ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

হাতি দিয়ে বনের গাছ পাচারের অভিযোগ

চাইমং মার্মা, বান্দরবান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ১৯ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ১৯:২০, ১৯ মার্চ ২০২৪
হাতি দিয়ে বনের গাছ পাচারের অভিযোগ

বান্দরবানের লামায় লেমুপালং মৌজার ১৩টি পাড়ার আশপাশের পাহাড়ের বিপন্ন প্রজাতির ওষুধি গাছসহ সব ধরনের গাছ কেটে বন উজাড় করছেন মোরশেদ আলম চৌধুরী ও তার ভাই খোরশেদ আলম চৌধুরী বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত তিন মাস ধরে বাগানের গাছ কাটার কথা বলে প্রাকৃতিক বনের বড় বড় গাছ কেটে হাতি দিয়ে পাচার করে আসছেন তারা। মোরশেদ আলম চৌধুরী গাছ কাটার অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন। 

মোরশেদ আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তার ভাই খোরশেদ আলম চৌধুরী লোহাগাড়া উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে লামা উপজেলার লেমুপালং এলাকা থেকে গত তিন মাস ধরে বনের গাছ কাটছেন বলে জানিয়েছেন এলাকার এক জনপ্রতিনিধি। এর আগেও তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ঝিরির পাথর ও বনের গাছ কেটে হাতি দিয়ে প্রাচার করার অভিযোগও উঠেছিল। 

সম্প্রতি লামা সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড লেমুপালং মৌজার পূর্বে কালা পাহাড়া (বান্দরবান-থানচি রোড), পশ্চিমে পালং খাল ও দক্ষিণে ছাইংগ্যা ঝিরি এলাকা সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লেমুপালং খালের শীল ঝিরি ও আশপাশের ঝিরির সামনেই ১৫০টির বেশি বড় বড় গাছ কেটে রাখা হয়েছে। লম্বায় এক একটি গাছ ৩০-৫০ ফুট, প্রায় গাছের বেড় ৪০-৫০ ইঞ্চি। আবার কোনটি বিশাল বড় মাদার ট্রি। এইসব গাছের মধ্যে রয়েছে- কড়ই, বানরখোলা, শিউলি, জারুল, গামারি, লালী, বাড়ানা, সিভিট, লাথিম, গোদা, গুটগুটিয়া, জলপাই, চাপালিশ, গর্জন ও বিপন্ন প্রজাতির ওষুধি গাছসহ নানান প্রজাতির গাছ। গাছ পরিবহনের জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার পাহাড় কেটে করা হয়েছে গাড়ির রাস্তা। তিন-চারটি ঝিরিতে দেখা গেছে, হাতি মল পানির সঙ্গে মিশে আছে। অস্থায়ী ঘরের উঠানে হাতিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতেও দেখা গেছে। 

আরো পড়ুন:

স্থানীয়রা জানান, উপজেলার ম্রো জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পালংমূখ পাড়া, লাংগি পাড়া, মাংলাই পাড়া, ব্যাঙ পাড়া, হেডম্যান পাড়া, বাক্কা পাড়া, পুরাতন দেওয়ান পাড়া, দেওয়ান পাড়া, আমতলী পাড়াসহ ১৩টি পাড়ার আশপাশের এলাকা থেকে গত তিন মাস ধরে নির্বিচারে গাছ কেটে পাচার করছেন মোরশেদ আলম চৌধুরী ও তার ভাই খোরশেদ আলম চৌধুরীর লোকজন। প্রতিবাদ করলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এছাড়া, গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের হাতে বন্দুক থাকায় ভয়ে পাড়াবাসী কোনো লিখিত অভিযোগ দেননি প্রশাসনের কাছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গাছ কেটে হাতি দিয়ে লোকালয়ে টেনে এনে ট্রাকে করে পাচার করছেন তারা।

বাক্কা পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) বাক্কা ম্রো বলেন, ২০১৫ সালে মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে গাছ কাটার প্রতিবাদ করেছিলেন। হাতিসহ মোরশেদ আলম চৌধুরীর গাছ কাটার শ্রমিকদেরকে একবার এলাকাবাসী সবাই মিলে বিতাড়িত করার কারণে মোরশেদ আলম চৌধুরীর তার কর্মচারী মো. আজমকে দিয়ে এলাকার তিনজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা চেষ্টার মামলা করেছিলেন। এ মামলায় পাঁচ বছর পর তথ্য প্রমাণ না পেয়ে ২০২০ সালে বেকসুর খালাস পেয়েছেন বলে জানান। 

এছাড়া অন্য সওদাগরেরা পাড়ার লোকজনের বাগান ক্রয় করতে আসলেও ব্যক্তিগতভাবে পাহাড় কেটে ১৫ কিলোমিটার করা রাস্তায় কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে পাড়ার মানুষ অন্য কোনো সওদাগরের কাছে গাছ বিক্রি করতে পারেন না।

পুরাতন দেওয়ান পাড়ার কার্বারী চংরেং ম্রো বলেন, ১৩টি পাড়ার লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন মেরশেদ আলম চৌধুরী। তার নেতৃত্বে শ্রমিক বাহিনী বনের গাছ তো কাটছেই পাড়ার লোকজনের সৃজিত সেগুন, গামারি গাছ অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করতে দিচ্ছেন না। বাজার মূল্যের চাইতে অর্ধেক মূল্যে মোরশেদ বাহিনীর কাছে গাছ বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়।

লাংগি পাড়ার মাংচোম ম্রো বলেন, প্রতিবছর এই মৌজায় কোনো না কোনো পাহাড় থেকে বনের গাছ কেটে নিয়ে যায়। বন বিভাগ এক পাহাড়ের গাছ কাটা বন্ধ করলে অন্য পাহাড়ের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এ বছরও তিন মাস ধরে প্রাকৃতিক বনের গাছ কেটে হাতি দিয়ে পাচার করে আসছেন মোরশেদ আলম চৌধুরীর শ্রমিকরা।

সরই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মেনওয়াই ম্রো বলেন, তিন মাস আগে মোরশেদ আলম তার বাগানের গাছ কাটবে বলে লোকজন নিয়ে গেছে। পরে জেনেছি বনের বিভিন্ন গাছ কেটে হাতি দিয়ে পাচার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মৌজার হেডম্যানকে বলা হলেও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

লেমু পালং মৌজার হেডম্যান কাইং ওয়াই ম্রো বলেন, মোরশেদ আলম চৌধুরী হুমকি দিয়ে বলেছেন তিনি নাকি তার মৃত বাবা হেডম্যান থাকাকালীন মৌজার বন ক্রয় করেছিলেন। সেজন্য আগামী ত্রিশ বছর গাছ কাটবেন। বিক্রয়ের লিখিত প্রমাণ দেখাতে বললেও তিনি দেখাতে পারেননি।

এদিকে, পাহাড়ি অঞ্চলের একমাত্র পানির উৎস ঝিরি। হাতির মলমূত্রে দূষিত হচ্ছে ঝিরির পানি। ঝিরি পানি খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়েছেন। 

লাংগি পাড়ার মেনচং ম্রো বলেন, পালং খালের সাথে সংযুক্ত শীল ঝিরি, লেমু ঝিরিসহ ছোট বড় ছয়টি ঝিরি রয়েছে। এইসব ঝিরির পানি দিয়েই আশপাশের ১৩ টি পাড়া লোকজন বেঁচে আছে। অথচ গাছ টানার হাতির মলমূত্র ঝিরির পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এ পানি ব্যবহার করায় গত সাপ্তাহ পাড়ার কয়েকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। ঝিরিতে গোসল করলেও শরীর চুলকায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাড়ায় পানি বাহিত রোগ মহামারি আকারে ধারণ করবে। 

বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এলাকাটি দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা কঠিন। তারপরও লেমুপালং মৌজা এলাকায় যদি পরিবেশ ধ্বংস করার প্রমাণ পেলে তাহলে দোষীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, 'যে গাছগুলো আপনারা দেখেছেন সেগুলো আমার নয়, আমার হাতিও নেই। বৈধভাবে জোতপারমিট করে গাছের ব্যবসা করছি।' 

লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আরিফুল হক বেলাল জানান, বন উজার করে হাতি দিয়ে গাছ পাচার করা সম্পর্কে জানেন না। এই প্রথম শুনেছেন। লেমুপালং মৌজা এলাকায় বন বিভাগ থেকে বনের গাছ কাটার জন্য কোনো জোতপারমিট দেওয়া হয়নি। গত বছর অভিযান পরিচালনা করে বনের গাছ জব্দ করে তার (মোরশেদ আলম চৌধুরী) বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। আবার ওইসব এলাকায় লামা বনবিভাগ থেকে অতি দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

চাইমং/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়