ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রিকশাচালক স্বপ্ন দেখছেন বিসিএসের

মো. আজম খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রিকশাচালক স্বপ্ন দেখছেন বিসিএসের

জীবনে সফল হতে গেলে প্রয়োজন স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস, ইচ্ছেশক্তি এবং নিজের অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া। যারা এই চারটি কাজ করতে পারেন, তারাই প্রকৃতপক্ষে সফল। যারা এগুলো পারেন না, তারা তলিয়ে যান ব্যর্থতার অতল সাগরে।

স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস, ইচ্ছে শক্তি এবং নিজের অতীত থেকে শিক্ষা-এই চার নিয়ে সফল হয়েছেন পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। পৌঁছে গেছেন সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায়। আর সেই রকমই একজন মানুষ হলেন আব্দুস শাকুর। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন। স্বপ্ন দেখছেন বিসিএস ক্যাডার হবেন।

আব্দুস শাকুর, যাকে বলতে হবে জীবন যুদ্ধের একজন লড়াকু সৈনিক। তিনি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক খবির হাওলাদারের ছেলে। ছয় ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সে। খুব ছোট বেলায় হারিয়ে ছিলেন মাকে। ফলে, তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। একদিকে পরিবারের দারিদ্র‌্যতা, আর অন‌্যদিকে দ্বিতীয় মায়ের সংসারে ভালোভাবে লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেননি শাকুর। তাই প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষে জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবকিছু ছেড়ে নেমে পড়েন অর্থ উপার্জনের জন্য।

শাকুর শুরু করেন সোনালী শৈশবকে ত্যাগ করে রিকশা চালানো। আর এই রিকশা চালাতে চালাতেই পরিচয় হয় মৌলভী মোহাম্মদ নূর হোসেন মুন্সির সাথে। তিনি একজন আল্লাহ প্রেমিক লোক ছিলেন। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল ও ইসলামিক জলসায় যেতেন। তার আসা-যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলো শাকুরের রিকশা। এই আসা যাওয়ার মাধ্যমেই তার সাথে শাকুরের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি শাকুরকে তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় অষ্টম শেণিতে ভর্তি করে দেন এবং মাদ্রাসার এতিম খানায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। তার জীবন থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি হারিয়ে যায়। সেখানে তার থাকা খাওয়ার কোনো প্রকার খরচ লাগতো না। এভাবেই শুরু হয় তার নতুন জীবন। সেখান থেকেই শাকুরের বদলে যাওয়া শুরু।

এভাবে কিছুদিন পর তার সাথে পরিচয় হয় আরেকজন মানুষের সাথে, যিনি শাকুরের জীবনে আসেন একজন দূত হয়ে। তার নাম মনিরুল ইসলাম। তিনি অনার্স পড়ুয়া ছিলেন। মনিরুল ইসলামও ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বাবা মির্জাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের দেখাশোনার কাজ করতেন। তাই তার জন্য একটা রুম দেয়া হয়েছিল ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। সেই রুমে একা থাকতেন মনির। তার রুমের সঙ্গি হিসেবে থাকার জন্য শাকুরকে তার কাছে নেয়। কারণ, মাদ্রাসা আর ইউনিয়ন পরিষদ ছিল পাশাপাশি। মনিরুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি প্রথমে শাকুরকে সঙ্গী হিসেবে নিয়েছিলেন তার একা থাকতে ভয় করতো তাই।

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শাকুরের সাথে আমার পরিচয় ২০০৬ সাল থেকে। আমি একা থাকতে ভয় পেতাম, তাই শাকুরকে আমার কাছে নিয়ে আসি থাকার জন্য। ওই খাওয়া-দাওয়া মাদ্রাসার এতিমখানায় করতো এবং আমার সাথে রুমে থাকতো। ও রুমে বসে পড়তো, আর আমি ওকে কোনো সমস্যা হলে দেখিয়ে দিতাম। পরে অবশ্য আমি যখন প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি, সাথে ওকেও পড়াতাম।’

শাকুরকে সেখানে থাকা অবস্থায় লেখাপড়ায় সাহায্য করাসহ লেখাপড়া করতে উৎসাহিত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখাতেন মনির। আর এসব পেয়ে শাকুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। নিজের মধ্যে থাকা ইচ্ছেশক্তিকে জাগিয়ে তোলেন। ফলে, সকল প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ঘটকের আন্দুয়া সালেহিয়া ফাযিল মাদ্রাসা থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সে। যেটা এখনও পর্যন্ত তার মাদ্রাসার সেরা সাফল্য।

শাকুরের সম্পর্কে তার মাদ্রাসার গণিত শিক্ষক বলেন, ‘ওর মতো ছাত্র পাওয়াটা আমাদের জন্য গর্বের। ও এই মাদ্রাসার সবচাইতে মেধাবী ও প্রতিভাবান ছাত্র ছিলো। আমাদের মাদ্রাসার সকল শিক্ষক ওকে নিয়ে গর্ব করি। ও সফল হোক আমরা সবাই দোয়া করি।’

এরপর ভর্তি হয় নিজ উপজেলার সুবিদখালী সরকারি কলেজে। এখানে পড়া অবস্থায়ও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয় তাকে। কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতাই যেন তার ইচ্ছেশক্তি আর আত্মবিশ্বাসকে আটকাতে পারেনি। এইচএসসিতে ৪.৮০ পেয়ে উত্তীর্ণ শাকুর কলেজে ফাস্ট হয়।

তার এ বিষয়ে গ্রামের একজন ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শাকুর অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলে। ওর বাবা কৃষি কাজের পাশাপাশি রিকশা চালাতো আর দোকানদারি করতো। ওদের থাকার জন্য ভালো কোন ঘর নেই এখনও। ভাঙা ঘরে থাকে এখনও। এমন একটা সময় ছিলো ওরা খেতে পারতো না।’

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় চলে আসেন শাকুর। বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইউসিসি কোচিং এ ভর্তি হয়। এরপর ভর্তি পরীক্ষা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও তাকে ফরম তোলার টাকার জন্য বিভিন্ন জনের দ্বারস্থ হতে হয়। কিন্তু তাতে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয় সে। পরে ভর্তি হয় ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিভাগে। কিন্তু সে কিছুতেই তার স্বপ্নকে ভুলতে পারেননি। আবার প্রস্তুতি নেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। এবার সুযোগ পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির। অনেক কষ্ট করে অর্থ যোগাড় করে (চাষের জমি বিক্রি করে) ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে। এখানেও তাকে বাস্তবতার কঠিনতম বেড়াজালে শিকার হতে হয়। টিউশনের টাকা দিয়ে নিজের খরচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচসহ বিভিন্ন খরচ করে কিছু অর্থ জমাতে শুরু করে।

২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৩.৬৪ পেয়ে চতুর্থ স্থান অর্জন করে স্নাতক পাস করেন। ২০১৭ সালে একই বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৩.৭৫ পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর পাস করেন।

আর বর্তমানে তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য। তার স্বপ্ন এখন আকাশ ছোঁয়া। এই কঠিনতর পথ পাড়ি দিয়ে তিনি এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে! এভাবেই শাকুরেরা আশা বুনে সফলতার দেখা পাক। আর তাদের জয়ই আমাদের দেশের জয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ববি/মো. আজম খান/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়