ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

খুলনা বিশ্ববিদ‌্যালয়

রঙে-ঢঙে বিদায় উৎসব

এম আর আর তামিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রঙে-ঢঙে বিদায় উৎসব

যেখানে শেষ, সেখান থেকেই নতুন কিছুর শুরু ৷ তবুও শেষটা কাঁদিয়ে যায়, শেষবেলাটা সবার হৃদয়কে আবেগাপ্লুত করে তোলে। বেদনার নীল রঙে আচ্ছাদিত করে তোলে প্রাণ। শেষবেলাটা তাই রঙিন করে তুলতে কালার ফেস্টের আয়োজন। ট্রাক র‌্যালি থেকে নামতে না নামতেই কোথায় থেকে যেন আবিরের দমকা হাওয়া আমাদের রাঙিয়ে তুললো। কিছু বোঝার আগেই ছেলেদের গায়ের টি-শার্টটি উধাও হয়ে গেল। যেন বছরের তৃতীয় ঈদ নেমে এসেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বুকে।

বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ১৬ ব‌্যাচের বিদায় উপলক্ষে ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর তিন দিনব্যাপী র‌্যাগ ডের (শিক্ষা সমাপনী) আয়োজন করে একই ব‌্যাচের শিক্ষার্থীরা। এবারে তাদের স্লোগান ছিল ‘সহস্র প্রাণের প্রত্যয়ে স্মৃতির উল্লাসে’।

নিজেদের শেষ বেলায় নীড়ে ফেরা পাখি হয়ে নতুনদের জায়গা করে দিতেই 'সায়ন্তন' নাম ধারণ করে আয়োজক ব‌্যাচ। সাথে ‘অস্থির পিনিক’ ট্যাগলাইনে র‌্যাগ ডের পুরো সময়টা জুড়েই ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা। কাউন্টডাউন, পোস্টারিং, ডেকোরেশন, টি-শার্ট এতকিছুর মাঝে ঈদ ঈদ আমেজ আসতে বাধ্য।

বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তগুলোকে মনের পর্দায় অমলিন করে রাখতে সায়ন্তনদের নানা আয়োজন। শেষ বেলাকে বরণ করে নিতে সায়ন্তনদের নতুন দিগন্ত অন্বেষণের উৎসব সাঁঝবাতি। তিন দিনব্যাপী উৎসবের প্রতিটি দিনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ হয়েছিল। যেমন-সাড়ম্বর, সংকলন ও স্মৃতিপট। যেগুলো স্মৃতিতে চির সবুজ হয়ে থাকবে।

সায়ন্তনদের ভাষায়, ‘নানা রঙের নানা মানুষগুলো মিলে একদিন তৈরি হয়ে যায় একটা ব্যাচ। সেই নানা রঙে সাড়ম্বরের সাথে তৈরি হওয়া ব্যাচ, হাজারো গল্প-স্মৃতি সংকলনের মাধ্যমে কী করে যেন একটা নতুন অস্তিত্ব হয়ে যায়। আর জমানো সব গল্পকে স্মৃতিপটে ধারণ করে বেলা শেষে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে হয়।’

 

 

সাড়ম্বরের দিন সকালে নীল রঙের শাড়িতে বিদায়ী ব্যাচের ছাত্রীরা, আর ছাত্ররা সবচেয়ে পুরনো টি-শার্টটি গায়ে ক্যাম্পাসে হাজির; একটু পরেই যে আর টি-শার্টের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। শুধু র‌্যাগ ব্যাচই নয়, ক্যাম্পাসের জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও হাজির সিনিয়র ভাই-আপুদের এই উৎসবে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে।

সকাল ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন। তার পরপরই ২৮ টি ট্রাক ও ১১ টি বাস নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে পড়েন খুলনা শহরে ট্রাক র‌্যালিতে।

খুলনা মহানগরী ঘুরে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় 'কালার ফেস্ট'। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদী চত্বর, মুক্তমঞ্চ প্রাঙ্গন সাজে হরেক রকমের রঙের মেলায়। আবিরে মাখামাখি একেকজন। হাজার পাওয়ারের রঙের  ছোপ যেন বার বার মনে করিয়ে দিতে চায় চারটি বছরের স্মৃতিগুলো, যা চাইলেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। অনেকে মিলে একজনকে ঘাড়ে করে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই তাকে আবিষ্কার করা হয় কাদায় লুটোপুটি খেতে। এর সাথে ডিজে, হেড ব্যাং আর নাচানাচি তো আছেই। এরপর দলবেঁধে সবাইকে ( খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ হল সংলগ্ন) পুকুরে  যেতে দেখা যায়। বিকেলের আগে আগেই সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।

দ্বিতীয় দিন, ‘সংকলন’ এর শুরু হয় শিক্ষা সমাপনী উপলক্ষে আলোচনা সভা। প্রধান অতিথি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনের দিক তুলে ধরে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ডিসিপ্লিনের প্রতিনিধিত্বকারীর হাতে র‌্যাগ ব্যাচের ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।

বিকেল থেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলেও তা উৎসবের আমেজ একটুও কমাতে পারেনি । সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বৃষ্টিভেজা আমেজে উৎসবমুখর পরিবেশে কেটে যায় রাতটি।

 

 

স্মৃতিপট । উৎসবের শেষ দিন । কনসার্টের রাত। বৃষ্টির সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিকেল হতেই একে একে জড়ো হতে থাকে সবাই ক্যম্পাসের মুক্তমঞ্চ ঘিরে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন লোকে লোকারণ‌্য। দুপুর থেকেই কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। সন্ধ‌‌্যা নাগাদ পুরো খুলনাবাসীর ঢল নামে খুবি ক্যাম্পাসে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় মঞ্চে ওঠে জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের দল আর্ক।

এরপর একে একে আসে অর্ণব ও ওয়ারফেজ। দর্শক-শ্রোতা যেন উল্লাসে ফেটে পড়বে। একে একে সবাই তাঁদের জনপ্রিয় গান গেয়ে দর্শক মাতালেন। হেড ব্যাং দিতে দিতে সবার অবস্থা শোচনীয়, তবু থামার নাম নেই। হাসানের চারিদিকে উৎসব, সুইটি, যারে যা; অর্ণবের কাঠগোলাপ, সে যে বসে আছে, পুরনো সেই দিনের কথা; আর সবশেষে মেটাল ব্যান্ড ওয়ারফেজের অসামাজিক, পূর্ণতা, বসে আছি একা প্রভৃতি গানে  দর্শক যখন মাতোয়ারা, আকাশ তখন রঙিন আলোয় আলোকিত করে দিয়ে একের পর এক জ্বলে চলছে আতশবাজি। ড্রাম, গীটার, কী-বোর্ডের সুরতাল, রঙ-বেরঙের  আলোর খেলায় অর্ণবের হারিয়ে যাওয়ার মতো আত্মহারা  হবার উপক্রম।

আর সবকিছুর মতো ধীরে ধীরে এ উৎসবেরও বেলা শেষ হয়ে আসে। উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নিজেকে শক্ত প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টায় থাকা শিক্ষার্থীটিরও একসময় নোনাজলে চোখ ভিজে যায়। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ কারো হুহু করে কান্নার আওয়াজ ভেসে ওঠে। একে একে ১৬ ব্যাচের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চলার পথে চারটি বছরের সাথী ছিল যাঁরা, আর কি কখনও একসাথে পাশে দাঁড়াবেন তাঁরা?  কেউ জানেন না উত্তর। বুকভর্তি শূন্যতা নিয়েই ক্ষান্ত থাকেন সবাই।

খুবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান বলেন, ‘সবসময় খুবির র‌্যাগ ডের গল্প শুনে এসেছি। এবার প্রত্যক্ষভাবে উপভোগ করলাম। যতটা আশা করেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি মজা করেছি ব্যাচমেট আর সিনিয়রদের সাথে।’

চতুর্থ বর্ষের গণিত ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী আবির হাসান বলেন, 'আয়োজন সফল করার জন্য রাতের পর রাত জেগে কাজ করার সেই মুহূর্তগুলো কখনই ভুলবো না। বেশকিছু স্মৃতি, একরাশ ভালোবাসা আর বুকভর্তি বিয়োগান্তের শূন্যতা নিয়ে বিদায় নিচ্ছি।’

লেখক: শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ‌্যালয়।



খুবি/তামিম/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়