনেকেই হতাহত হন। বেঁচে যান ‍তিনি। সেদিন দিনগত রাতে বর্তমান পলিটেকনিক কলেজ, আলমনগর এলাকা এবং নিউজপ্রিন্ট মিলের মধ্যে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর গুলি চালায় পাক বাহিনী।

সেদিন পাক বাহিনীর হাতে শতাধিক বাঙালী নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয় আরো অনেক বেশি। বেশিরভাগ লাশ নিউজপ্রিন্টের ঘাট দিয়ে ভৈরব নদে ডুবিয়ে দেওয়া হয় সে রাতে।

ওই ঘটনায় শুকুর আহমেদ স্ত্রী-কন‌্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরদিনই পরিবার নিয়ে বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এরপর প্রতিবেশি ও বন্ধু সলেমান কাজী, তার ভাগ্নে আব্দুল হাই, ওলিয়ার রহমান শেখ, ফুলমিয়া শেখ এবং কবির ও মুক্তসহ ১৩ জনকে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।

বামনডাঙ্গা, যশোর দিয়ে বরইছড়া হয়ে ভারতের টাকি স্টেশনে পৌঁছান। সেখান থেকে চলে যান চব্বিশ পরগনার টেট্টা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের ১৪ নম্বর প্লাটুনে যোগ দেন তিনি। ওই প্লাটুনে মোট ৩৪ জন ছিলেন। প্রশিক্ষণকালীন তিনি ভারতীয় প্রশিক্ষকদের হিন্দিতে বলা কথা বাংলায় অনুবাদ করে সহযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দিতেন। তার এই অনুবাদের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহায়তা হতো।

দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে এমএলএ খয়ের মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে যান। সেখানে জাতীয় চার নেতাসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। সেখান থেকে তাকে নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

দেশে ফিরে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের অধীনে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ওই সময় এক শুক্রবারে জুমার নামাজের আগ মুহূর্তে মোল্লাহাটের চরকুলিয়া হাড়িদিয়া সেতুর কাছে রাজাকার ও পাক সেনাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন।

যুদ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি জানান, সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা হাড়িদিয়া ব্রিজ ভেঙ্গে দেয়। শুক্রবার ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা নামাজ পড়তে মসজিদে যান। সেই সুযোগে রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হাড়িদিয়া নদীতে কচুরিপানার মধ্যে অস্ত্র হাতে লুকিয়ে পড়েন। সেখান থেকে গুলি চালানো হয়। গুলিতে পাক ক্যাপ্টেন মারা যায়। ক‌্যাপ্টেনের মৃত‌্যু হলে পাক বাহিনী পিছু হটে।

এর আগে শুকুর আহমেদের নেতৃত্বে ১১ জন মোল্লাহাট থানা আক্রমণ করে ১৩টি অস্ত্র লুট করেন। সেই অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়। সেই স্মৃতি আজও জ্বল জ্বলে। তিনি বলেন, ‘বীরত্ব বা ভীরুতা কোনটাই মরে না। সেদিনের সেই ক্ষণগুলো কখনই মরবে না।’

পরবর্তীতে আরো ২৬ জনকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতে যান শুকুর আহমেদ। সেখানে ক্যাপ্টেন সিপারের নেতৃত্বে ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন। ক‌্যাম্পে থাকতেই দেশ স্বাধীনের খবর পান।

তার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৫৩৮০২, মুক্তি বার্তা (লাল বই) নম্বর ০৪০৩০৩১০৪৬ এবং গেজেট নম্বর ২৬৮৭।

শুকুর আহমেদ জানান, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিন মাস তিনি আনসার প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি রক্ষী বাহিনীতে (জিআরবি) যোগদেন।

রক্ষী বাহিনী বিলুপ্ত হলে ১৯৭৫ সালের পর তিনি সেনা বাহিনীতে সিপাহী হিসেবে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। সৈনিক হিসেবে ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

এরপর যোগদেন মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বিভাগে। এ চাকরি থেকে ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে রোগাক্রান্ত হয়ে ঘরেই থাকেন।

এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘সরকার আমাকে মাথা গোজার ঠাঁই হিসেবে ৫.৭৩ শতক জমি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু জমির দখল পেতে তাকে আরেকবার লড়তে হয়েছে। সেই লড়াই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে।

জমি ছিনিয়ে নিতে প্রতিপক্ষ ছয়টি মামলা দায়ের করে তার বিরুদ্ধে। দীর্ঘ চার বছর আইনি লড়াই করেছেন। দৌড়াতে হয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। প্রচুর টাকা ব্যয় হয়েছে। এরপর দখল পেয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের এক খণ্ড জমি।। তবে এখনও দলিল করে দেওয়া হয়নি সেই জমিটুকুর।

এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে- উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভুয়াদের ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নানা সমস‌্যার শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ দাবি করি।’


নূরুজ্জামান/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়