ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নো ভ্যাট অন এডুকেশন

ফারুক আহমাদ আরিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নো ভ্যাট অন এডুকেশন

বিশ্বের নানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি

ফারুক আহমাদ আরিফ: পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকাটাই বড় আন্দোলন এবং যুদ্ধ।  সৃষ্টির শুরু থেকেই বেঁচে থাকার এই লড়াই যেন অবধারিত।

আমাদের আলোচ্য বিষয় 'নো ভ্যাট অন এডুকেশন' আন্দোলন। ‘২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের যাবতীয় লেনদেনের উপর ১০ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) আরোপের প্রস্তাব করা হয়।  পরবর্তী সময়ে ২৯ জুন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে সেটি ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ধার্য করে অর্থবিল ২০১৫-১৬ জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং প্রজ্ঞাপন জারির প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের সূত্রপাত।

আমরা শিক্ষার্থী সমাজ ৭ জুন থেকে শিক্ষাখাতে ভ্যাট প্রত্যাহারের আন্দোলন শুরু করি। কেউ স্বউদ্যোগে, কেউ সাংগঠনিকভাবে, কেউবা বিবেকতাড়িত হয়ে নানাভাবে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়।  এই ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট সব শিক্ষার্থী দিতে পারবে না- বিষয়টি এমন ছিল না বরং শিক্ষাকে বাণিজ্যিক করার হাত থেকে রক্ষা করতেই আন্দোলন।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র: (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন‌্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, গ. আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।  অর্থাৎ সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে তুলে আনা হয়েছে।  শিক্ষা হচ্ছে মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। 

৩০ জুন ইউল্যাবের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহান হাবিবকে প্রধান সমন্বয়ক করে ধানমন্ডিতে 'নো ভ্যাট অন এডুকেশন' প্ল‌্যাটফর্মের যাত্রা শুরু। ১৬ আগস্ট তিনি আন্দোলন ছেড়ে চলে গেলে সেইদিন সন্ধ্যা হতে সমন্বয়করা আমাকে প্রধান সমন্বয়ক নির্বাচন করে।  তবে প্রধান সমন্বয়ক শব্দটি ব্যবহার না করে সেটিকে মুখপাত্র এবং অন্য সমন্বয়কদের সংগঠক বলে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত হয়।

প্রাচীনকাল থেকেই একটি কথা মানুষের মগজে গেথে ছিল যে, আন্দোলন অর্থই হচ্ছে হাঙ্গামা-ভাংচুর, রক্তঝরা, প্রাণদান। আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলাম।  সেই মোতাবেক কাজও করতে হয়েছে।  বিষয়টি মোটেও সহজ ছিল না।

আগুনের উপর দিয়ে নিরাপদে হেটে যাওয়া যতটা অসাধ্য তার চেয়েও কঠিন বাস্তবতা ছিল আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখা। কেননা তখন বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ ছিল উত্তপ্ত। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলো দাঙ্গা, হাঙ্গামা, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, অরাজকতা সৃষ্টি, শিক্ষকসমাজের বেতন স্কেল নিয়ে ক্লাস বিরতি দিয়ে আন্দোলনে দেশের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত! বিশ্বরাজনীতিও সুখকর ছিল না। বিশ্বের নানা প্রান্তেই ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলনরতদের উপর নির্যাতন, নিষ্পেষণ চলছিল। 

আমরা সংঘর্ষের পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে মনযোগ দিলাম।  কর্মীদের শান্তিপূর্ণ রাখা ছিল কঠিন কেননা, সবাই জানত আন্দোলন অর্থই গাড়ি-বাড়ি ভাঙা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন, মানুষকে জিম্মি করা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো ইত্যাদি।

আমরা শান্তিপূর্ণ থাকলেও রাষ্ট্র আমাদের প্রতি শান্তিদায়ক ছিল না। ২৯ জুন গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ, ২২ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচিতে পুলিশের কাটাতারের বেড়িগেট, ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ভবনে স্মালকলিপি দেয়ার কর্মসূচিতে কাটাতারের বেড়িগেট, ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পদযাত্রায় রক্ত ঝরানো, ৯ সেপ্টেম্বর ইস্ট ওয়েস্টের মানববন্ধনে পুলিশের গুলি করাসহ প্রতিটি পদে আমাদেরকে আক্রমণ, নির্যাতন, নিষ্পেষণ করে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও আমরা সাংঘর্ষিক পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখি।  যে ব্যক্তি কোনো একটি খেলার অধিনায়কত্ব করেছেন তিনিই বোঝেন প্রতিটি খেলোয়াড়কে শান্তিপূর্ণ রেখে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করা কতটা কঠিন।

যাই হোক, সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখা সম্ভব হয়। ১০ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ৫ দিন সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে সড়ক অবরুদ্ধ করে শুধু স্লোগান দিয়ে আন্দোলন করতে থাকি ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে।

১৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দেন আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলো, শিক্ষাখাতে কোন ভ্যাট দিতে হবে না।  দুপুরে  সিদ্ধান্তের এই খবরটি আমাদের আনন্দিত করে তোলে।  আমরা রাজপথ ছেড়ে ক্লাসে ফিরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে।  দীর্ঘ সাড়ে ৪ মাসের দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, গ্লানি নিমিষেই আনন্দে ভরে উঠে।

স্টেট ইউনিভার্সিটির বাশার, মারুফ, সকাল, অনির্বাণ, যুমানা, তানভীর, হাকিম মাহি, সাহাব, জুয়েল, তুষার, ইউআউইউ’র মাহফুজুর রহমান নাঈম, মেজবাহ, আতিক, স্টামফোর্ডের আরিফ চৌধুরী শুভ, জ্যোতির্ময়, সজীব, ইউল্যাবের ফারহান হাবিব, জাহিন, গগণ, ডেফোডিলের আয়াজ খান, বনানীর তানিম, অনি, সজীব, ইস্ট ওয়েস্টের অপু, কাকন, সানী, ইউআইটিএসে অনি, উজ্জ্বল, চট্টগ্রামে এস এম রায়হান ওয়াজেদ চৌধুরী, শিমুল গুপ্ত, আলিনুর, আকাশ, রাজশাহীতে তামিম, জুয়েল, সিলেটের মিজান, দেবপ্রিয় পাল, ফাহিম, সাকিব, আশফাকুর রহমান তামিম, ইয়ামিন বক্স, নকিব চৌধুরী, বেলায়েত খাঁন, দেবাশিষ দেব, রেদওয়ান আহমেদ, আতিক রহমান, মেহেদী সেতু, মাইদুল আলম সিদ্দিক বাপ্পি, সুস্মিতা রয় প্রপা, জীবন তালুকদার, পাইলট মিজান, জনি, ইথার, শুভ, ইভা, তাসমিয়া তাবাসসুম ইশা, সৈয়দা তানিয়া, ইফতেকার, রবিন, সুমন, তানিম, নাজমুল, রনির  উত্তরায় সাকলাইন, সৌরভ, আশিকুর, অনিক, মেহেদী, শাওন, বাতেন, সুমন, অরুনাক, আশার সাদ্দাম, ব্র্যাকের অনি, রেজওয়ান, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশ, মাহফুজা, কৌশিকের কেন্দ্রীয় দক্ষ নেতৃত্ব। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষানুরাগী, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ মানুষের সহযোগিতা-সমর্থনে আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে।

আজ ১৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটমুক্ত শিক্ষা দিবস ও আন্দোলনের চার বছর পূর্তি।  আন্দোলনের ফলে যারা কষ্ট স্বীকার করেছেন সকলের প্রতি অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: মুখপাত্র (প্রধান সমন্বয়ক) নো ভ্যাট অন এডুকেশন। ([email protected])


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ফারুক আহমাদ আরিফ/হাকিম মাহি/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়