ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

অভাগী যেদিকে চায়...

বিজয় ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৫ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
অভাগী যেদিকে চায়...

লক্ষ্মী রানী দে’র সঙ্গে কাঙালীর মায়ের পরিচয় নেই। ‘অভাগীর স্বর্গ’ তিনি পড়েননি। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তার হয়নি দেখা। দেখা হলে অন্তত এই অনুযোগ তিনি করতে পারেতন, কাঙালীর মায়ের চেয়েও বড় অভাগী এই সংসারে রয়েছে। কথাশিল্পী কি লিখবেন সেই গল্প?

গল্প নয় সত্যি। কাঙালীর মায়ের মাথা গোজার ঠাঁই ছিলো। শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণের জন্য বেঁচে ছিলো একমাত্র সন্তান। যার একমাত্র প্রার্থনা ছিলো মৃত্যুর পর চিতায় ছেলের হাতের আগুন। ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রীর চিতায় যখন তার ছেলে মন্ত্রপুত আগুন ছোঁয়াল তখন দূর থেকে অভাগী সেই দৃশ্য দেখে মনে মনে বলেছিল ‘ভাগ্যিমানী মা, তুমি সগ্যে যাচ্চো- আমাকেও আশীর্বাদ করে যাও, আমিও যেন এমনি কাঙালীর হাতের আগুনটুকু পাই।’

লক্ষ্মী রানী দে’র মাথা গোজার ঠাঁই নেই। সংসারের বাঁধন ছিন্ন হয়েছে বহু বছর আগে। জীবন বেঁচে আছে অন্যের দেওয়া আহারে। এমনকি সেই জীবন যেদিন ফুরিয়ে যাবে মুখাগ্নির জন্য বেঁচে নেই কোনো সন্তান। ৭০ পেরিয়ে যাওয়া লক্ষ্মী রানী দে’র স্থায়ী ঠিকানা এখন রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালের বারান্দা। ষড় ঋতুর আসা-যাওয়া, উৎসব পার্বণ এখন আর তার জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিছুতেই যেন কিছু আর যায় আসে না তার! কিন্তু কেন এই পরিণতি?

মিশন হাসপাতালের বারান্দায় কথা হয় লক্ষী রানী দে’র সঙ্গে। প্রথমে কথা বলতে চাইছিলেন না। দশ প্রশ্নে মিলছিল এক জবাব। তাতে যতটুকু জানা গেল তা অনেকটা এরকম: রাঙামাটির রাজবাড়ি এলাকায় ছিলো লক্ষ্মী রানী দে’র বাড়ি। বাবার নাম ক্ষিতিশ বিশ্বাস। কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে তাদের বাড়ি লেকের পানিতে তলিয়ে যায়। অসহায় ক্ষিতিশ বিশ্বাস তখন পরিবার নিয়ে চন্দ্রঘোনা হিন্দু পাড়ায় শ্বশুরবাড়ি এসে আশ্রয় নেন। এখানেই বিয়ে হয় লক্ষ্মী রানী দে’র। বর রাউজান উপজেলার উনসত্তর পাড়া গ্রামের মানিকচন্দ্র দে। সুখেই কেটে যাচ্ছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। মানিকচন্দ্র কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। কখনও খাদ্যের অভাব হয়নি সংসারে। এরই মধ্যে লক্ষ্মী রানী দে’র কোলজুড়ে এলো দুই সন্তান।

কথায় বলে, অভাগীর সুখ কি কপালে সয়! বড় ছেলে লিটু দে মারা গেল মাত্র ১৩ বছর বয়সে। এর ৬ বছর পর চলে গেলো ছোট ছেলে সুজয় দে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ১১ বছর।  সন্তান হারিয়ে লক্ষ্মী রানী দে’র জীবন হয়ে উঠল বেদনাবিধুর বিভীষিকাময়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তিনি শেষ আঘাতটি পেলেন স্বামী মারা যাওয়ার পর। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলেন তিনি। লক্ষ্মী রানী দে’র সংসার হয়ে পড়ল ছন্নছাড়া! সংসারে নেমে এলো চরম দুর্বিসহ দিন।

এবার বিপদ এলো অন্যদিক থেকে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে লাগল।  লক্ষ্মী রানী দে এক কাপড়ে ঘর ছাড়লেন। এসে উঠলেন মায়ের ঘরে। এখানেও সুখ সইল না কপালে। যতটুকু সম্বল ছিলো, ছিনিয়ে নিলো তার এক ভাই। এরপর তিনি এসে ওঠেন এই হাসপাতালের বারান্দায়। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মেটাতেন ক্ষুধা।

অলক্ষ্যে বসে ঈশ্বর তখনও অন্য কোনো পরিকল্পনা করছিলেন লক্ষ্মী রানীকে নিয়ে। এরই মধ্যে ১৯৯২ সালে চোখে সমস্যা দেখা দিলে মানুষের সহায়তায় যতটা সম্ভব চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। কিন্তু তা এতোটাই অল্প ছিলো যে, চোখের আলো নিভে যেতে সময় লাগে না। দৃষ্টি হারিয়ে আরো অসহায় হয়ে পড়েন লক্ষ্মী রানী দে। ঝিয়ের কাজ হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন মানুষের দেওয়া অন্ন বস্ত্র তার শেষ ভরসা। অস্পষ্ট কণ্ঠে নিজেই বললেন, ‘যেদিন পাই সেদিন খাই।’

হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রহরী মো. সিরাজ ও জুনু চাকমা জানান, ২০ বছর হলো হাসপাতালের বারান্দায় রাতে শুয়ে থাকেন লক্ষ্মী রানী। দিনে থাকেন না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় সবাই তাকে সহানুভূতির চোখে দেখে। যে যতটুকু পারে সাহায্য করে, খাবার দেয়।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং বলেন, আমরা একবার লক্ষ্মী রানীকে টাকা-পয়সা দিয়ে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে ফিরে এসেছে। মানবিক কারণে আমরা তাকে থাকতে দিয়েছি।

 

রাঙামাটি/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়