ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আমি মানুষ, আমার স্বাধীনতা কোথায়?

আশরাফি দিবা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমি মানুষ, আমার স্বাধীনতা কোথায়?

খুব ছোটবেলায় আমার একবার নাচ শেখার শখ হয়েছিল। কিন্তু মেয়ে বলে শখটা পূরণ হয়নি। সেসময় থেকেই মেয়ে হওয়ার ফলে শখগুলো খুন করতে শিখেছিলাম। যত বড় হতে লাগলাম, ততই পেছন থেকে সমাজের দেয়া শিকলগুলো আমার পায়ে জড়াতে থাকল। মেয়েদের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এই না-তেই আটকে যেতে লাগল জীবন। এরপর শুরু হলো শারীরিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিবন্ধকতা।

আমার মায়ের গায়ের রঙ উজ্জ্বল, কিন্তু আমার গায়ের রঙ কালো হওয়ায় মাকে এ নিয়ে প্রতিবেশীদের অনেক কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল। মাকে সব জায়গায় একটা কথাই শুনতে হতো, আপনার গায়ের রঙ উজ্জ্বল মেয়েটা এমন হলো কেন? তখন বুঝতে পারলাম, মেয়েদের গায়ের রঙ কালো হওয়া বিরাট অন্যায়।

যখন স্কুলে যেতে শুরু করলাম, সেই সময় রাস্তায় বখাটেরা উত্যক্ত করলে সেটার দোষও আমার গায়ে আছড়ে পরতো। সবাই ধারণা করতো, দোষটা হয়তো আমারই ছিল, তাই রাস্তার বখাটেগুলো এমন আচরণ করেছে।

এরপর পায়ে লাগিয়ে দেয়া হলো এক অদৃশ্য শেকল। স্কুলে একা যাওয়া আমার জন্য ছিল নিষিদ্ধ। বাবা-মা কিংবা ভাই কেউ না কেউ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতো। সেই সাথে যোগ হয়েছিল আরেক অদ্ভুত নিয়ম। কোনো ছেলে বন্ধু থাকা যাবে না। কারণ ছেলে বন্ধু থাকা মানেই চরিত্রে দাগ বয়ে বেড়ানো। সেসময় ছোট মস্তিষ্ক দিয়েও ভেবে পেলাম না, ছেলে বন্ধু থাকলে চরিত্রে কেন দাগ পড়বে!

যাক সে কথা, এবার পোশাক পরিচ্ছদের নিয়মে পড়তে হলো! এই যে এত ধর্ষণ হচ্ছে, সবইতো হচ্ছে মেয়েদের পোষাকের জন্যে! বাসা থেকে সবসময় এমন এমন পোষাক নির্বাচন করা হতো, মনে হতো মেয়েরা খুব সেন্সেটিভ বস্তু। এদের সবসময় প্যাকেটের মতো মুড়িয়ে রাখা জরুরি। না হলে খাবারের মতো এদের গায়েও ব্যাকটেরিয়া ঢুকে মেয়েদের নষ্ট করে দেবে। তাই, মেয়েদের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল কালো কাপড় দিয়ে আবদ্ধ করতে হবে।

এরপরেও যখন এসব মেনে নিতে শুরু করলাম, তারপরেও নানা উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। যেমন, সারা দিন এমন ঘরে পড়ে থাকিস কেন? আজকাল মেয়েরা কতো কিছু করে, তুইওতো করতে পারিস। এখন কি মেয়েরা ঘরবন্দি থাকে নাকি? কিন্তু যখন কাজ করতে শুরু করলাম, তখন শুনতে হলো, এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস কেন। মেয়েদের এত বাইরে থাকতে নেই। কোনো জায়গা নিরাপদ নয় মেয়েদের জন্য। আমিতো নারী নই, আমি পুরুষের মতো মানুষ। তাহলে আমার স্বাধীনতা কোথায়?

এত কিছু উপেক্ষা করেও এক ছেলের প্রেমে পড়লাম। প্রথম প্রেমের অনুভূতি অন্য রকম। সেটা ছিল দারুণ অনুভূতি। কিন্তু এই অনুভূতির মাঝে ভুলে যেতে নেই আমি মেয়ে। প্রেমের মনোমালিন্যর কারণ শুধুই আমি। কারণ আমি মেয়ে। প্রেমিকের বন্ধুর প্রেমিকা যখন আধুনিক পোশাক পড়ে, তখন আমি হয়ে যাই খ্যাত, আবার যখন আমি প্রেমিকের জন্য আধুনিক হতে যাই, তখন আমি খারাপ। বুঝতেই পারিনি সে আমার কাছে কী চায়। আমি আধুনিক আর কথিত খ্যাতের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পেলাম না। কোনটা আধুনিক কোনটা কথিত খ্যাত বুঝে উঠতে বিপাকে পড়তে হলো। এত সমালোচনা বা মনোমালিন্যর দায়ভার আমাকেই নিতে হবে। কারণ, আমি নারী।

মেয়েদের জীবন দুটো। এক অবৈবাহিক জীবন, আরেক হচ্ছে বৈবাহিক জীবন। ছোট থেকে শুনে এসেছি, মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় ঘর, সংসার আর স্বামী। এইসব মেনে যখন সংসার শুরু করলাম। তখন বুঝলাম, সকাল থেকে রাত সবার জন্য রান্না, ঘর গুছানো, সবার খেয়াল রাখা এগুলো কোনো কাজের মধ্যে পড়ে না। আমার স্বামী বাইরে কাজ করে শুধু ওইটাই কাজ। তারপর যখন নিজের কাজে ফিরে গেলাম, তখন শুনতে হলো এত রাতে বাড়ির বাইরে কোনো ভালো মেয়ে থাকে না। মেয়েদের রাত হয় কখন জানেন? বিকেল ৫টা থেকে মেয়েদের রাত শুরু। আমার স্বামী গভীর রাত করে আসতেই পারে, আমার সেই অধিকার থাকতে নেই, কারণ আমি নারী।

শুধু আমার নয়, প্রতিটি নারীর জীবনেই এই চড়াই উৎরাইগুলো পার করে যেতে হয়। আজ কেউ এভারেস্ট জয় করলে আমরা সেটাকে নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করে তাকে বাহবা জানাই ঠিকই, কিন্তু নিজের বোন, প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীকে বাইরে যেতে দেই না। কোনো ধর্ষণের ঘটনা দেখলে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় তুলে দেয়, কিন্তু রাস্তায় গিয়ে একটা জিন্স পরা মেয়েকে দেখলে আপনা আপনিই ঠোঁটটা বেজে ওঠে। একটা কালো মেয়েকে সহানুভূতি দেখাতে হবে, কিন্তু তাকে বিয়ে করা যাবে না, এইতো আমাদের সমাজের নিয়ম।

কোনো নারীকে প্রতিবাদ করতে দেখলে সেটার ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করতে আমরা খুব পারি, কিন্তু নিজের ঘরে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে বাঁধে না আমাদের।

নারী দিবস পালন, নারীর অধিকার নিয়ে লড়াই করার জন্য সবাই রাস্তায় দাঁড়াই ঠিকই, কিন্তু নিজের ঘরের নারীকে অদৃশ্য শেকল দিয়ে বেঁধে রাখি। তাহলে, এই লোক দেখানো লড়াই করে লাভ কী?

যুগ নাকি বদলে গেছে। হ্যাঁ, যুগ বদলে গেছে, কিন্তু শুধু যুগ তথ্য-প্রযুক্তির দিক থেকেই এগিয়েছে, বদলায়নি মানুষের মানসিকতা। নারী তুমি বন্দি ছিলে, বন্দিই আছ। তোমার পায়ে আজও সমাজের পরানো শেকল রয়ে গেছে।

নারী তুমি আর কত নিজের শখগুলোকে নিজের মাঝেই মেরে ফেলবে। আর কত বদ্ধ ঘরে মার খাবে। অন্যের কথায় নিজেকে ছোট ভাববে। আর কত নিজের জীবনকে রাখবে অন্যের নির্ভরতায়। ঘুরে দাঁড়াও নিজের শক্তিতে। না, কাউকে পাশে পাবে না তুমি। তোমাকে নিজের লড়াই একাই লড়তে হবে। নিজের শক্তিতেই ভাঙতে হবে এই শিকল। তোমার জীবন শুধু অন্যের স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নয়, নিজের স্বপ্নগুলোকেও বাঁচাতে শেখো। বাঁধা ভেঙে ঘুরে দাঁড়াও নারী।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।


ডিআইইউ/হাকিম মাহি 

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়