ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অনলাইন ক্লাস: কী ভাবছেন যবিপ্রবিয়ানরা?

সজীবুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪২, ৭ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনলাইন ক্লাস: কী ভাবছেন যবিপ্রবিয়ানরা?

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই আছে এইচএসসি পরীক্ষা। সেশন জটের আশঙ্কায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস নেওয়ার দিকে ঝুঁকছে। অনলাইন ক্লাস করা নিয়ে কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা? এই বিষয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতামত লিখে পাঠিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজীবুর রহমান।

মেহেদী হাসান, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

বর্তমানে ছোট বাচ্চাদের জোর করে এক গ্লাস দুধ গলাধঃকরণ করার মতো শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘অনলাইন ক্লাস’। এক গ্লাস দুধ জোর করে গলাধঃকরণ করাতে পারলে এর কিছু পুষ্টিগুণে বাচ্চারা উপকৃত হলেও, জোর করে এই অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত বা তাদের ক্ষতি হবে অনেক প্রশ্ন থেকে যায়।

এটি যে চোখে শর্ষে ফুল দেখতে দেখতে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুরুতে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নেয়, যার পুরোটাই টিউশন ফি নেওয়ার জন্য। কারণ, তাদের অনলাইন ক্লাস ও তাড়াহুড়া করে নেওয়া অনলাইন পরীক্ষায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী কপি পেস্ট করে পরীক্ষা দেয়। এর প্রমাণ আমি নিজেই পেয়েছি। তাহলে, এই অনলাই ক্লাস নিয়ে কেমন গ্র্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে? এর কিছুদিন পরেই তারা শুরু করে টিউশন ফি এর চাপ। শিক্ষার্থীরাও নিজ সার্টিফিকেট বাঁচাতে বাধ্য। এছাড়াও তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তারপরও না হয় তাদের পরিবারের সক্ষমতা আছে, সবার ল্যাপটপ বা ভালোমানের একটি মোবাইলও আছে।

কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমনটি নয়। এখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরিবার নিম্ন-মধ্যবিত্ত, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। একদিক দিয়ে যেমন সবার অনলাইনে ক্লাস করার মতো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নেই, আবার অন্যদিক দিয়ে যাদের আছে, তাদের বেশির ভাগের বাসা গ্রাম অঞ্চলে। যেখানে অনলাইন ক্লাসের মতো ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় অনলাইন ক্লাস শুরু করলে একটা শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টি হবে। এক কথায়, যাদের দামি ফোন বা ল্যাপটপ আছে এবং শহর এলাকায় বাসা সে সুযোগ পাবে এবং অন্যরা পাবে না। এখানে দোষ কার হবে?

নাজমুল হোসাইন, এগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং টেকনোলজি বিভাগ

আমাদের দেশে নয়, পুরো বিশ্ব আজ এই করোনাকালীন দুঃসময় অতিক্রম করছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পক্ষে যাচ্ছে। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস নেওয়া কতটুকু যুক্তিসম্মত তা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের দেশের লকডাউনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি অনলাইনে ক্লাস নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা প্রয়োজন।

শুধু গাছের মাথায় পানি দিলে হবে না, গাছের শিকড়েও পানি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। তারপরও আমরা জানি এই দুঃসময়ে মানুষ যেখানে প্রতিদিনের খাবার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে একজন গরীব ঘরের সন্তান ইন্টারনেট ক্রয় করে কীভাবে অনলাইন  ক্লাসে যোগদান করবে? তা নিয়েও আমাদের ভাবা উচিত। আরেকটি প্রশ্ন ও থেকে যায় ইন্টারনেট ক্রয় করতেও কিন্তু বাইরে যাওয়া লাগবে মোবাইলে টাকা লোড দেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে ঘরের বাইরে বের হতে হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে শিক্ষার্থীরা বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। সেক্ষেত্রে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা বেশি রয়েছে।

এর একটি সমাধান হতে পারে, সব শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা ফ্রি করে দেওয়া হোক, তাহলে হয়তো বা এই সমস্যার অবসান হতে পারে। কিন্তু আরেকটি বড় সমস্যা থেকেই যায়, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত আছে, তারা এই অনলাইন ক্লাস শুরু হলে বিপাকে পড়বে।

আবু বকর সিদ্দিক, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গ্রাম এবং মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই আসে। আমরা সবাই জানি, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। আর জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে তাদের অর্থনৈতিক এবং মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ এখন ধান, ভুট্টা ইত্যাদি ফসল কাটার মৌসুম। এমতাবস্থায় অধিকাংশ মানুষ লকডাউন আর বৈশাখের বৈরি আবহাওয়াতে উদ্বিগ্ন, আবার দাম পাচ্ছে না ফসলের। অনেক ছাত্রই এখন পরিবারের সাথে এইসব কাজে সাহায্য করছে, এখন যদি এই অনলাইন ক্লাসের পাল্লায় পড়ে, তাইলে এই সাহায্যটুকু তারা পরিবারকে করতে পারবে না।

অনেকের মনে হতে পারে ক্লাস তো দিনে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা হবে, বাকি সময়টা অন্য কাজগুলোতে দাও। কিন্তু ক্লাসগুলো প্রত্যেক শিক্ষকই নিবেন তাদের সুবিধামতো সময়ে, তাহলে কী করে সম্ভব? গ্রামে অনেকে মোবাইলে কথা বলার জন্য ঘরের বাইরে আসতে হয়, আর অনলাইনে ক্লাস তো অনেক দূরের বিষয়। তাই আমি মনে করি, এই করোনাকালীন অনলাইন ক্লাস না নেওয়াই ভালো।

তাইয়েবা করিম তুবা, রসায়ন বিভাগ

করোনাভাইরাস ঠেকাতে সমগ্র দেশে লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সেশনজটের আশঙ্কা রয়েছে। সেশনজট আটকাতে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস ও পরীক্ষার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০ শতাংশ গ্রামের হওয়ায় তাদের পক্ষে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক পাওয়াই দুঃসাধ্য। এছাড়া নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক সমস্যা থাকায় তাদের অনেকেরই কম্পিউটার বা স্মার্টফোন নেই, তাদের পক্ষে ইন্টারনেট কিনে ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অসম্ভব।

আমরা যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ি, যাদের প্রতি সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই ব্যবহারিক ক্লাস থাকে। অনলাইনে ব্যবহারিক ক্লাস করা সম্ভব নয়। তাই আমার মনে হয় ইউজিসির এই সিদ্ধান্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

 

যবিপ্রবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়