ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

করোনা: বদলের হাতছানিতে দুনিয়া

মাহমুদ সাকী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনা: বদলের হাতছানিতে দুনিয়া

সব সংবাদ ছাপিয়ে করোনা এখন বিশ্বসংবাদ। আল জাজিরা থেকে রয়টার্স, বিবিসি থেকে গার্ডিয়ান সব সংবাদের হেডলাইন এখন করোনাময়। এর মধ্যে আরো বহু ঘটনাই হয়তো ঘটে যাচ্ছে, কিন্ত তা করোনার দাপটে বিলীন।

সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা ছাপিয়েও এই করোনা দাপট দেখিয়ে চলেছে পৃথিবীর প্রতিটি সেক্টরে সেক্টরে, অর্থনীতি-রাজনীতি থেকে ধর্মকর্ম আর বিনোদন জগত, কোথাও বাদ রাখেনি এই দাপট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবী বদলে যাবে, বদলের সময় এসেছে। হয়তো তাদের কথা মতো অচিরেই এক নতুন পৃথিবীর হাতছানি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। অনেকেই ইতিমধ্যে ‘করোনা পরবর্তী দুনিয়া’ নামে তার নামকরণও করে ফেলেছেন।

কেমন হবে সেই দুনিয়া? এই নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই আমাদের, শেষ হওয়ার কথাও নয়।সমাজতন্ত্র নাকি গণতন্ত্রের লেবাসে মোড়ানো ধনতন্ত্র! চীন-রাশিয়া নাকি পূর্বের যুক্তরাষ্ট্রই! নাকি নতুন কোনো উত্থান! কে দেবে সেই দুনিয়ার নেতৃত্ব? প্রশ্ন আর জল্পনা-কল্পনা থেকেই যায়। সন্দেহের দানা বাঁধছেই প্রতিনিয়ত।

চতুর্দশ শতাব্দীতে রেনেসাঁ (পুনর্জাগরণ) হয়েছিল পৃথিবীতে। বিশেষ করে ইউরোপে। ফলে সনাতন সমাজ থেকে বিজ্ঞানময় সমাজে প্রবেশ করে পৃথিবী। উত্থান ঘটে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার। বদল হয় পৃথিবী। কিন্ত না, বেশি দিন নয় সে বদল। পৃথিবী আবার পরিবর্তনের হাত ছানি দেয় মানুষকে, শুরু হয় অদল-বদলের এক নতুন খেলা।

চলে আসে ষোড়শ শতাব্দী। আবার শুরু হয় পরিবর্তন। এবার হয় বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব। পূর্বের মতো এবার আর সনাতন থেকে বিজ্ঞান নয়, বরং বিজ্ঞান থেকেই আরো উন্নতর বিজ্ঞানে। আবিষ্কার হয় ইঞ্জিন। আর কায়িক থেকে মানুষ যায় মেশিনে। প্রবেশ করে শিল্পের যুগে। সময় কমে যায়, কাজ বেড়ে যায়। অর্থের পৃথিবীতে প্রবেশ করে দুনিয়া। নাম হয় ধনতন্ত্র। কাছে আসতে থাকে পৃথিবী, দূরে যেতে থাকে মানুষ কিংবা মনুষ্যত্ব। ফাটল ধরে সমাজব্যবস্থায়। মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় মেশিন, পুঁজি ও ধন। দরিদ্র হতে থাকে আরো দরিদ্র, ধনী হতে থাকে আরো ধনী। সভ্যতা হতে থাকে উত্তপ্ত। প্রয়োজন হয় আবার পরিবর্তনের। হাতছানি দেয় আবার বদল।

শুরু হয় নতুন ভাবনার, জন্ম হয় ভলতেয়ার, রুশো-মন্টেস্কুর। লেখা হয় সোশ্যাল কন্টাক্ট। মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে অভিজাত তথা ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

১৭৮৯ সাল। ফরাসি বিপ্লবের গিলোটিনে গলে যায় ষোড়শ লুইয়ের। পতন হয় পুঁজিসংরক্ষক অভিজাত আর জাজক সম্প্রদায়ের। সামনে আসে নিম্নবিত্তের তরুণ নেপোলিয়ন। মানুষের আশা জাগে, কিন্ত নিরাশ হয়। দুনিয়া প্রবেশ করে দখল আর সাম্রাজ্যবাদের নতুন যুগে। শুরু হয় আবার বদল। সেই সাথে শুরু হয় ধ্বংস, বিনাশ, শক্তি আর রাজনীতির জঘণ্য খেলা। চলতে থাকে মোড়লগীরি, চলতে থাকে লড়াই। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মানুষ, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে প্রয়োজনবোধ করে পরিবর্তনের।

ভাবতে থাকে নতুনত্ব নিয়ে। আবার জন্ম হয় নতুন রুশোদের, সামনে আসে মার্ক্স-এঙ্গেলরা। তৈরি করে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। লিখে ফেলে ডাস ক্যাপিটাল, হাতে পায় লেনিনেরা। শুরু হয় আবার আন্দোলন। লন্ডন থেকে প্যারিস, বার্লিন থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ। কেঁপে ওঠে সকল শোষকপন্থী শাসকেরা। পতন হয় জারতন্ত্রের। নতুন যুগে ঢুকে দুনিয়া, সমাজতন্ত্রের দুনিয়া, অক্টোবর বিল্পবের দুনিয়া। যে দুনিয়া আশা দেয় সাম্যের, ভাতৃত্বের, জনতার, সমতার। ধাক্কা লাগে পুঁজিবাদের প্রতিটি স্তম্ভেস্তম্ভে। নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় গোটা পৃথিবী। আবার বদল দেখে মানুষ, বদল দেখে সমাজব্যবস্থার। বদল দেখে ধারণার, ভাবনার।

কিন্ত স্থায়ী নয় সে বদল। হয়নি স্থায়ী তা, হয়তো হতে দেওয়া হয়নি। হয়তো হতে পারেইনি সে।

১৯১৮ সাল। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। সম্মুখে আসে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চাতে যায় কলোনিয়ালিজমবাদী ফ্রান্স-ইংল্যান্ড। প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিপুঞ্জ। দাবানো হয় উদীয়মান জার্মানিকে।

১৯৩৯ সাল। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে শুরু হয় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ। সাথে আসে নতুন তন্ত্র ফ্যাসিবাদ। ঘৃণ্য শক্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে ক্ষমতাশালীরা, জড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব। চলতে থাকে হত্যাযজ্ঞ। দুই মেরুতে বিভক্ত হয় পৃথিবী, অক্ষশক্তি আর মিত্রশক্তি।

সাল ১৯৪৫। পতন হয় ফ্যাসিজমের, সাথে বন্ধ হয় যুদ্ধ। শান্তির প্রয়োজন বোধ করে মানবসভ্যতা। বিভেদ ভুলে প্রতিষ্ঠা করে জাতিসংঘ। কিন্ত আবার সেই মোড়লেরাই নাটকের মঞ্চে, তবে আর একা নয় সাথে যুক্ত আরো দুই নতুন মোড়ল চীন-রাশিয়া।

পরিবর্তন হয় আবার পৃথিবীর। ক্ষণস্থায়ী নয় সে পরিবর্তন, হয় দীর্ঘস্থায়ী। কিন্ত থামেনি সেই তন্ত্রের প্রতিযোগিতা, থামেনি যুদ্ধ, থামেনি আগ্রাসন আর দখলদারীত্বও। এসেছে পুরনো বোতলের জায়গায় শুধু নতুন বোতল, মদ রয়ে গেছে সেই একই। নিয়ম ও রাস্তা পাল্টেছে শুধু।

যাইহোক, তবুও মানুষ এইবার চেষ্টা করেছে শান্তির জন্য, স্থায়িত্বের জন্য। তাইতো ধীরে ধীরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে নতুন অর্থব্যবস্থা, নতুন সমাজব্যবস্থা, নতুন রাষ্ট্র আর পররাষ্ট্র ব্যবস্থা।

এসেছে গ্লোবালাইজেশন, করেছে গোটা দুনিয়াকে এক ছাদনাতলায়। তথ্যপ্রযুক্তির অতি উৎকর্ষতায় রচিত হয়েছে এক উত্তরাধুনিক সভ্যতার। কিন্ত নাহ, মানুষ এবারো আর বেশিদূর এগোয়নি। থমকে দাঁড়াতে হয়েছেই আবার তাকে, দাঁড়াতে সে বাধ্য হয়েছে।

ডিসেম্বর ২০১৯, চীনের উহান শহর। নতুন রূপে ধরাদেয় এক পুরোনো রোগ, করোনা কোভিড-১৯। প্রথমে স্বাভাবিক থাকলেও পরবর্তীতে আর স্বাভাবিক থাকেনি, হয়ে ওঠে প্রলয়ঙ্করী। ছড়াতে থাকে অন্যান্য দেশে, ধীরে ধীরে স্বল্প সময়েই গ্রাস করে গোটা দুনিয়াকে। থেমে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য, থামে অর্থনীতি। ধাক্কা লাগে রাজনীতিতে।

এবার আর নড়েচড়ে বসা নয়, সটান করে শুয়ে পড়া। শুয়ে পড়তে বাধ্য হয় পৃথিবী। নিরবতা চলছে, স্থবিরতা চলছে। নীল বর্ণ ধারণ করছে আকাশ। হয়তো এ প্রলয় একদিন থামবে, হয়তো আবার জাগবে পৃথিবী। আমরাও হয়তো ওঠে দাঁড়াবো। কিন্তু ততদিনে বদল আসবে, পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করবে, নতুন তত্ত্বের মিছিলে হয়তো কোনো বদলের হাতছানি ডাকছে দুনিয়াকে। ওহে, জেগে ওঠো আবার বদল হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও বিতার্কিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

রাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়