গণিতে ইতিহাস তাছলিমার
আরাফাত বিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম
‘আমার জন্ম সৌদি আরবের মক্কায়। শৈশব আর কৈশোরের একটা বড় অংশ কেটেছে সেখানেই। শিক্ষাজীবনও শুরু হয়েছে মক্কায়। যখন বুঝতে শিখি, তখন জানতে পারি আমার পৈত্রিক ভিটা বাংলাদেশে। বাবা-মায়ের মুখে বাংলাদেশের কথা শুনতে শুনতে একসময় দেশের প্রেমে পড়ে যাই।’ কথাগুলো বলছিলেন ২০১১-২০১২ সেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে সবচেয়ে ভালো ফলাফল অর্জনকারী তাছলিমা সিরাজ।
২০১৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একমাত্র তিনিই ভালো ফলাফলের জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। তার সাথে কথা বলেছেন পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আরাফাত বিন হাসান।
আরাফাত: আপনার জন্ম আর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে যদি জানাতেন।
তাছলিমা সিরাজ: আমার জন্ম সৌদি আরবের মক্কায়। শৈশব আর কৈশোরের একটা অংশ কেটেছে সেখানেই। শিক্ষাজীবনও শুরু হয়েছে মক্কায়। ছয় বছর বয়সে ভর্তি হই আল-ইমান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মক্কায়। এই প্রতিষ্ঠানটি মক্কায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় মূলত সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে। এটি মক্কায় হলেও পরিচালিত হতো বাংলাদেশের ঢাকা বোর্ডের অধীনে। এই স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ছিলাম আমি।
আরাফাত: এরপর কোথায় ভর্তি হলেন?
তাছলিমা সিরাজ: পরবর্তী সময়ে ভর্তি হয়েছিলাম বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জেদ্দায়। এই স্কুল থেকে ২০০৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে এসএসসি পাশ করি। এসএসসিতে আমার জিপিএ-৫ ছিল। এর আগে অন্যান্য শ্রেণিতে আমার রোল নম্বর ঘুরেফিরে এক আর দুইয়ের মধ্যে ছিল।
আরাফাত: বাংলাদেশে আপনাদের বাড়ি কোথায়?
তাছলিমা সিরাজ: বাংলাদেশে আমাদের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ায়। তবে, এখানে আমার বাবা-মায়ের বাড়ি। বলতে গেলে আমি জন্মসূত্রে সৌদি আরবেরও নাগরিক।
আরাফাত: প্রথবার বাংলাদেশে আসেন কবে?
তাছলিমা সিরাজ: প্রথমবার বাংলাদেশে আসি ২০০৯ সালের অক্টোবরে। সৌদি আরবে থাকাকালীন দেশের প্রতি গভীর টান অনুভব করতাম। অবশ্য আমার জন্ম তো মক্কায়, তাই তখন বাবার দেশ মনে হতো।
আরাফাত: দেশে এসে মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হয়েছে?
তাছলিমা সিরাজ: সৌদি থাকাকালীন কিন্তু না দেখেই বাংলাদেশকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তবে দেশে এসে বুঝতে পারি বাস্তবতা আর কল্পনার মাঝে অনেক ফারাক। শুরুতে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট তো হয়েছিল। তবে, ভালো কিছু করার লক্ষ্যেই বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বাবা-মা কিন্তু তখনও সৌদি আরবের মক্কাতেই থাকতেন।
আরাফাত: দেশে এসে পড়ালেখা কীভাবে শুরু করলেন নতুন করে?
তাছলিমা সিরাজ: দেশে এসে ভর্তি হই কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজে। ২০১১ সালে এই কলেজ থেকেই এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। সেবার কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পায় মাত্র একজন, আর সেটা ছিলাম আমি।
আরাফাত: এইচএসসির পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ভর্তি হলেন?
তাছলিমা সিরাজ: বাবা-মা সৌদি আরবে থাকায় এইচএসসির পর কক্সবাজারের বাইরে গিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থানীয় কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করতে হয়।
আরাফাত: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত নিলেন কেন?
তাছলিমা সিরাজ: নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান গ্রুপ নিয়ে পড়ার সময় বিজ্ঞানের বিষয়গুলো ভালো লেগেছিল। গণিত সম্পর্কিত বিষয়গুলো একটু বেশিই ভালো লাগতো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার সরকারি কলেজে বিজ্ঞানের কোনো একটা বিষয় নিয়ে পড়ব। কিন্তু সেখানে গণিত আর উদ্ভিদবিজ্ঞান ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞানের বিষয় না থাকায় গণিতকেই বেছে নেই।
আরাফাত: অনার্সে কীভাবে পড়াশোনা করেছিলেন, আর কেমন রেজাল্ট ছিল?
তাছলিমা সিরাজ: আমার আম্মু-আব্বু বলতেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ভালো করা সম্ভব। তখন পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি। অনার্সের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার পর দেখা যায় আমার ফলাফল এসজিপিএ ৩.৯৩, যা গণিতে পুরো বাংলাদেশে সর্বোচ্চ হয়। তখন থেকে চেষ্টা করেছিলাম ফলাফলটা ধরে রাখার। দ্বিতীয় বর্ষেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। সেবার এসজিপিএ ৪.০০ এর মধ্য ৪.০০ পাই। এর পরের বছর অর্থাৎ তৃতীয় বর্ষেও সারা বাংলাদেশে গণিতে সর্বোচ্চ এসজিপিএধারী হই। তখন এসজিপিএ ছিল ৩.৯৪ এবং সর্বশেষ ফাইনাল বর্ষে ৩.৯৩ এসজিপিএ নিয়ে আবারো দেশসেরা হই। সব মিলিয়ে আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৫, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত গণিতে সর্বোচ্চ সিজিপিএ।
আরাফাত: প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক অর্জন সম্পর্কে যদি জানাতেন।
তাছলিমা সিরাজ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক দেয় একজনকে। সুতরাং সব ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ে তার সর্বোচ্চ সিজিপিএ থাকতে হবে। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৭ এর জন্য মনোনীত হই আমি। মানে আমার নিশ্চয়ই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ সিজিপিএ ছিল। আর প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণের সময় ওই মুহূর্তে মনে হলো আমার চার বছরের শ্রমের চেয়েও এই প্রাপ্তিটা অনেক বড়, তাছাড়া আমি আদৌ এই সম্মানের যোগ্য কিনা সেটাও ভেবেছিলাম।
আরাফাত: মাস্টার্সের রেজাল্ট কেমন ছিল?
তাছলিমা সিরাজ: মাস্টার্সে সিজিপিএ ছিল ৩.৯২। যা চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ।
আরাফাত: সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন কখনো?
তাছলিমা সিরাজ: কলেজে থাকাকালীন সহশিক্ষা কার্যক্রমে যতেষ্ঠ সক্রিয় ছিলাম। সেসময় কলেজের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ডজন খানেক পুরস্কারও জিতেছি আমি।
আরাফাত: আপনার অন্য ভাই-বোনদের সম্পর্কে যদি জানাতেন।
তাছলিমা সিরাজ: দুই ভাই আর তিন বোনের মধ্যে দুই নম্বরে ছিলাম আমি। বড় বোন ইয়াসমিন সিরাজ বর্তমানে একজন বিসিএস ক্যাডার। বিসিএসে তিনি তার বিভাগে ২য় হয়েছিলেন পুরো বাংলাদেশে। আমার মতো একই সমস্যার কারণে দুই ভাইয়ের কেউই কক্সবাজারের বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। তাই স্থানীয় কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়তে হচ্ছে তাদের। তবে কয়েক বছর আগে মা স্থায়ীভাবে দেশে ফেরার সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে আমার ছোট বোন, সে বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
আরাফাত: আপনার পরিকল্পনা কী এখন?
তাছলিমা সিরাজ: আমি সর্বেশেষ ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় আছি। আর অনার্সের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জামাল নজরুল ইসলাম গবেষণা কেন্দ্রের একটা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সেখানে গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু বিসিএসের জন্য পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে গিয়ে সেখানে যোগ দিতে পারিনি। তবে বিসিএসটা হয়ে গেলে গণিত নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা করে পিএইচডি সম্পন্ন করতে চাই।
আরাফাত: আপনাকে ধন্যবাদ।
তাছলিমা সিরাজ: রাইজিংবিডি ও আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
চট্টগ্রাম/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন