আজ প্যারিসে প্রেম নেই
সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম
ছবি: মাহমুদ সাকী
প্যারিস রোড। নাম শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, ফ্রান্সের সিন নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্যারিসের কোনো রাস্তার কথা। না, ফ্রান্সের প্যারিস নয়। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড। যে রাস্তা ঘিরে রয়েছে হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকার স্মৃতি। শত শত প্রেম নিবেদনের সাক্ষী রাস্তার দু’ধারে আকাশচুম্বী গগন শিরীষ গাছগুলো। সঙ্গীর হাত ধরে এ রাস্তায় হাঁটেননি, রাবিতে এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কিন্তু আজ সেই প্যারিস রোডে নেই কোনো প্রেম, ভালোবাসা বা গানের শব্দ। নেই বন্ধুদের সাথে গলা ফাটানো গান, নেই প্রেমিকযুগলও। কোলাহলমুক্ত, জনশূন্য, নিষ্প্রাণ আজ সেই রাস্তাটি। সব কিছু যেন হারিয়ে গিয়েছে কোনো এক মহামারির অতল গভীরে। বলছি, করোনা মহামারির কথা। এর কারণে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাস বন্ধ। আবাসিক হলগুলোও বন্ধ। ফলে আজ ক্যাম্পাসে নেই কোনো শিক্ষার্থীদের বিচরণ। তারা আজ ঘরবন্দি।
বিকেল হলেই রাস্তাটির সৌন্দর্য মুহূর্তেই নজর কাড়ে সবার। কেউ যদি প্রেমিকার হাত ধরে হাঁটতে চান, ছবি তুলতে চান কিংবা ক্যাম্পাসের কোথাও ঘুরতে চান, তাহলে সবার আগেই বেঁছে নেন এই পিচঢালা সুদীর্ঘ রাস্তাটি। হয়তো ভাবছেন, রাস্তাটির নাম ‘প্যারিস রোড’ কেন হলো? এর পেছনে রয়েছে ছোট্ট একটি ইতিহাস।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম শামসুর হক ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফিলিপাইন থেকে গগন শিরীষ গাছের চারা নিয়ে আসেন। পরে ক্যাম্পাসের কাজলা গেট থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত এ গাছগুলোকে রোপণ করা হয়। ধীরে ধীরে গাছগুলো রাস্তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলে। ফলে রাস্তাটির সঙ্গে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তাগুলোর সঙ্গে তুলনা করে এর নামকরণ করা হয় ‘প্যারিস রোড’।
এছাড়া ক্যাম্পাস খোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিচ্ছে ছুটির সময়। কয়েক ধাপে ছুটি পিছিয়ে হয়তো ঈদের আগে আর আসা হবে না কারো। ঘরে বন্দি সময় যেন কোনোভাবেই পার হচ্ছে না। তাদের হয়তো ইচ্ছে করছে ছুটে যেতে, দেশের সব ‘লকডাউন’ পেরিয়ে ফিরে আসবে ক্যাম্পাসে। কিন্তু ‘করোনা’ নামক অদৃশ্য শিকলে পা আটকে আছে সবার।
এদিকে, নির্জন ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ পেয়ে প্রকৃতি সেঁজেছে এক অপরূপ সাজে। যেন গায়ের পুরনো পোশাক পরিবর্তন করে নতুন পোশাকে আচ্ছন্ন হয়েছে গাছগুলো। শুকনো পাতা ঝরে গজিয়েছে নতুন কচি কচি পাতা। আর সেই নতুন প্রকৃতি পেয়ে মনের সুখে ও প্রেমের সুরে গান ধরেছে পাখিরা। তাদের কিচিরমিচির শব্দে চারদিক যেন জমজমাট গানের আসর।
গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে কাঠবিড়ালী, কাঠ ঠুকছে কাঠ-ঠুকরা। বড় বড় গাছের শাখা ধরে ঝুলছে বাদুরের দল। অতিথি পাখিগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পড়ছে পুকুরে। খেলা করছে মনের আনন্দে। বসন্ত নেই, তবুও নিজের মতো করে জায়গা দখল করে আছে তারা। এ যেন এক স্বর্গের রাজ্য। আর এ রাজ্যের রাজত্ব শুধু পশু-পাখি ও গাছ-গাছালিদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদ সাকী। অসময়ের এ ছুটিতে বাড়িতে যাননি। ক্যাম্পাসের এমন প্রকৃতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবে ক্যাম্পাস বন্ধ। বাড়িতে সময় পার করছেন শিক্ষার্থীরা। তাই পুরো ক্যাম্পাসটাই আজ ফাঁকা পড়ে আছে। প্যারিস রোডটি প্রেম খুঁজে বেড়াচ্ছে। শূন্যতায় হাহাকার করছে রাস্তাটি। ইবলিশ চত্বরের ওপাশটায় কেউ নেই। বিকেলটা একেবারে নিরস-নিস্তব্ধ। অথচ কিছুদিন আগেও এ রাস্তায় প্রেমিকার হাত ধরে হেঁটেছেন বহু প্রেমিক পুরুষ। কিন্তু আজ আর কাউকে দেখা যায় না। শুধু শূন্যতা বিরাজ করছে ক্যাম্পাসে।’
ফারজানা ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরে ক্যাম্পাসের চেহারা দেখি না। প্যারিস রোডে হাঁটা হয়নি। বাড়িতে বসে একেবারেই সময় যাচ্ছে না। বন্ধুদের ছেড়ে এসেছি অনেক দিন হলো। কবে যে আবার একসঙ্গে বসে আড্ডা দেবো! ফেসবুকে ফাঁকা ক্যাম্পাসের কিছু ছবি দেখেছি। দারুণভাবে সেঁজেছে সে। আশা করি, শীঘ্রই আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে যাব। আর সবাই যাতে প্রাণঘাতী করোনার হাত থেকে রক্ষা পায়, সেই প্রার্থনা করি।’
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাবি/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন