ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

একজন পিন্টুর খোঁজে

হাকিম মাহি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একজন পিন্টুর খোঁজে

এক সন্ধ্যায় আমরা চিরচেনা জায়গায় স্যারের সাথে হাঁটছি। আজ স্যারের মন তেমন ভালো নেই, লক্ষ করছি। মনে হচ্ছে, তিনি কী যেন খুঁজছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি মন খারাপ, কিছু খুঁজছেন? বললেন, হুম খুঁজছি। পিন্টুকে। পিন্টু কে? এতদিন যাবৎ আপনার কাছে আসি এখানে, পিন্টু নামের কাউকে তো চিনি না। স্যার বললেন, সে এক বেদনায় ভরা স্মৃতিবিজড়িত গল্প।

পাঠক, প্রথমে আপনাদের সাথে স্যারকে পরিচিত করিয়ে দেই। তিনি হচ্ছেন, বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি প্রকৃতি ও প্রত্যেকটি প্রাণীকে নিজের মতো করে ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধা করেন। তিনি কখনো গাছকে গাছ বলেন না, বলেন বৃক্ষ। কুকুর-বিড়ালকে কুকুর-বিড়াল বলেন না, বরং আদর করে একটি সুন্দর নাম ধরে ডাকেন। যেমন, মা-বাবা তাদের সন্তানকে আদর করে প্রিয় নাম ধরে ডাকেন। স্যার প্রাণীকে এতটাই ভালোবাসেন যে, মাংস খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। 

স্যারের কাছে পিন্টুর কথা জিজ্ঞাসা করতেই চোখের কোণে শিশির বিন্দুর মতো জল এসে যায় তার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেন পিন্টুর কথা। গল্প শুনতে শুনতে ভেবেছিলাম, স্যারের কোনো পরম আত্মীয় হবেন তিনি। পিন্টু থাকতেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর ফুলার রোড শিক্ষক কলোনিতে। সে হিসেবে স্যার পিন্টুর প্রতিবেশী। প্রতিদিন দেখা হতো তাদের। কথার সাথে ভাববিনিময়ও হতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেউ কারো মুখের ভাষা বোঝেন না। তবে, তাদের দেখলে মনে হয়, একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা ভিন্ন ভাষার দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

পিন্টু ছোট থেকেই কলোনির বাচ্চাদের সাথে দুরন্তপনায় ভারী পটু। প্রতিদিন বিকেলে সবার সাথে ক্রিকেট, ফুটবল, কানামাছি এবং লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত থাকেন। তাই এলাকার সব ছোটছোট ছেলে-মেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের সাথে দারুণ সম্পর্ক করে ফেলেছেন। বাচ্চাদের বন্ধু বলে কথা। কোনোদিন পিন্টুকে না দেখলে সবাই পিন্টু, পিন্টু বলে সারা কলোনি মাতিয়ে তোলেন।

পিন্টু যদিও ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন, কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পেতে খাবার চেয়ে খাননি। তিনি তার পাঠ শেখার পাশাপাশি কলোনির গেটে নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন। রাত-দিনের যেকোনো সময় কেউ আসলে তাকে অভিবাদন জানিয়ে তার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন। বিনিময়ে কলোনির সবাই যেমন তাকে ভালোবাসত, তেমনি কাজের বিনিময়ে পেটপুরে খাবার দিত। পিন্টু বাচ্চাদের মতো সে খাবার কুটকুট করে খেতো। মাঝে মাঝে স্যার টিভিতে টকশো/প্রোগ্রাম শেষ করে আসার সময় প্রিয় পিন্টুর জন্য এটা-সেটা নিয়ে আসতেন। যেমনভাবে বাবা তার সন্তানের জন্য প্রিয় খাবার নিয়ে আসেন।

গতবছর হঠাৎ পিন্টুর সারা গায়ে ছোট ছোট গোটার মতো কী যেন দেখা দেয়। পিন্টু কথা বলতে না পারলেও তার গায়ের অবস্থা সবাইকে পীড়া দেয়। কলোনির সবাই তাকে ভালো চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করেন। সকাল-বিকেল সবাই পিন্টুর খোঁজ-খবর রাখেন। কিছুদিন পিন্টুর চিকিৎসা চললে একটু ভালো হন পিন্টু। কিন্তু ভালো হওয়ার কয়েক দিন পর আবার সেই গোটা ঘাঁয়ে পরিণত হয়। এবার ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে, পিন্টুর জটিল রোগ হয়েছে। শরীরে ঘাঁ বাড়ছে। পিন্টুকে আর বাঁচানো যাবে না।

এ কথা শুনে স্যার মর্মাহত। সারাক্ষণ শুধু পিন্টুকে নিয়েই ভাবেন। পিন্টু আর আগের মতো এলাকার ছেলে-মেয়েদের সাথে আড্ডা দেন না, খেলতে যান না। শুধু ঝিম মেরে গেটের এককোণে বসে থাকেন। আর কেউ আসলে গলা উঁচু করে, লেজ নাড়িয়ে তাকে কুর্নিশ করেন। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের আনন্দ দেখে ঘেউ ঘেউ করে তাদের আনন্দে ভাগ বসান। যেন বলতে চান, হে আমার প্রিয় খেলার সাথীরা, আমি বাঁচতে চাই। আমি মরতে চাই না। আমি আবার তোমাদের মাঝে থাকতে চাই।

একদিন বিকেলে পিন্টুর সাথে স্যারের দেখা। স্যার ব্যথিত নয়নে পিন্টুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পিন্টুও তার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকলেন। কী যেন নীরব ভাষায় তাদের মাঝে কথা হলো। স্যার বিদায় নিলেন। পরদিন সকাল থেকে আর পিন্টুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অনেক দিন হয়ে গেল। হয়তো দূরে কোথাও গিয়ে নিজের ঘাঁয়ে ভরা দুর্গন্ধযুক্ত শরীর নিয়ে পড়ে আছেন। তিনি চাননি তার জন্য তার প্রিয় মানুষগুলো কষ্ট পাক। পিন্টু ছিলেন রোবায়েত ফেরদৌস স্যারের কলোনির কুকুর। একটি প্রাণী যে মানুষের কতটা আপন হতে পারে, পিন্টু তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজও ফুলার রোডের সবাই পিন্টুর ফিরে আসার পথপানে চেয়ে আছেন ...।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।


এসইউবি/হাকিম মাহি/রফিক   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়