ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘আপনার ক্লাস করা হলো না স্যার’

সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৪, ৮ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আপনার ক্লাস করা হলো না স্যার’

বনভোজন ২০১৯। গিয়েছিলাম কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে। নাচ-গান শেষে গন্তব্যে এসে বাস থেকে নামলো সবাই। বনভোজন স্বার্থক করতে বেড়িয়ে পড়ি কুঠিবাড়ি দর্শনে। যে যার মতো ঘুরছে, ছবি তুলছে, আবার অনেকেই সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। দুপুরের কড়া রোদে শুরু হলো অনুষ্ঠান। সবার চেহারায় তখন ক্ষুধার ছায়া। সেদিন হৈ-হুল্লোড় ও নাচ-গানে হেরেছিল ক্ষুধা, মেতেছিল শিলাইদহ। আশেপাশে সবাইকে দেখেছিলাম, কিন্তু চোখে পড়েনি শুধু একজন মানুষকে।

বলছিলাম সবার প্রিয় শিক্ষক মাহবুবুর রহমান রাসেল স্যারের কথা। তিনিও সেদিন ব্যস্তই ছিলেন। তবে, সেই ব্যস্ততা শুধু তার ক্ষুধার্ত শিক্ষার্থীদের মুখে দুপুরের খাবার তুলে দেওয়ার ব্যস্ততা। খাবার প্রস্তুত হওয়ার কথা শুনে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হলো। শুরু হলো খাবার বিতরণ। স্যার ছুটছেন এদিক-ওদিক। কে খাবার পায়নি, কার কোথায় কম হয়েছে, কে বসার জায়গা পাচ্ছে না, কে এখনো খেতে আসেনি, সব খোঁজ নিচ্ছেন যেন একাই। একে একে সবার খাওয়া শেষে খেয়েছেন এই মানুষটি। এটাই যে তার শেষ বনভোজন, হয়তো স্যার জানতেনই না।

স্যারকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল একবার। তখন বিভাগে অন্তঃকক্ষ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছিল। ব্যাডমিন্টনে তিনি ছিলেন বিভাগের একক চ্যাম্পিয়ন। স্যারের বিপক্ষে কারো বিজয়ী হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তখনও। টুর্নামেন্ট শেষের দিকে। সেবার দ্বৈত ক্যাটাগরিতে স্যারের দলের বিপক্ষে ফাইনালে নামি আমি আর আমার বন্ধু সোহেল। খেলা দেখে নিজেই দর্শকের মতো তাকিয়ে ছিলাম স্যারের দিকে। স্ম্যাশ করার সাথে সাথেই হাত উঁচু করে বিনয়ের সুরে বলে ওঠতেন, ‘সরি, বাবা’। মুখে সব সময় ‘বাবা’ শব্দটি যেন এসেই থাকতো। সেবার স্যারের সঙ্গে হারার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মনে আছে, সেদিন স্যার বলেছিলেন, ‘এই টুর্নামেন্ট-ই শেষ। বিভাগের টুর্নামেন্টে আর অংশগ্রহণ করবেন না।’ ঠিকই আর খেলা হলো না।

স্যারের সঙ্গে খুব একটা সখ্যতা ছিল না। কারণ, তখন মাত্র প্রথম বর্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন, আর বিভাগেও। তৃতীয় বর্ষ থেকে শুরু করে সিনিয়রদের ক্লাস নিতেন স্যার। তাই যারা প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ছিলাম, তাদের সৌভাগ্য হয়নি স্যারের ক্লাস করার। কয়েক মাস ক্লাস করার পর সিনিয়ররা জিজ্ঞেস করতো, কার কার ক্লাস ভালো লাগে? উত্তরে একেকজন একেক স্যারের নাম বলতাম ও ক্লাসের নানা অনুভূতি প্রকাশ করতাম।

তখন তারা বলতেন, তোরা তো এখনো রাসেল স্যারের ক্লাসই পাসনি। স্যার সবসময় হাসেন। হেসে হেসে গল্পচ্ছলে ক্লাসের পড়া শেষ করেন। কখনো কেউ এই ক্লাসটি বিরক্ত অনুভব করেনি। আর ক্লাসের শুরুতে যদি কাউকে দেখে মনে হতো তার মন ভালো নেই, তাহলে তার সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করতেন। মুহূর্তেই তাকে উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করে আবার ক্লাসে মনোযোগী করে তুলতেন। এছাড়া স্যার প্রশ্ন করার বিষয়ে উৎসাহিত করেন বেশি। স্যারের ক্লাস জীবনবোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। জীবনে বাস্তবতার বোঝাপড়া কীভাবে সামলে নিতে হয় তাও তিনি শিয়েছেন। তাই যারা অন্য ক্লাসে অনুপস্থিত, তারাই স্যারের ক্লাসে প্রথম সারিতে উপস্থিত থাকতো। কেউ এই ক্লাস মিস করতো না।

স্যারকে ঘিরে বড় ভাই-বোনদের এত শত স্মৃতির গল্প শুনে স্যারের ক্লাস করার আক্ষেপ দিন দিন বেড়েই চলেছিল। একদিন স্যারের সাথে আমাদেরও সখ্যতা গড়ে ওঠবে। সাক্ষী হবো শত শত স্মৃতির। আর সেগুলো লেখা থাকবে মনের ডায়েরিতে। সেই ভেবে অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম আমরা।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! হঠাৎ গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুনি আমাদের রাসেল স্যারের ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে বিভাগের শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে স্যারের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে স্যারকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। সবাই প্রার্থনা করছে, স্যার যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। সেই প্রত্যাশায় শুধু অপেক্ষা, আর অপেক্ষা।

প্রায় সাত মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত ৫ মে দুনিয়া ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন সবার প্রিয় এই শিক্ষক মাহবুবুর রহমান রাসেল। শোকের ছায়া নেমে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সেই যে ঢাকা গিয়েছেন আর আসেননি রাজশাহীতে। আর কখনো ফেরা হবেও না। হয়তো সেদিন সবাই ক্যাম্পাসে থাকলে কান্নার ঝড় বয়ে যেত বিভাগে। একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো, স্মৃতির বিলাপ হতো সেদিন। করোনা পরিস্থিতির কারণে একসঙ্গে নেই কেউ। স্যারকে দেখতেও যাওয়া হলো না। এ যেন কষ্টের গভীরতা আরও দ্বিগুণ করেছে। আর বিভাগ হারিয়েছে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।

আর আমাদের ক্লাস করার যে আক্ষেপ, সেটির কী হবে? স্যার তো ফিরবেন বলেই আশায় ছিলাম। দেখা হবে বলেই ভেবেছিলাম। স্যার এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, তা কেউ ভাবেনি হয়তো। পেলাম না স্যারের একটি ক্লাসও। খুব বলতে ইচ্ছে করছে, ‘স্যার, আপনার ক্লাস করার সৌভাগ্য হলো না। একটা ক্লাস কি নেবেন?’ স্যার কি শুনবে?

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


রাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়