ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ফেসবুক বদলে দিচ্ছে ক‌্যাম্পাস জীবন

সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০২, ১১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফেসবুক বদলে দিচ্ছে ক‌্যাম্পাস জীবন

আড্ডায় শিক্ষার্থীরা

বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে, পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার যেমন শিক্ষার্থীদেরকে উপকৃত করছে, তেমনি অপব্যবহার তাদের ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার জগতে।

তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মতো অসংখ্য সামাজিক মাধ্যমে দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করছেন তরুণ প্রজন্ম। লেখাপড়াসহ এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বাদ দিয়ে তারা মূল্যবান সময় এসব মাধ্যমে বেশি ব্যয় করছেন। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমাজে।

নিয়মিত পড়াশোনা করে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব কম সময় ব্যয় করেন তারা। এই কম সময়টুকুতে তারা বিভিন্ন শিক্ষামূলক পেইজ ও গ্রুপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। এর বাইরে বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকাতে সময় দেন এবং নিয়মিত ১২-১৫ ঘণ্টা সময় পড়াশোনাতেই ব্যয় করেন। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করে লেখাপড়াকে নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন এই শিক্ষার্থীরা। তবে নিয়মিত পড়াশোনা করেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি নয়।

এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার অধিক ব্যবহারকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা দিনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সময় সোশ্যাল মিডিয়াতেই কাটান। ফলে অনেক সময় বিষণ্নতা, অস্থিরতা ও হীনমন্যতা কাজ করে এবং কোনো কাজে মনোযোগী হতে পারে না বলেও জানান তারা। নিয়মিত পড়াশোনা না করার কারণে পরীক্ষার সময়গুলোতেও পড়াশোনায় বেশি সময় দেয়া সম্ভব হয় না তাদের। রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানোর ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে না পারা, সকালের ক্লাস মিস দেয়া এমনকি সকালের নাস্তাটুকুও ঠিকমতো হয় না তাদের।

ক্যাম্পাস জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, একুশ শতকের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবন ছিল এখনকার থেকে অনেকটাই আলাদা। শিক্ষার পাশাপাশি বিতর্ক পাঠশালা, নাট্যচর্চা, লেখালেখি, সংস্কৃতিচর্চা, স্বেচ্ছাসেবামূলক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল শিক্ষার্থীরা। এর বাইরেও আড্ডা, গান ও খেলাধুলাতে তাদের অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো।

বিকেল হলে দেখা যেত মাঠ দখলের প্রতিযোগিতা। স্টাম্প বসিয়ে কিংবা চিরকুটে লিখে মাঠ দখলের চিত্র ছিল নিত্যদিনের। আবার কারো অপেক্ষা একটি ম্যাচ শেষ হলে মাঠটি নিজেদের দখলে নিতে। যে দৃশ্যগুলো এখন শুধুই কাল্পনিক। এখন আর এসব চোখে পড়ে না, হারাতে বসেছে সেসব সোনালী সময়গুলো।

গোধূলি লগ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বর ও চায়ের দোকানে দল বেঁধে আড্ডায় মেতে থাকতো শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ কোরাস গান, কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধুদের মধ্যে ঠাট্টাচ্ছলে মারামারি, কারণে-অকারণে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক যেন আড্ডার ভাবমূর্তি আরও বাড়িয়ে তুলতো। ক্যাম্পাসও যেন মেতে থাকতো তাদের সাথে। তবে এ সবকিছুর মধ্যেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় কোনো প্রভাব পড়তো না। কারণ, তখন শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন ছিল না। সেহেতু রাত জেগে পড়াশোনা ব্যতীত তাদের আর কোনো কাজ থাকতো না। ফলে ভোরবেলার পাখির ডাকে খুব সহজেই ঘুম ভাঙতো তাদের। সূর্য ওঠার যে রঙিন দৃশ্য, গাছের ডাল-পাতা ভেদ করে রোদের আগমন ও পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ উপভোগ করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। যা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে এখন আর নেই।

প্রযুক্তির এই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের প্রায় সব শিক্ষার্থীই হয়েছে স্মার্টফোন কেন্দ্রিক। রাতভর ফেসবুকিং, নিউজ ফিড স্ক্রল, ইউটিউবের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে সময় কাটান শিক্ষার্থীরা। তাদের এই নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে কখন যে রাত পেরিয়ে যায়, বুঝতেই পারে না।

ফলে ভোরবেলার রক্তিম সূর্যোদয় দেখে না, গাছের পাতায় লুকোচুরি খেলা পাখির ডাকাডাকি শুনতে পারে না, কখনো বুঝতেও পারে না সকালের শীতল আবহাওয়াটা কেমন। এছাড়া ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে বিভাগে গিয়েও প্রতিদিন সকাল সোয়া ৯টার প্রথম ক্লাস মিস করতে হয়।

এছাড়া এখন আড্ডা দেয়ার ধরনও ভিন্ন। দল বেঁধে বসে থাকলেও জমজমাট আড্ডা তৈরি হয় না। কেউ ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত, কেউ নিউজ ফিড নিয়ে ব্যস্ত আবার কেউ থাকে অমনোযোগী। এসব কিছুর পেছনে একটাই কারণ, মিডিয়া আসক্তি। এ আসক্তির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও স্বেচ্ছাসেবামূলক বিভিন্ন সংগঠনে শিক্ষার্থীদের যুক্ত হওয়ার প্রবণতা অনেকাংশেই কমে গেছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে শিক্ষার্থীদের অবস্থা তুলে ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আরিফ হায়দার বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটি দিকই রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়াকে পজিটিভলি নিচ্ছে না। তারা মোবাইলকে বানিয়ে নিয়েছে বন্ধু হিসেবে, তাই নিজের বন্ধু-বান্ধবের নামও ঠিকমতো মনে রাখতে পারে না। আবার মোবাইলে মনোযোগ থাকায় রাস্তাঘাটে তাদের মাথা নিচু থাকতে দেখা যায়। এছাড়া ভাষাগত যে শব্দগুলো তারা ফেসবুকে ব্যবহার করে তা বাংলা বা ইংরেজির কোনোটার মধেই পড়ে না। ফলে এটা শিক্ষাঙ্গনে জাতির জন্য একটি ভয়াবহ অন্ধকারের জায়গা বলে আমার মনে হয়।’

সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অচিন্ত্য কুমার মল্লিক বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এছাড়াও তুচ্ছ বিষয়ে দুশ্চিন্তা, অল্পতেই ভয় পাওয়া এবং ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, হতাশা, অস্থিরতা, কাজে অমনোযোগী, সিদ্ধান্তহীনতা, ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি, খিটখিটে মেজাজ, মেজাজের ভারসাম্যহীনতাসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষার্থীদের। ’


রাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়