‘ঘর বিক্রির ১৭ টাকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাই’
ফারুক মিয়া বীর যোদ্ধা। পাকবাহিনীকে হটাতে দেশপ্রেম আর অসীম সাহসিকতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশ মাতৃকার ডাকে সারা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে। সে যুদ্ধের বিনিময়ে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি জাতি পেয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ফারুক মিয়া ১১ মাস সেনাবাহিনীর ফোর বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া হয়নি তার। বর্তমানে তার বয়স ৮০ বছর। পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর বাজারে পাশে নিজ বাড়িতে।
ফারুক মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ঢাকায় তখন আমি সেনাবাহিনীর ট্রেনিংয়ে। ২৪ মার্চ দিনের বেলায় ট্রেনিং অফিসারদের কয়েকজন যুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলাবলি করছিলেন। আমি তখন ঢাকা ছেড়ে ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জের ভৈরব স্টেশনে এসে নামি।
তিনি বলেন, দৌলতকান্দি হয়ে গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে চলে আসি। ২৫ মার্চ কালো রাতে রাজধানী ঢাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এলাকায় রেডিও না থাকায় খবর তখনও কানে এসে পৌঁছায়নি। পরদিন ২৬ মার্চ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে-দলে ঢাকা ছেড়ে লোকজন গ্রামে আসতে শুরু করে। তাদের মুখে যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর প্রথম শুনতে পায়। এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখ সিদ্ধান্ত নিলাম ভারতে চলে যাব। সাথে পরিচিত বন্ধুদের কেউ যুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি। পকেটে একটি পয়সাও নেই। পুরাতন একচালা ছোট একটি টিনের ঘর ১৭ টাকায় বিক্রি করে যুদ্ধে বেরিয়ে পড়লাম। ভারতে রওনা হওয়ার সময় বাবা-মা ও স্ত্রীর সঙ্গে আমার শেষ কথা ছিল যুদ্ধ শেষে বেঁচে ফিরলে দেখা হবে। এভাবেই যুদ্ধের সময়কার ঘটনার স্মৃতিচারণ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক মিয়া।
ফারুক মিয়া জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আগারতলা প্রবেশ করেন। পরে সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় ত্রিপুরার ওমপিনগর ক্যাম্পে। আলফা, বিবি, চাওলি, ডালটা ও ইকোর এ পাঁচটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয় ট্রেনিং। ফারুক ছিলেন ইকোতে (ইন্সপেক্টর) করিম ও রওশন তাদের ১০০ জনকে দলটিতে ট্রেনিং করান।
ভারতের ওমপিনগর ক্যাম্পে ২৯ দিন ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে। তিন নম্বর সেক্টরের অধীনে রায়পুরা উপজেলার হাঁটুভাঙ্গা, ভৈরবের শৈকারচর, বেলাব নীলকুঠি অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল এ.এন.এম নূরুজ্জামান।
স্মৃতিচারণ করে ফারুক বলেন, পাক-সেনাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহন করি। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন উপজেলার চরাঞ্চলের ভেলুয়ারচরের সিদ্দিকুর রহমান। সবচেয়ে সফল যুদ্ধটি সংগঠিত হয় হাঁটুভাঙ্গা (বর্তমান বুলেট চত্বর) রেল ব্রিজ এলাকায়।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি ২৫ জন সেনাকে আমাদের তিন প্লার্টুন মুক্তিযোদ্ধা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধের রাইফেলের গুলি ও টুইঞ্চ মটারের আঘাতে ১৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত একজন সেনা বাদে সবাই পালিয়ে যায়। পরে ওই পাক-সেনাকে স্থানীয় জনতা গণধোলাইয়ে মারা যায়।
ফারুক বলেন, নিহত সেনাদের পকেট থেকে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের ছবি পেয়েছি। প্রায় নিহত সেনার সঙ্গেই মিলেছে মিনি কোরআন শরীফ। ওই যুদ্ধেগুলোতে বারিক, নুরু ও বেলাব উপজেলার দুলালকান্দির একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন। তবে আমাদের গ্রুপের সবাই ছিলাম সুরক্ষিত।
যুদ্ধের সময় যে স্মৃতি আজও ফারুকে কাঁদায়, পাকিস্তানি সেনারা কোলনির ক্যাম্পে শ্রীরামপুর গ্রামের হাফিজ মেম্বারকে ধরে নিয়ে যায়। মেজর মঞ্জুর আলম তাঁর পুরো শরীর গরম লৌহার ছেঁকে ঝলসে দেয়। হাফিজের আত্ম-চিৎকারে এলাকার লোকজন ঘুমাতে পারত না। পরদিন নির্মম নির্যাতে তাঁর মৃত্যু হয়। বীভৎস সেই স্মৃতিগুলো এখনও মনে হলে বুক কেঁপে ওঠে।
ফারুক বলেন, এ দু-চোখে কত মৃত্যু দেখিছি তার হিসাব নেই। আড়িয়াল খাঁ নদ দিয়ে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিযোদ্ধার লাশ ভেসে যেতে দেখেছি।
নরসিংদী/হানিফ/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন