কখনো পাখির গান কখনো গাছের ছায়া
অরিত্র দাস || রাইজিংবিডি.কম
সবুজ অরণ্যের মাঝে জাবি ক্যাম্পাস (ছবি: ইখতিয়ার আহমেদ বাপ্পী)
চারদিকে কী নীরব-নিস্তব্ধ একটি পরিবেশ। কোথাও কোনো গাড়ির শব্দ নেই। মানুষের হৈচৈ নেই। শুধু আছে পাখ-পাখালির কণ্ঠে গেয়ে ওঠা মন মতানো সব গান। সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে পুরো ক্যাম্পাস। প্রকৃতি যেন তার রূপ, রস ও সৌন্দর্য বৃক্ষের শাখায় শাখায় ঢেলে দিয়েছে। পায়ের নিচে নরম ঘাস আর লেকের স্বচ্ছ পানি সব মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রকৃতির রানি।
মহামারি করোনাভাইরাসের ফলে বদলে গেছে পুরো পৃথিবীর চিত্র। কোভিড-১৯ আতঙ্কে মানবজাতি এখন ঘরবন্দি। গাছপালা ও বহু প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করে প্রকৃতিকে কোণঠাসা করেছে যে মানুষ-তারাই এখন অসহায়, নিরুপায় হয়ে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে ঘরে।
হুতুম পেঁচা, ভুতুম ভুতুম, ভয়াল আঁধার, রাতের কুটুম
এই সুযোগে প্রকৃতি একদমই বসে নেই। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে, সাজিয়ে নিচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব। এটাই যেন ওদের উপযুক্ত সময়। জনবহুল এলাকাগুলো ফাঁকা, যান চলাচল বন্ধ, আর জনশূন্য উল্লেখযোগ্য সব স্থাপনা ও জায়গাগুলো। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। জনজীবন থমকে গেলেও কমেছে দূষণ, চকচকে তকতকে আলো। সৈকতে লাখ লাখ ডিম দিয়ে যাচ্ছে কচ্ছপ, হরিণ লোকালয়ে তার উদ্যম শরীর নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে নদী, বন, সাগর, বন্যপ্রাণী ও পাহাড়। প্রকৃতিতে ধরা দিয়েছে সতেজতা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতিও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র নয়নাভিরাম আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর। এই বন্ধে ক্যাম্পাসজুড়ে কোনো কোলাহল নেই, ময়লা আবর্জনা নেই, রিক্ততা নেই, কেবল প্রকৃতির অন্তরঙ্গতা রয়েছে। ডালে ডালে সবুজের সমারহ। সবুজ বনভূমির মাঝে লাল ইটের তৈরি ইমারত বৈচিত্রময় বিশ্ববিদ্যালয়কে করে তুলেছে আরো নান্দনিক।
সংসারের সমস্ত পাঠ চুকিয়ে গল্পে মজেছে কচ্ছপ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার এখন বৃক্ষ ও ফুলে ঘেরা। যেন গাছপালা তার হাত বাড়িয়ে কোলের মধ্যে বসিয়ে রেখেছে পরম মমতায়। প্রকৃতির সবুজ রূপ শুধু শহীদ মিনারকেই ঘিরে ধরেনি, ঘিরে ধরেছে প্রতিটি আবাসিক হলগুলোকেও। সবুজের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিংগুলো। এটি প্রকৃতির সবুজ-শ্যামল মাটির বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছে। তাই হয়তো পরিবেশ সচেতন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ
ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ’
আমারও আছে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার
মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে নানা জাতের গাছগাছালির সমারোহ এ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। শুধু একনিষ্ট প্রকৃতি প্রেমীর কাছে নয়, পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদের করেছে বিমোহিত। করোনার আতঙ্কে যখন ক্যাম্পাস হয়ে পড়েছে স্থবির, তখন অসংখ্য গুইসাপ, বেজি, গঙ্গা ফঁড়িং, শঙ্খচূড় সাপ, গিরগিটি, কাঠবিড়ালীসহ হরেক প্রজাতির পাখি নিজেদের সবটুকু মেলে ধরেছে এই ক্যাম্পাসের প্রকৃতিতে।
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বন এঁকে দিচ্ছে টিয়া, ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি। জঙ্গল ছেড়ে মাঠে, রাস্তার পাশে সহসাই শিয়ালের আনাগোনা এখন মন নাচিয়ে দেয়। এদের যাতায়াতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে অরণ্য। ক্যাম্পাসের জীব বৈচিত্র্যের বর্ণনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা মনে পড়ে গেলো-
আজ ভালোবাসতে নেই বারণ
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;
আকাশ ছড়িয়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে।
সাদা মেঘের উপর ভর করে নীল আকাশ ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে। সংখ্যায় ভারী হচ্ছে লাশের সারি। সারা বিশ্ব মানুষের লাশের গন্ধে মৌ মৌ। অথচ, প্রকৃতিতে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্নতা নেই। অনুশোচনা নেই। উঁচু উঁচু হরিতকি গাছ, আম, জাম, নিম, শাল, দেবদারু, ঘাস, বাঁশঝাড় তরতর করে লাফিয়ে বড় হচ্ছে। সতেজ হচ্ছে।
তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না
কেয়া পাতার তরী ভাসায় কমল –ঝিলে, তরু-লতার শাখা সাজায় হরিৎ নীলে। ছিটিয়ে মেঠো জল খেলে সে অবিরল, কাজলা দীঘির জলে ঢেউ তোলে। আনমনে ভাসায় পদ্ম-পাতার থালিকা।’ কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটো যেকেউ আনমনে গুন গুন করতে থাকবে এখন ক্যাম্পাসের এই প্রাকৃতিক সমাচার দেখে। কেননা, লেকগুলোর স্বচ্ছ জলকণা চিকচিক করছে সূর্যের কিরণে। লেকের পাড়জুড়ে ফুটে আছে বারোমাসি লাল শাপলা। কচ্ছপগুলো মাথা বের করে বসে আছে জলে ভাসা ডালে। একজন আরেক জনের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। যেন সংসারের সমস্ত পাঠ চুকিয়ে তারা গল্পে মজেছে।
মানুষের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি যে কর্মচঞ্চলতায় পদার্পণ করে, তার সচিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি। গাছে গাছে ফুল। ফুল যে কেবল বনের মধ্যেই তার শোভা ছড়িয়ে বেড়ায় তা নয়। মানুষের মনের মধ্যেও সে শোভা ছড়িয়ে পড়ে বহুগুণে। বিস্তৃত ক্যাম্পাসজুড়ে খইয়ের মতো মুখ তুলে ছড়িয়ে আছে কাঠগোলাপ।
ইস। খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
সন্ধ্যা নামলেই শিয়াল, হুতুম পেঁচা, লক্ষ্মীপেঁচাসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর হাঁকডাক এক অন্যরকম মাদকতা সৃষ্টি করে। এগুলো সাধারণত দেখা মেলে না কোলাহলপূর্ণ ক্যাম্পাসে, কিন্তু এই শুন্য ক্যাম্পাসজুড়ে কেবল ওদের আনাগোনা। দিনের বেলাতেও সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। এই বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণী এভাবে কখনো দেখা যায়নি খোলা ক্যাম্পাসে।
অথচ মানুষের গা ঢাকায়, ওরা গা মেলে ধরল। বৃক্ষ, পাতা, ফুল, ফল, মাটি, জল, জীবজন্তু, বাতাস একের অপরের সাথে যে সেতুবন্ধন, তা মানুষের মধ্যে নেই। মানুষ একা, ওরা সবাই মিলে একটা জোট।
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
প্রকৃতি পৃথিবীর কাছে জীবন ও মৃত্যু, সভ্যতা ও সংকট, পূর্ণতা ও নির্মূলের একাত্মতার প্রতীক। কিন্তু মানুষ এ সত্য ভুলে যায়। ভুলে যায় এই প্রকৃতি কেবল মানুষের না, ওরাও এর সমান অংশীদার। আর তাই প্রকৃতি যখন মানবসৃষ্ট অত্যাচারের সাথে পেড়ে ওঠে না, তখন অতিষ্ঠ প্রকৃতি মহামারির মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অরণ্যদেবতা’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, মানুষ তার নিজের কাজে ভীষণ উদ্যত। মানুষ স্বভাবতই পেতে চায়। মানুষের এই অতিরিক্ত লোভই প্রকৃতির প্রধান শত্রু। একদিন অবশ্যই সে তার প্রতিক্রিয়া দেখাবে। প্রতিশোধের তীক্ষ্ন ফলা হয়ে বিদ্ধ করবে মানবসভ্যতাকে। কেননা মানুষ তাদের স্বভাবগত স্বার্থের কারণে মানবকেন্দ্রিক ব্যবহারই করে এসেছে প্রকৃতিকে। রবি ঠাকুরের অনুমানই আজ সত্য নয় কি?
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
জাবি/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন