ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘অ্যানিমেল ফার্ম’ একটি রাজনৈতিক উপন্যাস

মাহমুদুজ্জামান সাহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৯, ৫ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ একটি রাজনৈতিক উপন্যাস

জর্জ অরওয়েলের একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে লেখককে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। কেননা, এটি প্রথম প্রথম কেউ প্রকাশ করতে রাজি হয়নি।

বইটি রচিত হয়েছে মূলত সে সময়কার সোভিয়েত রাশিয়ার সরকার পদ্ধতি নিয়ে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়টিতে ইংল্যান্ড ছিল রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ।

মূল আলোচনা

উপন্যাসটির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই ম্যানর নামের একটি ফার্মের চিত্র। এর মালিক ছিলেন মি. জোনস নামের এক ব্যক্তি। তার ফার্মে ছিল গরু, ভেড়া, পাখি, মুরগি, শূকরসহ আরো অনেক প্রাণী। এই শূকরগুলোর মধ্যে মেজর নামের একটি বয়স্ক শূকর ছিল। এর আহবানে খামারের সব পশুপাখি একটি সম্মিলিত সভায় মিলিত হয়। সেখানে মেজর তার দেখা স্বপ্নের কথা বলে।

সে তার স্বপ্নের ব্যাখায় বলে যে, মানুষ সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী, এরা পশুপাখির শত্রু। কেননা পশুপাখি যা করে, এরা তা করতে পারে না এবং পশুপাখির করা কাজগুলোর ফল ভোগ করে এরা। কিছুই করে না অথচ এরাই প্রাণিকুলের সর্দার হয়ে বসে আছে। এরা পশুপাখিদের দিয়ে কাজ করায় এবং একটা সময় আসে, যখন এরাই আবার বৃদ্ধ হওয়া পশুপাখিগুলোকে বিক্রি করে দেয়।

এখন তাদের করণীয় হচ্ছে, মানুষের নির্যাতন-অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করা। এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং মানুষকে এই ফার্ম থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এই ফার্মটি নিজেদের করে নেওয়া। মেজর সবাইকে এ কথাগুলো বেশ ভালো ভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ‘দু’পায়ে চলা সব প্রাণীই আমাদের শত্রু, চার পায়ে চলা সব প্রাণী আমাদের বন্ধু’। কিছুদিন পর মেজর মারা গেলো।

কিন্তু তার দেখানো বিপ্লবের পথ সবাইকে আকৃষ্ট করে এবং প্রস্তুতি নিতে শুরু করে সবাই। দেখা যায়, একটা সময় তারা তাদের মালিক মি. জোনসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সে ও তার স্ত্রীকে তারা তাড়িয়ে দিয়ে খামারে তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার পরই তারা প্রথমেই খামারের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। পশুদের জন্য সম্মতিক্রমে সাতটি নীতি পাস করা হয় (যেমন-পশুপাখিরা সবাই সমান, কেউ বিছানায় ঘুমাতে পারবে না, অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ ইত্যাদি)।

দেখা যায়, মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে নেপোলিয়ন এবং স্নোবল নামের দুই প্রভাবশালী শূকর। যদিও তাদের মধ্যে ছিল মতাদর্শগত অমিল। প্রথম প্রথম সবকিছু ভালোই চলছিল, হঠাৎ করেই কিছুদিন পর উইন্ডমিল বসানো নিয়ে এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নেপোলিয়ন তার পোষা কুকুর দিয়ে স্নোবলকে তাড়িয়ে দেয়। স্নোবলকে তাড়িয়ে দেয়ার পর নেপোলিয়ন হয়ে উঠে খামারটির একমাত্র নেতা কিংবা শাসক। শুরু হয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নেপোলিয়নের বিশ্বাসঘাতকতা।

সব পশুপাখিকে দিয়ে অমানসিক পরিশ্রম করিয়ে খাবার দেওয়া হয় খুবই অল্প। তারপরও পশুপাখিরা আনন্দে কাজ করে, কেননা এখন তারা স্বাধীন। প্রথম দিকে তারা মানুষের দ্বারা নির্যাতিত হত, কিন্তু দিনশেষে খাবার পেত। যে সাম্যের  আশায় বিদ্রোহ করেছিল তারা, প্রথম প্রথম সেটা ঠিক থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় তা মানুষের শোষণ থেকে আরো খারাপ হয়ে ওঠে। তারপর দেখা যায় সম্মতিক্রমে পাস হওয়া সেই নীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে এবং একটা সময় তা চলে যায় কেবল একটা শ্রেণীর পক্ষে। কেননা, এখানে অন্য পশুপাখিরা সচেতন ছিল না, একটি বিদ্রোহ তখনি সফল হয়, যখন এতে অংশগ্রহণকারীরা সচেতন থাকে। কিন্তু আমরা এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে সচেতন দেখি না।

All animal are equal but some animal are more equal than others. অর্থাৎ, সব পশুপাখি সমান, কিন্তু কিছু পশুপাখি তারা বেশি সমান এবং তারা বেশি অধিকার পাবে।

এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাস। প্রভাবশালী হতে থাকে শূকরশ্রেণী, তারা বিলাসী জীবনযাপন শুরু করে। তারা বিছানা ব্যবহার এবং অ্যালকোহল পানে অভ্যস্ত হতে থাকে। তাছাড়া খামারের সব কাজের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় তাদের। অন্য সব পশু সবাই কাজে ব্যস্ত থাকে। পরিশ্রমী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা খামারের উন্নতি করতে শুরু করে। কিন্তু বিনিময়ে তারা কিছুই পায়নি, পেয়েছে একমাত্র শূকররা। একটা সময় দেখা গেলো, যে প্রবল প্রতাপশালী শাসক নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলা কিংবা বিদ্রোহ শুরু করতে চাইলেই তাদের বিভিন্ন অজুহাতে হত্যা করা শুরু হয় এবং অন্যদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে শাসন কার্য এগিয়ে চলতে থাকে।

বলা চলে, লেখক এখানে বুঝিয়েছেন পশুপাখিদের উপর অত্যাচার কখনো শেষ হয় না, সেটা চলতেই থাকে, হয় সেটা মানুষ দ্বারা অথবা অন্য পশু দ্বারা। এই উপন্যাসে পশুপাখিরা যে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্রোহ করেছিল, আসলে তারা তা পারেনি। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আগের ও পরের সোভিয়েত রাশিয়ার অবস্থা ব্যাখা করেছেন। যে বিপ্লবের মূল কথা ছিল (All Equal) সবাই সমান। রাষ্ট্র সবাইকে সমান সু্যোগ সুবিধা প্রদান করবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সম্ভব হয়নি বলেই লেখক বিভিন্ন রূপক চরিত্র দ্বারা আমাদের তা বুঝানোর চেষ্টা করেছেন।

চরিত্রগুলোর ব্যাখ্যা

ওল্ড মেজর (একটি শূকর) যে প্রথম বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এখানে এই চরিত্রটি দ্বারা মূলত সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রথম স্বপ্ন দেখা কার্ল মার্ক্স এবং লেনিনকে বোঝানো হয়েছে। পরে নেপোলিয়ন নামের চরিত্র দিয়ে লেখক তখনকার রাশিয়ার শাসক স্তালিনকে তুলে ধরেছেন। স্তালিন যেমন রুশ বিপ্লবের নীতি ও আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তেমনি এখানে নেপোলিয়ন পশু বিপ্লবের পর সেই একই কাজটি করেছিল।

স্নোবল হচ্ছে নেপোলিয়নের বিপক্ষে থাকা আরেকটি শূকর। যাকে স্তালিনের বিপক্ষে থাকা আরেকজন তরুণ বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদকে বোঝানো হয়েছে। স্কুইলার ছিল নেপোলিয়নের খুব কাছের এবং নেপোলিয়নের সব কর্মের ব্যাখাদানকারী। এখানে তাকে রাশিয়ার তখনকার সব পত্রিকা বোঝানো হয়েছে।

উপন্যাসে আমরা দেখি একটি পরিশ্রমী চরিত্র বক্সার, যে কিনা একটি ঘোড়া, যাকে দিয়ে লেখক তখনকার রাশিয়ার শ্রমজীবী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করিয়েছেন এবং নেপোলিয়নের কুকুরগুলো দ্বারা স্তালিনের গোপন গোয়েন্দা বাহিনীর কথা বলা হয়েছে। অন্য চরিত্রগুলো দিয়ে তখনকার জার্মানিসহ অন্য দেশ এবং অন্য ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে।

মূল্যায়ন

অ্যানিমেল ফার্ম একটি রূপক রাজনৈতিক গল্প বলা যায়। বলা যায়, একটি ভালো গল্পের উপন্যাস। যার আক্রমণ খুবই জোরালো। অরওয়েল এখানে রুশ বিপ্লবকে ইঙ্গিত করেছেন এবং এর পরিণতিকে ব্যঙ্গ করেছেন, যেটা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে লেখক সফল হয়েছেন।

বইটির কাহিনীর মাধ্যমে লেখক সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য এবং পরবর্তী সরে আসাকে দেখিয়েছেন। কেনই বা সাম্যতা অর্জনের এই বিপ্লব ব্যর্থ হয়, কেনই বা নেপোলিয়ন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। বইটি পড়লে জানতে পারবেন সবকিছুই। এটি পড়তে গিয়ে ভীষণ ভালো লেগেছে আমার। এটা বলা যায়, সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম একটি বই।

বই পর্যালোচক: শিক্ষার্থী, পলিটিকাল সায়েন্স, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


শাবিপ্রবি/শরিফুল/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়