ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

নবাব ফয়জুন্নেসা কেন অন্তরালে?

সোহাগ মনি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২১, ৪ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নবাব ফয়জুন্নেসা কেন অন্তরালে?

নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী! আমরা অনেকেই জানিনা এই নারী নবাবকে। এই মহীয়সীকে ‘নবাব' উপাধি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ রাণী ভিক্টোরিয়া। আর তিনিও স্বেচ্ছায় এই উপাধি গ্রহণ করেন। কারণ, এটা ছিল তার সমাজ সংস্কারে অবদানের  স্বীকৃতি।

তৎকালীন পুরুষ জমিদাররা তার এই নবাব উপাধি গ্রহণ নিয়ে আপত্তি তোলেন কিন্তু তিনি অবিচল থাকেন তার সিদ্ধান্তে।নামের সাথে যুক্ত হয় ভিন্নমাত্রা, পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থাকে ধাক্কা দেন তিনি।

কুমিল্লার লাকসামে ১৮৩৪ সালে জন্ম ফয়জুন্নেসার,  মাত্র ৬৯ বছরের জীবনে তিনি পাল্টে দিয়ে গেছেন হাজার বছরের ইতিহাস।

ফয়জুন্নেসা ছিলেন হোমনাবাদ পরগনার জমিদার। তিনি তার চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনযোগ দিয়েছিলেন । তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন । তিনি নির্ভীকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।

যখন এই দেশে নারীদের মুখ ফুটে কথা বলাও ছিলো অন্যায়।গৃহকোণে আটকে থেকে জীবনের কোনো রুপ-রস পেতো না নারী।অন্ধবিশ্বাস আর সমাজের চাপিয়ে দেয়া কিছু উগ্র রীতির কাছে পরাজিত নারী সমাজ- ঠিক সে সময়ে নারীর মননে জাগরণ ঘটিয়েছেন তিনি।

ফয়জুন্নেসা ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত জীবনে যে সব কার্যক্রম ও চিন্তা-ভাবনা করে গেছেন তা ওই সময়ের মুসলমান সমাজে ছিলো কল্পনাতীত। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় আবদ্ধ পুরুষ সমাজ সংস্কারকেরা নারী অগ্রগতির কথা তেমন না ভাবলেও তিনি ভেবেছেন। আঘাত করেছেন সমাজের বদ্ধ জায়গাটিতে।

নারী শিক্ষা ও অগ্রগতি সব কিছুতেই তিনি এই দেশের মানুষের কাছে অনুকরণীয়। নারীদের প্রথম স্কুল করেছেন তিনি। মুসলমান হয়েও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে হিন্দুদের জন্যও ছিলো তার সমান দৃষ্টি।

নারী স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি পুরুষদের জন্যও করেন মাদ্রাসা। শুধুই কি স্কুল, নারী শিক্ষা প্রসারে স্থাপন করেন কলেজ। জমিদারির অর্থে নিজ উদ্যোগে খরচ মেটাতেন শিক্ষার্থীদের। তিনি নির্মাণ করেন ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একাধিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে স্থাপন করেন হাসপাতাল।

এছাড়াও রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারেও তিনি রেখেছেন অনন্য অবদান।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে আমাদের ভাবনা কেমন? এই সমাজ, দেশ কতটুকু মূল্যায়ন কিংবা স্মরণ করছে এই নবাবকে? আমাদের এই প্রজন্ম ফয়জুন্নেসাকে নিয়ে কতটুকু জানতে পারছেন? রাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তার ইতিহাস তুলে ধরার জন্য?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুবই হতাশাজনক। উনিশ শতকে যে নারী এই সমাজকে বদলে দিয়েছিলেন, যার সমাজ চিন্তার উপর ভর করে বাংলাদেশের আজকের নারী সমাজ দাঁড়িয়ে- তাকে আমরা অবমাননা করছি না তো ?   

দুর্ভাগ্যজনক যে, কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষই তাকে জানেন না, তার জন্ম কিংবা উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলো সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন। পুরো দেশ তো দূরের কথা, তার নিজের অঞ্চলেই তিনি ম্লান হয়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন।

এর নেপথ্য কারণ, তাকে নিয়ে আমাদের যতটুকু আলোচনা করার দরকার, আমরা ঠিক ততটুকু করছিনা। পাঠ্যপুস্তকে তাকে নিয়ে খুব একটা লেখা হয় না, তার কীর্তিকে তুলে ধরা হয় না, তাকে নিয়ে গবেষণাও নেই। তার জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো আয়োজন কিংবা স্মরণ করিয়ে দেয়ার মতো যেন কেউ নেই!  তার ছবি কোথাও দেখা যায় না, কোনো চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হয় না, তাকে নিয়ে কোনো রচনা প্রতিযোগিতা হয়না!  কেমন যেন ম্লান ফয়জুন্নেসা।

তার সমকালীন সময় কিংবা আরো অনেক পরেও যারা সংস্কার করেছেন তাদের ঠিকই ঘটা করে স্মরণ করা হয়।নানান আয়োজন হয়।অথচ উপমহাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত তিনি। কেন এতো উদাসীনতা তার প্রতি?

আমাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজন তাকে আরও উন্মোচন করা, এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। তাকে পাঠ করতে হবে আমাদের এই সমাজের। নবাব ফয়জুন্নেসার জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী দেশব্যাপী আয়োজন করতে হবে।গবেষণার জন্য এগিয়ে আসতে হবে দেশের বুদ্ধিজীবীদের।এতে অনেক অজানা কিছু বেরিয়ে আসবে যা আজকের এই সমাজবাস্তবতায় কাজে আসতে পারে। পাঠ্যপুস্তকে জানান দেয়া প্রয়োজন তাকে,কেননা প্রজন্ম না হয় স্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে ফেলবে এমন সব মানুষদের।

নবাব ফয়জুন্নেসাকে বাংলার প্রতিটি মানুষ জানুক নতুন ভাবে, চিন্তা করুক তার দর্শন নিয়ে, তার ভাবনা ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হল, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাকা/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়