ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শীতে উদাস মন বারবার প্রেমে পড়ে

তাসনিমুল হাসান প্রান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০০, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শীতে উদাস মন বারবার প্রেমে পড়ে

লাল ফুলের পাপড়ি ও সবুজ পাতার উপর শিশির বিন্দু ভোরের আলোয় মুক্তার দানার মতো জ্বল জ্বল করছে। কাকডাকা ভোরে টিনের চালে শিশির পড়ার মৃদু টপ টপ শব্দ, চলার পথে শিশিরে ভেজা ঘাস যেন জানিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিতে শীত এসে গেছে। ঋতুর এ পরিক্রমায় আবহমান বাংলায় এভাবে প্রতি বছরই শীতের আগমন ঘটে। এসময় উদাস মন প্রকৃতির মাঝে বারবার প্রেমে পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাম্পাস জীবনে শীত উপভোগ করা কিছুটা দুষ্কর। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও তার ব্যতিক্রম নয়। শীত আসে ক্যাম্পাস জীবনে কনকনে শীতল হাওয়ার সাথে ঝরাপাতার গান শুনিয়ে। শিক্ষার্থীরাও শীত উপভোগ করার চেষ্টা করে নিজেদের মতো করে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ পুরোটাই গ্রামীণ। এর চারদিকেই ছায়াঢাকা গ্রাম। দূর কোথাও থেকে তাকালে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো প্রকৃতির মাঝে লতাপাতার মালা পরে দাঁড়িয়ে আছে রানি হয়ে।

শীতের আগমন বোঝা যায় গোধূলীর সোনালী সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই ঘন কুয়াশার চাদরে আকড়ে ধরা প্রকৃতির দিকে তাকালে। হাড়ে কাঁপন ধরানো হিমেল বাতাসে ক্যাম্পাসের সবার গায়েই এখন শীতের গরম কাপড়। শুধু তাই নয়, বাহারি রঙের আর ডিজাইনের গরম কাপড়ের ফ্যাশন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গায়ে এখন শোভা পাচ্ছে।

এই ক্যাম্পাসে শীতের সকালে সব থেকে মনোমুগ্ধকর আকর্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মফিজ লেক জুড়ে। মফিজ লেকের দু’পাশে সবুজ বৃক্ষের নুয়ে পড়া ডালপালা থেকে ঝরেপড়া শিশিরের টুপটাপ শব্দ আর মাঝে মাঝে দু’একটা পাখির কলরবে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। কুয়াশা ভেদ করে যখন সকালের প্রথম সূর্য লেকের উপর উঁকি মারে, তখন ঝলমল করে ওঠে তার চারপাশ। এক অভিন্ন অপরূপ স্নিগ্ধময় আলোকসজ্জা নজর কেড়ে নেবে যে কারও।

ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ পিঠা। শীতের পিঠা-পুলির উৎসব বলতে এসব দোকানকেই বোঝায়। দুপুরের পর থেকেই রাত ৮টা পর্যন্ত এসব দোকানে মিলে শীতের বিভিন্ন রকম পিঠা। আর শীতের এই পিঠার স্বাদ নিতে সারাক্ষণ এসব দোকানে ভিড় লেগেই থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া মোড় এবং পশ্চিম পাড়ায় পিঠা খাওয়ার জন্য এতটাই ভিড় থাকে যে, পিঠা পেতে হলে অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এই ভিড়টা শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, এতে যোগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

বিকেলে কাম্পাসের মাঠে জমে উঠে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবলসহ বিভিন্ন শীতকালীন খেলাধুলা। এ ছাড়া একটু রাত হলে ই-কাম্পাসের ভেতরসহ হলগুলোর সামনে জমে ওঠে শীতকালের চিরচেনা খেলা ব্যাডমিন্টন।

সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের পশ্চিমপাড়ার মোটা খালার পিঠার দোকানে, গরীব মামার চায়ের দোকানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের ইবি রেস্টুরেন্টের আড্ডা, শেখপাড়ার জহির মামার চায়ের কাপে চুমুকের ঝড় তুলে কাটে শিক্ষার্থীদের শীত। কখনও বা মাঠের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে ও আড্ডা দিয়ে কেটে যায় উষ্ণ শীতের সন্ধ্যা। আবার কোনো কোনো সন্ধ্যায় জিয়া মোড়টি এস সি সি, ডায়না চত্বরসহ বিভিন্ন আড্ডাস্থলে বসে গানের আসর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী জয়নব খানম বলেন, ‘গোল হয়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর উপযুক্ত সময় শীতকাল। ডায়না চত্তরে বসে পড়ন্ত বিকেলে গানের আড্ডা অথবা সকালের নরম রোদে আড্ডা দেয়ার অনুভূতিই অন্যরকম।’

শীতের পিঠা নিয়ে অনেকটা আগ্রহ নিয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত সর্মি বলেন, ‘আমার বাসা ঠাকুরগাঁও। সেমিস্টার শেষ না হলে বাসায় যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই আমরা যারা পরিবারের সবাইকে রেখে ইবি ক্যাম্পাসে থাকি, তাদের শীতের পিঠা মানেই তো খালাদের (দোকানের নারী কর্মী) হাতের পিঠা।’

শীতের সকালে সবচেয়ে কষ্টদায়ক ব্যাপার হচ্ছে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া। অনেককেই সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠতে হয় ৯টায় ক্লাস করার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। অনেকেই আরামের ঘুম হারাম করে ক্লাসে যেতে চায় না। প্রায় হলের শিক্ষার্থীদেরই শীতে ঘুম থেকে দেরিতে উঠতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চিত্র প্রায় একই রকম। যারা হলে থাকেন, তাদের জন্য সকালের ক্লাস করা সহজ হলেও যারা কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ শহরে থাকেন, তাদের জন্য সকালের ক্লাস আরও বিরক্তিকর।

ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সোহান সিদ্দিকী বলেন, ‘শীতকাল আমার বরাবরই পছন্দের একটি ঋতু। এ শীতকালেই নবীন হয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। তাই ক্যাম্পাসে শীত ছোঁয়ায় মন হারিয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। চোখে ভেসে ওঠে শতশত রঙিন মলিন স্মৃতি।’

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিদ হাসান বলেন, ‘শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাস করা অনেক কষ্ট হয়ে যায়। বছরের অন্যান্য সময় যেখানে সারা রাত আড্ডা দিয়ে সকালের ক্লাস করি, সেখানে শীতের সকালে আরামে ঘুম হারাম করা কেমনে সম্ভব ভাই?’

অনেক শিক্ষার্থীই এখন আর রাত ১০টার পর খুব বেশি হলের বাইরে থাকেন না। সন্ধ্যা হলেই হলের টিভি রুমে সময় কাটান। শীতের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্যারম, দাবা, ব্যাডমিন্টন, কার্ড খেলার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। মেয়েদের হলেও দাবা ক্যারম বা লুডুর মতো বিভিন্ন ইনডোর গেম চলে সময় কাটানোর ব্যবস্থা হিসেবে।

শিক্ষার্থীদের কাছে শীত মানে অন্যরকম ফ্যাশন। রঙ-বেরঙের ড্রেস, সোয়েটার, চাদর, টুপি, মাফলার পরে সময় কাটানোর সুযোগ বছরের অন্য কোনো ঋতুতে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সবাই চায় নিজের ও পরিবেশের সাথে মানিয়ে পছন্দের পোশাকটি পরতে। তাছাড়া বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ভ্রমণসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের। এত কিছুর পরও ইবিতে শীত আসে প্রকৃতির বয়ে যাওয়া নিয়মেই।

ক্যাম্পাসে শীত মানেই আলস্য, বন্ধুদের নিয়ে পিঠা খাওয়া আর নানা রঙের পোশাক পরে দলবেঁধে আড্ডাবাজি, ঘোরাঘুরি আরও কত কী! এ সব কিছুর মাঝেই শিক্ষার্থীরা উপভোগ করে শীতকে নতুন আঙ্গিকে নতুন অনুভূতিতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।



ইবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়