ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জীবন গঠনে পরিবার, শিক্ষক ও ছাত্রের ভূমিকা

ডা. মো. নাজমুল হক মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৩, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবন গঠনে পরিবার, শিক্ষক ও ছাত্রের ভূমিকা

ডা. মো. নাজমুল হক মাসুম : প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছে পিতা-মাতা, অভিভাবক ও শিক্ষকের প্রত্যাশা, ছাত্রটি একজন মানুষের মতো মানুষ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, স্বনির্ভর হবে। তারপর সে সৎ মানুষ হবে, দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং স্বনির্ভর উন্নত, আত্ম-মর্যাদাশীল ও মানবিক বাংলাদেশ গঠন করবে।

কতিপয় ছাত্র-ছাত্রী নিজেরাও মানুষের মতো মানুষ হতে চায়। তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক কিংবা সমাজের অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত থেকে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। কিন্তু এই যে চাওয়া এবং নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে লক্ষ্য স্থলে পৌঁছতে হলে তাকে অনেক বন্ধুর পথ পারি দিতে হয়। চলার পথ মোটেও মসৃণ নয়- অনেক বাধা বিপত্তিতে পড়তে হয় তাকে। চলার পথে কখনো ব্যর্থতা আসবে, কখনো সফলতা-এটাই স্বাভাবিক। অনেক সময়ই আমরা ব্যর্থতা আসলে ভেঙ্গে পড়ি, সামনে আগানোর স্পৃহা হারিয়ে ফেলি কিন্তু যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে বারে বারে চেষ্টা করে, ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে, নতুন উদ্যোমে, নতুনভাবে কর্মে মনোনিবেশ করে, দুঃখ-কষ্ট, ঘাত-প্রতিঘাত যাদেরকে পেছনে ফেলতে পারে না, তারাই সামনে এগিয়ে যায়, লক্ষ্য স্থলে পৌঁছে সফলতার স্বাদ পায়। মনে রাখতে হবে, সফল হবার পথ মোটেও মসৃণ নয়। যে যত বেশি সফল, তাকে তত বেশি দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়।

স্কুল জীবনে ছাত্র-ছাত্রীরা থাকে প্রাণচঞ্চল, উদ্যমী তাদের মন থাকে নরম-কাদামাটির মতো। তারা যেমন অনেক ভাল কিছু করতে পারে আবার অনেক সময় ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। ছাত্রদেরকে সঠিক নির্দেশনা দেয়া প্রতিটি শিক্ষক, পিতা-মাতা ও অভিভাবকের পবিত্র দায়িত্ব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে- মাদকদ্রব্য, স্মার্ট মোবাইল, স্কুল-কলেজে পর্যাপ্ত খেলাধুলা কিংবা সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব রয়েছে। পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, খারাপ সঙ্গ, পিতা-মাতা কিংবা গুরুজনদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং দুর্নীতি ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা ছাত্রদেরকে ভুল পথে ধাবিত করে।

পরিবার, শিক্ষক ও পিতা-মাতাকে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে, তাদেরকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। সবসময় বকাঝকা বা তিরস্কার করা যাবে না। পাঠদানের সময় খেয়াল করতে হবে তার শিক্ষাটা যেন আনন্দের মধ্যে হয়। তাকে বোঝাতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে, তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা যেন নিজকে একাকী মনে না করতে পারে এই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ছাত্র-ছাত্রীরা যদি পড়াশুনায় আনন্দ না পায়, শিক্ষক কিংবা পিতা-মাতার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, ভয় পায়, তার মনের কথা খুলে বলতে না পারে সেক্ষেত্রে তারা বিকল্প পথ খোঁজে- নিজকে গুটিয়ে রাখে, অন্য কোনোভাবে সুখ শান্তি পেতে চায়, অন্যকে আপণ করতে চায় আর ভুল পথে পা বাড়ায়। মাদকাসক্ত হয়ে পরে, স্মার্ট মোবাইল ফোন, ফেসবুক কিংবা কম্পিউটারে খারাপ ছবি দেখে এবং নিজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে প্রযুক্তির যেমন অনেক ভালো দিক রয়েছে, তেমনি অনেক খারাপ দিকও। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছাত্ররা যেমন অতি সহজে অনেক কিছু শিখতে পারে, জানতে পারে আবার খারাপ আসক্তিতেও পড়তে পারে এ ব্যাপারে পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের খুবই সতর্ক হতে হবে।

মাদকাসক্তের কুফল সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। এতে যেমন স্বাস্থ্যহানী হয়, ফুসফুস, পাকস্থলী, লিভারে ক্যান্সার হয়, নৈতিক চারিত্রিক স্খলন হয়, অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে। মিথ্যা বলা, চুরি করা থেকে শুরু করে সব রকমের অপরাধের দিকে ধাবিত করে এ মাদক। সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে বিপর্যয় নিয়ে আসে। প্রাথমিক অবস্থায় মাদকের খরচ যোগাতে এবং পরবর্তীতে মাদকের জন্য শরীরে যে বিভিন্ন রোগ বাসা বাধে তার চিকিৎসার খরচ চালাতে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, পরিবার নিঃস্ব হয়। এভাবে মাদকাসক্ত ছাত্রটি নিজের অপার সম্ভাবনায় জীবনকে ধ্বংস করে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝাতে পরিণত হয়।

বয়ঃসন্ধিকালে ছাত্র-ছাত্রীরা থাকে আবেগপ্রবণ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি থাকে তাদের নানাবিধ কৌতুহল ও আকর্ষণ। আজকাল বাচ্চাদের হাতের নাগালে স্মার্টফোন, গুগল, ফেসবুক, বিভিন্ন খারাপ ওয়েবসাইট। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অপরিণত বয়সে খারাপ ছবি, সিনেমা, সিরিয়াল বা খারাপ সঙ্গ তাকে পড়াশুনা থেকে বিরত রাখে এবং ভুল পথে ধাবিত করে। ছোট ছেলে-মেয়েদের মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার সীমিত করতে হবে এবং অভিভাবকদের তদারকি করতে হবে, যেন তারা প্রযুক্তির ভালো দিকটা নেয়- খারাপ দিক সম্পর্কে তাদের সতর্ক করতে হবে, নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে।

ভালো মানুষ হতে হলে তাকে অবশ্যই লক্ষ্য স্থির করে নিরলস পরিশ্রম করতে হবে। জীবন গঠনে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা, ধর্মীয় চর্চা অতীব জরুরি। ধর্ম প্রতিটি মানুষকে মানবিক হতে শেখায়-খারাপ কাজ, মিথ্যে বলা, কাউকে ঠকানো, প্রতারণা করা থেকে বিরত রাখে। আসলে সত্যি বলতে কি- ধর্মীয় শিক্ষাই আমাদের সকল শিক্ষার পূর্ণতা দেয়। সৃষ্টিকর্তার ভয় আমাদেরকে খারাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।

লক্ষ্য স্থলে পৌঁছাতে হলে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে যারা ভাল করেছে, জীবনে সফল হয়েছে, তাদের জীবন দর্শন পড়তে হবে। নিজকে ক্ষুদ্রতার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সারা বিশ্বের ছাত্ররা কী করছে, কীভাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করছে, কি কি করছে, কীভাবে জ্ঞান অর্জন করছে, কতক্ষণ তারা পড়াশুনা করে, খেলাধুলা করে, সাংস্কৃতিক চর্চা ও ধর্মীয় চর্চা করে তার খোঁজ খবর নিয়ে নিজেকে তৈরি করতে হবে। নিজের সুস্থতার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে সুস্থতার অধিকারী ছাত্রটিই হতে পারে ভবিষ্যৎ সুনাগরিক।

আমি মনে করি সুনাগরিক গঠনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা যখন পিতা-মাতা হই তখন আমাদের চরিত্রেরও পরিবর্তন আনতে হবে- আমাদের সন্তানদের মন থাকে কাদামাটির মতো। পিতা-মাতা সৎ, চরিত্রবান না হয়ে যদি সন্তানদের বলি ভালো হতে, তখন কখনো তারা পিতা-মাতার কথা শুনবে না। সন্তানকে যেমন আদর করতে হবে, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত আদর যেন সন্তানের ক্ষতির কারণ হয়ে না দাড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদেরকে পড়াশুনার পাশাপাশি, খেলাধুলা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় খারাপ করলে তাকে গালি না দিয়ে উৎসাহ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেকোনো ব্যর্থতাই মানুষকে বিপর্যস্ত করে, এ সময় তার নির্ভরতার স্থান পিতা-মাতা ও শিক্ষক। এমতাবস্থায় তাদেরকে নিরুৎসাহিত না করে উৎসাহ যোগাতে হবে, পাশে দাঁড়াতে হবে। পিতা-মাতা, শিক্ষক ও ছাত্রের নিরলস পরিশ্রমই পারে তাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারী), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।


রাইজিংবিডি/ঢামেক/১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ডা. মো. নাজমুল হক মাসুম/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়