ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পরীক্ষাভীতি

অনিক রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরীক্ষাভীতি

আমরা জানি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে যদি বাচ্চাদের মেরুদণ্ডই ভেঙে যায়, তাহলে দাঁড়াবে কী করে? আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাটা ঠিক তেমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চারা এখন বইয়ের ভারে নুয়ে পড়ছে।

পরীক্ষা, যার অর্থ দাঁড়ায় মেধার মূল্যায়ন। যার মাধ্যমে যাচাই করা হয় মেধার মান। পরীক্ষা হলো কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর নিয়মমাফিক মেধা যাচাইকরণ প্রক্রিয়া।

বলতে গেলে, একবিংশ শতাব্দিতে এসে পরীক্ষার প্রবণতা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিংশ শতাব্দীতেও পরীক্ষা পদ্ধতির এত প্রচলন ছিলো না। আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবক হেনরি ফিশেল। তবে, সর্বপ্রথম সার্বভৌম পরীক্ষা নেয় চীন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে পরীক্ষা পদ্ধতির এত সুদূর প্রসারিত অতীত পাওয়া যায় না। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে।

বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক, আপনি সরকারি চাকরি, বেসরকারি চাকরি, অথবা যেকোনো ধরনেরই ডিগ্রি অর্জন করতে যান, আপনাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। একটি শিশু অথবা একটি কিশোর ভালোভাবে পরিবেশ বুঝে উঠার পূর্বেই তাকে বসতে হচ্ছে পিএসসি, জেএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায়। প্রতি বছরে এর সাথে আরও যোগ হচ্ছে সেমিস্টার, ক্লাসটেস্ট, বার্ষিক পরীক্ষাসহ আরও কত কি। এটি তাদের শিক্ষাগত উন্নতি ঘটালেও মানসিক বিকারগ্রস্ত করছে এবং সাথে আমাদেরকে দিচ্ছে একটি মূল্যবোধহীন জাতি।

শিক্ষাজীবন হবে মজার, তাতে যদি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সেই শিক্ষাব্যবস্থা স্বার্থকতা হারাবে। অনেকে এই 'চড়াই-উতরাই' পন্থায় টিকে থাকতে পারে, অনেকে আবার পারে না। আবার, অনেকে আছে যাদের পরীক্ষার কথা শুনলেই মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। পরীক্ষা যেন তাদের মরণব্যাধি। আসন্ন যেকোনো পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে করতে তাদের মুখ হয়ে যায় পাংশুবর্ণ, রক্ত হয়ে যায় হিম। আজ এই ধরনের পরীক্ষার্থীদের কথাই বলবো।

শিক্ষার্থীদের মনে পরীক্ষা নিয়ে কেন এই ভয়? কেন তাদের মনে দুশ্চিন্তার বিষয়? জানতে চাইলে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী আমাদের বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফল কী হবে, সেটি নিয়ে আমরা অনেক চিন্তিত থাকি।’ তাহলে কি তারা ফলাফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে? অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা পরীক্ষা থেকে বেশি এর ফলাফল নিয়ে ভাবনাগ্রস্ত। কিন্তু পরীক্ষার পূর্বেই এর ফলাফল নিয়ে দুর্ভাবনা তাদের প্রস্তুতিতে কি প্রভাব ফেলছে না? এতে তাদের ফলাফল আরও খারাপ হচ্ছে।

কেন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত?

পরীক্ষার পূর্বেই ফলাফল নিয়ে ভাবনা করা অহেতুক সময় নষ্ট করার শামিল। শিক্ষার্থীদের মনে এসব ভাবনার উদয় তাদের খারাপ প্রস্তুতির জন্যই হয় বলে দাবি করেন অধিকাংশ অভিভাবক। তাদের মতে, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পেছনে যথাযথ সময় ব্যয় করছে না। এছাড়াও রয়েছে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব। বরং পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুতি জোরদার না করে অনেক শিক্ষার্থীকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হা-হুতাশ করতে দেখা যায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে অনেকেই এই রেশ কাটিয়ে উঠে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারছে না।

পারিবারিক চাপ হতে পারে আরেকটি কারণ। অনেক শিক্ষার্থী এই চাপের কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা ভাবতে শুরু করে, তারা যদি তাদের বাবা-মার এত এত আশা পূরণ করতে না পারে, তাহলে কী হবে?

শুধু এইটুকু না শারীরিক প্রহার কিংবা বাড়ি ছাড়া করার হুমকিও তাদেরকে ভীতিগ্রস্ত করে তোলে। এর মূল কারণ হচ্ছে সন্তানের মেধাগত যোগ্যতা, ক্ষমতা না বুঝে তাদের উপর ভালো ফলাফলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। বস্তুত যে শিক্ষার্থীর ক্ষমতা যতটুক সে ততটুকুই অর্জন করতে পারবে।

পরীক্ষা নামক দুশ্চিন্তা থেকে উত্তরণের উপায়:

পরীক্ষা নামক আতঙ্ক থেকে উত্তরণের জন্য বাবা-মা হতে পারে সবচেয়ে বড় বন্ধু। অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা আপনাদের সন্তানের সাথে প্রাণখুলে মিশুন, তাদেরকে আশ্বাস দিন। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, তাদের সন্তান কোনো রোবট নয়, যে তারা যা চাইবে তাই এনে দিতে পারবে। অন্য শিক্ষার্থীদের ফলাফলে আকৃষ্ট হয়ে নিজ সন্তানের উপর তেমন দায়িত্বভার অর্পণ করা নিছক বোকামি।

শিক্ষার্থীরা অবশ্যই অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব কাটিয়ে পরীক্ষার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিন।

নিজের বিনোদনের জন্য কিছু সময় রাখুন। কেন না, সর্বদা পড়ালেখায় নিমজ্জিত থাকলে তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে।

রুটিনমাফিক পড়ালেখা করলে পরীক্ষার পূর্বে আর কোনো বোঝা তৈরি হয় না। শিক্ষার্থীদেরকেও আলাদা কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, পরীক্ষা শুধু মেধা যাচাইকরণ পদ্ধতি না, এটি শারীরিক এবং মানসিক পরীক্ষাও বটে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করাটাও এক ধরনের পরীক্ষা।

পরীক্ষার কথা শুনে ভয় পাওয়া নয়, বরং পরীক্ষাকে সানন্দে গ্রহণ করার মনোভাব আমাদেরকে অর্জন করতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আশাবাদি থাকতে হবে। তবেই পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব।

শিক্ষাব্যবস্থার উচিৎ পরীক্ষা পদ্ধতিকে শিক্ষার্থীদের সামনে ভালোভাবে উপস্থাপন করা। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষা পদ্ধতির দরকার আছে, তবে সেটি যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। তাহলে, আমরা হারাবো একটি মানবিক মূল্যবোধহীন জাতি, আর পাবো শুধু পুঁথিগত জ্ঞানে সুসজ্জিত কিছু রোবট।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


জবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়