ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে চান সেই লিমন

রাকিবুল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ৬ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে চান সেই লিমন

কৃষকের ছেলে লিমন হোসেন। তখন ১৬ বছরের কিশোর। উচ্চমাধ্যমিকের শুরুতে র‌্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছেন। বিচারের বদলে সহ্য করেছেন নির্যাতন। তাকে সন্ত্রাসী প্রমাণের চেষ্টা করেছিল রাষ্ট্র। কিন্তু শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যাননি তিনি। অদম্য সেই লিমন এখন ২৫ বছরের যুবক। তিনি ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) আইন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।

কিন্তু গত ১০ বছর ছিল লিমনের জন্য চরম যন্ত্রণার। র‌্যাবের দেওয়া সন্ত্রাসী পরিচয়ের যন্ত্রণা। র‌্যাবের কথিত সোর্স স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হুমকির যন্ত্রণা। কাটা পা নিয়ে নিজেকে বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা। মিথ্যা মামলা আর মাসে মাসে আদালতে হাজিরার যন্ত্রণা। পরিবারসহ গ্রামছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা। এখনো পারিবারিক নিবাস দখলে রেখেছে তার প্রতিপক্ষরা।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন পঙ্গু হাসপাতাল থেকে লিমনের নাম কেটে কারাগারে পাঠিয়ে ছিলেন। তারপর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল লিমনের চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। সেই দুঃসহ পরিস্থিতিকে পায়ে পিষে এগিয়েছেন লিমন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকেও পড়ালেখা করেছিলেন। সঙ্গে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে, কৃতকার্য না হওয়ায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে আইন বিভাগে তিনি সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর এই পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিল প্রথম আলো।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাতুরিয়ায় নিজের বাড়ির পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন লিমন। বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে র‌্যাব (র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন) সদস্যরা এক সন্ত্রাসীকে ধরতে গিয়ে তাঁকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। তারপর লিমনকে প্রথমে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। জীবন বাঁচাতে সেখানে তাঁর বাম পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়।

এ ঘটনার পর র‌্যাব লিমনসহ ৮ জনের নামে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করে। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে।

এরপর ওই বছরের এপ্রিলে লিমনকে নিয়ে খবর ছাপে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এতে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক প্রতিবাদ উঠেছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের দেওয়া সব অপবাদ অসত্য প্রমাণ করে লিমন নতুন জীবন ফিরে পান। পা হারানো লিমনকে রাষ্ট্রীয় হয়রানির কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়।

রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার শিকার এই তরুণের শিক্ষাজীবন শুরু হয় সাতুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় অভিপ্রায়ে। পিজিএস কাউখালী কারিগরি বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৭ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং ২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। সম্প্রতি ১০ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।

লিমন হোসেন বলেন, ‘আমি অন্ধকার এক গুহায় আটকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাকে তুলে এনেছেন জাফরুল্লাহ স্যার ও প্রথম আলো। আমি রাষ্ট্রের কাছে যতটা নির্যাতিত হয়েছি, তারচেয়ে বেশি মানুষের স্নেহ, সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান স্যার, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান স্যার, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন স্যার ও তার বিবি ড. হামিদা হোসেন ম্যাম, প্রথম আলোর বার্তাজীবী টিপু সুলতান ভাই।’

ঝালকাঠির স্থানীয় সাংবাদিক আক্কাস সিকদার ভাই সকলেই আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সাহস দিয়ে আসছে। সুফি প্রকাশনী আমাকে প্রতিনিয়ত বই দিতো। প্রথম আলো আমার প্রতিমাসের খরচ দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। গোটা বিশ্বের কাছে আমি ঋণী’, বলেন লিমন।

শিক্ষক লিমন আরো বলেন, ‘শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি আমি। আমার জীবনের মূল লক্ষ্য অসহায়, নির্যাতিত মানুষের জন্য কাজ করা। তাদের পাশে থাকা। দেশে অসহায় মানুষকে কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, আমার চেয়ে ভালো কেউ বর্ণনা করতে পারবে না। স্বপ্ন দেখতে মানা নেই। আমিও স্বপ্ন দেখছি, এরপর আমি ব্যারিস্টারি পড়তে চাই।’

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার।

 

গবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়