আশায় আশায় ৩ শিক্ষকের ২০ বছর পার
রাজবাড়ী সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
বাঁ থেকে-রফিকুন্নবী চৌধুরি, সিদ্ধিরাম ঘোষ ও তপন বিশ্বাস
কলেজ এমপিও হবে, বেতন পাবেন। সংসার হবে, স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করবেন- এ আশায় রফিকুন্নবী চৌধুরি ২০ বছর বিনা বেতনে চাকরি করেছেন পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে। পরিবারের উপর নির্ভরশীল থেকেছেন। আয়-রোজগারের বিকল্প পথ না থাকায় বিয়েটাও করতে পারেননি। তার বয়স এখন ৪৭ বছর।
কলেজ এমপিও হয়েছে কিন্তু তিনি এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এখন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছেন। বাড়ির গাছপালা বিক্রি করে এবং জমি লিজ দিয়ে কোনোমতে চলছেন।
রফিকুন্নবী চৌধুরি পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের বহলাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। একই কলেজের আরও দুজন শিক্ষক ২০ বছর বিনা বেতনে চাকরি করলেও এমপিও হয়নি।
সবারই অভিযোগ অধ্যক্ষের কারণে তাদের পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
জানা গেছে, পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। কারিগরি শাখা এমপিও হয় ২০০৪ সালে এবং সাধারণ শাখা এমপিও হয় ২০২২ সালে। বর্তমানে কলেজের ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৩০০। শিক্ষক রয়েছেন ২১ জন।
রফিকুন্নবী চৌধুরি জানান, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি তিনি পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রয়াত আব্দুল ওহাব তাকে নিয়োগ দেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনা বেতনে চাকরি করেন। করোনার কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। সেটাও তিনি করেছেন। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই তিনি কলেজে গেলে অধ্যক্ষ তাকে কলেজে আসতে নিষেধ করেন। কিন্তু কলেজ থেকে কোনো অব্যাহতি পত্র বা কোনো কাগজ দেয়নি। ২০২২ সালের ২৫ জুলাই তারিখে পাংশা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। মামলাটি এখনও চলমান। এর মধ্যে জানতে পারেন স্বর্ণালী খাতুন নামে একজনকে ইংরেজি শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একজন পদে থাকতে আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান নেই।
তিনি জানান, এমপিও হবে এ আশায় ২০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের উপর নির্ভরশীল থেকেছেন। আয়-রোজগার না থাকায় বিয়েটাই করতে পারেননি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর এখন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছেন। বাড়ির গাছপালা বিক্রি করে এবং জমি লীজ দিয়ে কোনোমতে চলছেন। অধ্যক্ষের কারণে তার পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
পাংশা কলেজপাড়ার বাসিন্দা তপন বিশ্বাস জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে অনার্স মাস্টার্স পাশ করেছেন। ২০০৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে চাকরি করছিলেন। ২০২২ সালে কলেজ এমপিও হলেও তার এমপিও হয়নি। এমপিওর জন্য দুই তিনবার ফাইল পাঠানো হলেও তা ফিরে আসে। সম্পূর্ণ বিনা বেতনে কলেজে চাকরি করেছেন। কিন্তু এমপিওতে তার কাঙ্খিত যোগ্যতার অভাব দেখানো হয়। তিনি কমার্সের ছাত্র হিসেবে অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভুগোলের শিক্ষক ছিলেন। অথচ বলা হয়, তিনি ওই বিষয়ের মধ্যে পড়েন না। তার যোগ্যতার অভাব। তাকে নিয়োগ দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তার যোগ্যতা আছে কীনা এটা কলেজই বলে দেবে। তার এমপিও না হওয়ার পরও এক বছর গিয়েছেন। শুধু এ বছরই যাননি। বিষয়টি নিয়ে তিনি ২০১৬ সালে মামলাও করেছিলেন। মামলাটি অনেক দূর এগিয়েছিল। তৎকালীন এমপি জিল্লুল হাকিম তাকে মামলা তুলে নিতে বলায় মামলাটি তুলে নিয়েছেন। তার বর্তমান বয়স ৫৮ বছর। আশায় ছিলেন একদিন এমপিও হবে। তার চাকরিও এমপিও হবে। কিন্তু অধ্যক্ষ নিজের পছন্দমতো লোক নিয়োগ করেন। তার কারসাজির কারণেই এমপিও হয়নি। ছাত্রাবস্থায় হোমিও পড়েছিলেন। এখন নিজ বাসাতেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে সংসার চালান। পরিবারে স্ত্রী আর দুই ছেলে রয়েছে। ছেলেদের অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
নারায়ণপুর গ্রামের সিদ্ধিরাম ঘোষ জানান, ১৯৯৯ সালে ৩৪ বছর বয়সে তিনি পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে যোগ দেন। ২০২৩ সাল পর্যন্ত চাকরি করেছেন আইসিটি বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় তার শশুর পরিমল কুমার দে চার লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। তিনি কলেজে ২০ বছর চাকরি করলেও কোনোদিন বেতন পাননি। আইসিটি বিষয়ে সার্টিফিকেট না থাকায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কম্পিউটারে এমএ করেন। কারিগরি ভর্তি হয়ে ডিপ্লোমা করেন। অধ্যক্ষ তার বিপক্ষে কাজ করে এমপিও করেননি। তার স্ত্রী একটি কলেজে চাকরি করতেন। মূলত স্ত্রীর আয়েই চলেছে সংসার। এক ছেলে, এক মেয়েকে পড়াশোনা করাতে হয়েছে অনেক কষ্ট করে।
এ বিষয়ে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান বলেন, সিদ্ধিরাম ঘোষের সার্টিফিকেট যাচাইতে দেখা গেছে সেটি ভুয়া। তপন বিশ্বাসকে অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভুগোল বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ওই পদে ছিলেন জিয়াউর রহমান নামে একজন। কলেজের একটা মামলা হয়। ওই মামলা চালাতেন তপন বিশ্বাসের ভাই স্বপন বিশ্বাস। স্বপন বিশ্বাসের সুপারিশে তার ভাইকে কলেজে নিতে বললে নেওয়া হয়। পরে অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভুগোল বিষয় বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। তখন তাড়াতাড়ি নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আবেদন করতে বলেন। তারা কলেজ থেকে তপন বিশ্বাসের নাম দিয়েই পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হয়নি। সরকারি নীতিমালায় না থাকায় তার এমপিও হয়নি।
তিনি আরও জানান, ইংরেজি শিক্ষক পদ শূন্য। রফিকুন্নবি কখনই নিয়োগ পাননি। তাকে ইংরেজি বিষয়ে পড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। নিবন্ধন পাশ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি নিবন্ধন পরীক্ষাই দেননি।
মামলা চলাকালীন আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়া যায় কীনা এমন প্রশ্নের জবাবে জানান, নিয়োগ দেওয়া যায়। এটা নীতিমালায় আছে।
২০ বছর চাকরি করার পর এমপিও না দেওয়াটা অমানবিক কীনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, “ওরা এমনিই আসছে। বেগার খাটছে। ৩ শিক্ষকের এমপিও না হওয়ার পেছনে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ শিক্ষকরা করেছেন তা সম্পূর্ণ অসত্য।”
কলেজের ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি ও পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আবু দারদা বলেন, “তিনি পাংশায় সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। বিষয়টা সম্পর্কে অবগত নন। খোঁজ নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।”
ঢাকা/রবিউল/টিপু