ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মায়ের পরে যার স্থান

চৈতি দাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১১, ৬ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মায়ের পরে যার স্থান

একজন মানুষের সফলতার পেছনে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন আদর্শ শিক্ষক কেবল পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, তিনি সকল ছাত্রছাত্রীকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেন, ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেন, আবার সাফল্যের দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেন। তিনি শুধু জীবনে সফল হওয়া নয়, কীভাবে একজন ভালো মানুষ হতে হয় তা শেখান।

আমি সৌভাগ্যবান যে আমার ছাত্রজীবনে বেশ কিছু শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করতে পেরেছি। তাদের মধ্যে এমন একজন শিক্ষক আছেন যিনি আমাকে ছোটবেলায় পড়ালেখায় খুব উৎসাহ দিয়েছেন, পাল্টে দিয়েছেন আমার জীবনের গতিপথ। হয়ে উঠেছেন আমার প্রেরণা, আমার প্রিয় শিক্ষক। সেই ছোটবেলায় যাকে নিয়ে ‘আমার প্রিয় শিক্ষক’ রচনা লিখতাম।

যখন আমি প্রিয় শিক্ষক নিয়ে রাইজিংবিডিতে কিছু লেখার সুযোগ পেলাম, তখন চোখ দুটো বন্ধ করলাম, মায়ের পর ভেসে আসে একটি হাসি মুখ। যেখানে জড়িয়ে আছে আদর আর ভালোবাসা। তিনি হলেন তারাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পিয়ারা বেগম।

অনেকেই তাঁকে ম‌্যাডাম বলেন, আমি তাঁকে আপা বলে ডাকি। আপা একদম আমার মায়ের মতো। তিনি আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। বাংলা ছিল আপার আলোচনার বিষয়। অনেক সময় রসহীন পাঠ্য বিষয়বস্তুকেও তিনি সুমধুর করে তুলতেন। তাঁর ক্লাসে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করত। তাঁর অসাধারণ বাচনভঙ্গি, বোঝানোর ক্ষমতা এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখত ছাত্রছাত্রীদের। আপা বাংলার সাথে আমার ক্ষীণ পরিচয়কে সুদৃঢ় করে তুললেন।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সবাই বলতো, আপা নাকি অনেক রাগী! কিন্তু আমার কাছে কখনই তেমনটা মনে হতো না। আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে উঠলাম, তখন আপার ক্লাস পেলাম। আপা সবাইকে ক্লাসের প্রথমদিন থেকে এক পৃষ্ঠা বাংলা লেখা বাড়ির কাজ দিতেন, যাতে করে সবার বাংলা লেখা সুন্দর হয়। আমার লেখা তখন ভীষণ খারাপ ছিল। ফলে, আমি সহজেই আপার নজরে পড়ে যাই। এরপর আপা আমাকে প্রথমে অক্ষরগুলো স্পষ্টভাবে লিখতে সাহায্য করেন। অল্প কয়েক দিনেই আমার হাতের লেখায় একটা পরিবর্তন এলো। আপাও খুব খুশি হলেন।

দেখতে দেখতে আমিও পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম। আপা তখনও আমাদের বাংলা ক্লাস পেলেন। পিএসসি পরীক্ষার জন্য আপা আমাদের সবার কাছ থেকে খুব কঠোরভাবে পড়া আদায় করতেন। আমি তখন পড়ালেখায় অনেক অমনোযোগী ছিলাম। ক্লাসে নিয়মিত পড়া দিতে পারতাম না।

আমাদের সময় বাংলা বইতে ‘তুলনা’ নামে একটি কবিতা ছিল। আপা আমাদের সবাইকে কবিতাটি পড়া দিয়েছিলেন। পরের দিন যথারীতি আপা সবার পড়া ধরেছিলেন। কিন্তু আমি সেদিন পড়াটা দিতে ব্যর্থ হই। এরপর থেকে আপা প্রায়ই আমার কাছ থেকে পড়া আদায় করতেন। কখনো পড়া ঠিকভাবে দিতে পারতাম, আবার কখনো পড়া দিতে পারতাম না। পড়া না পারলে আপা সবাইকে শাস্তি না দিয়ে বোঝাতেন।

আপা আমাদের বারবার বলতেন, ‘লক্ষ্য স্থির করো এবং তোমাদের লক্ষ্য সফল করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও’। তিনি আরো বলতেন, ‘সেই সবচেয়ে বড় নির্বোধ, যে জীবনে বড় হতে চায় কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ করে না।’ আপার এ কথাগুলো আমার এখনো মনে পড়ে। আমি যখনই কোনো কাজে হাল ছেড়ে দেই, তখনই আপার কথাগুলো মনে পড়ে। তখন আমার চেষ্টার পরিমাণটা আরো বেড়ে যায়। আমার জীবনে চলার পথে এ পর্যন্ত যতগুলো সাফল্য পেয়েছি, তাতে আপার অনেক ভূমিকা রয়েছে।

আপা চিরদিন আমার জীবনাকাশে আদর্শের মূর্ত তারকা হয়ে প্রজ্জ্বলিত থাকবেন। আমি গভীর শ্রদ্ধা ও পরম ভালোবাসায় স্রষ্টার কাছে আমার প্রিয় শিক্ষকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। আপার সাথে কাটানো স্কুলের সেই দিনগুলোর কথা এখনো খুব মনে পড়ে। ইচ্ছে করে ঠিক আগের দিনগুলোতে ফিরে যাই। দুই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছুটে যাই সেই বিদ্যালয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ (২য় বর্ষ), কবি নজরুল সরকারি কলেজ।

 

ঢাকা/চৈতি দাস/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়