নরম হাতে শক্ত হাল
হিমেল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম
পেছন থেকে আমাকে অচেনা এক ছোট্ট কণ্ঠে ডাকছে, ভাই বাদাম-বুট লাগবে? আমি পেছনে তাকাতেই দেখি ৯/১০ বছরের এক শিশু আমার পিছু পিছু হাঁটছে। আমি বললাম, কী দাদা, কিছু বলছো? ও বলল, বাদাম লাগবে? আমি ওর কথায় কী উত্তর দেবো ভাবতেই চলে গেলাম শৈশবে। যে সময়ে আমরা এগ্রাম-ওগ্রাম করতাম, সে সময়ে ছেলেটি পেটের টানে বাদাম ফেরি করে বেড়াচ্ছে। বলছি, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার পান্টি গ্রামের শিশু সানাউল্লার কথা।
সব প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠছে সে। যে বয়সে শিশুরা স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে, খেলাধুলা করবে, সেই বয়সে তাকে শারীরিক শ্রম দিয়ে চালাতে হচ্ছে পরিবার। দীর্ঘ ৪-বছর যাবৎ সে তার পরিবার চালাচ্ছে।
সেদিন রাত ৯টা। দু’চোখ তার ঘুমে আচ্ছন্ন। পরনে হাটু পর্যন্ত নামানো থ্রি- কোয়ার্টার প্যান্ট, নীল রঙের ডোরাকাটা টি-শার্ট ও পায়ে বাদামি রঙের স্যান্ডেল। কাঁধে বাদামের ঝুলানো ঝাঁকা নিয়ে একটি শিশু দোকানে দোকানে বাদাম বিক্রি করছে। আমি বাসায় ফেরার সময় ছেলেটার সঙ্গে দেখা হলো। তাকে দেখে আমি একটু ব্যথিত হলাম।
প্রশ্ন করলাম, তুমি কি স্কুলে যাও না? বাদাম ওজন করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি ৫ম শ্রেণিতে পড়ছি।
তোমার বাবা আছে? আছে, আমার আব্বা অসুস্থ, কিছু করতে পারে না, চোখেও দেখে না।
তোমার এ কাজ করতে ভালো লাগে?
প্রতিদিন একই কাজ করতে তার ভালো লাগে না বলে জানায়। বাদামের ভারী ঝাঁকা নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরতে তার খুব কষ্ট হয়। অন্য দিকে বিক্রি না করলে খাওয়া বন্ধ থাকে বলেও জানায়। অসুস্থ বাবার ওষুধ কিনে থাকে এই বাদাম বিক্রি করে।
শেষে, শিশুটির কথায় আমি বুঝতে পারলাম, একমাত্র উপার্জনকারী পরিবারের ৪জন মানুষ ওর আয়ের উপর নির্ভর করছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য উর্ধগতিতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সানাউল্লার। সে সারাদিন পরিশ্রম করে ১৫০/২০০ টাকা আয় করে। সে আয়ে চলে সংসার। কাজ করতে করতে নরম হাত দুটো শক্ত হয়ে গেছে।
পরের দিন আমি সানাউল্লার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম। নিজের ছেলেটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে না পারায় অসুস্থ বাবা ওসমান আলী ও মায়ের অনেক আক্ষেপ। কিন্তু তারা বলেন, পেটের দায়ে আয়ের পথে লাগিয়ে দিয়েছেন। সানাউল্লার স্বপ্ন বড় হয়ে সে পুলিশ হবে এবং বিশ্বাস করে তখন অভাব অনটনের দিন আর থাকবে না। এমন দেশে হাজার হাজার সানাউল্লার স্বপ্ন মাটি চাপা পড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
বর্তমান দেশে এমন অনেক শিশুই দেখা যায়, যারা কিনা তাদের শৈশবকে হারিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত থেকে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করছে। এভাবে বাঁচিয়ে রাখছে পরিবার। এই শিশুরা চায় তাদের সুন্দর একটি শৈশব, হাসিখুশিময় জীবন। কিন্তু জনবহুল এই দেশে এইসব শিশুদের পাশে কে বা কারা এগিয়ে আসবে? আমাদের দেশে যেমন লোকের সদিচ্ছার অভাব, তেমনি আছে মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা করার প্রবণতা।
একটি শিশু সারাদিন না খেয়ে থাকলেও তাকে দু’মুঠো ভাত খাওয়ার টাকা দেবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। একটি দেশের জন্য বিষয়টি কতটা ভয়াবহ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কাগজে-কলমে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও এখনো আর্থ-সামাজিকভাবে অনেক বেশি পিছিয়ে রয়েছে। অনেক পরিবার এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বাংলাদেশের গ্রাম-অঞ্চলে দরিদ্রতার হার অনেক বেশি।
এটা বড়ই আনন্দের বিষয় যে, বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। জানতে পেরেছি সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের ঘোষণা দিয়েছে।
আবার এটাও বলেছে, এ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে চুড়ান্তভাবে শিশুশ্রম নিরসন করবে। আমরা আশা করছি, সরকার তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাক। তবে সরকারের উদ্যোগকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
বেরোবি/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন