ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘আমাদের কিছু ভ্যাকসিন মানব’

হুসাইন আহমেদ সৌরভ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৫, ১৪ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘আমাদের কিছু ভ্যাকসিন মানব’

করোনার প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্ত, মানুষের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত। হাহাকার দেশে-দেশে, নগরে-নগরে, প্রতিটি জনপদে। ভয় ঘিরে আছে মানুষের জীবন। সবাই অপেক্ষা করছে কোনো এক পূর্ণাঙ্গ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন, সফল ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের, যার ব্যবহারে মহামারি থেকে মিলবে মুক্তি।

তবে যতক্ষণ না করোনার সফল ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষণ করোনা রোগী এবং আতঙ্কিত সব মানুষের পাশে ভ্যাকসিন-মানব হয়ে দাঁড়িয়েছেন আমাদেরই কেউ কেউ। তাদের সহযোগিতায় আমরা প্রবল অন্ধকারেও খুঁজে পাই আলোর দিশা।

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে ডাক্তারদের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তারা জ্বর, কাশির রোগী দেখছেন না, অনেকেই চেম্বার বন্ধ করে চলে গেছেন স্বেচ্ছা-কোয়ারেন্টাইনে। এমন সব অভিযোগ থাকলেও আমাদের ভরসার জায়গায় ডাক্তাররাই আছেন। সারাবিশ্বের মতো আমাদের ডাক্তাদেরও পিপিই সংকট। তবুও তারা থেমে নেই। রোগীদের সেবা দেওয়াকে তাদের ধর্ম জেনেই বেশির ভাগ ডাক্তার কাজ করে যাচ্ছেন।

এ পর্যন্ত অসংখ্য ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মোট শনাক্ত রোগীর ১১ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান পেশায় নিযুক্ত। চিকিৎসার এ মহান ব্রত পালন করতে গিয়ে গত ১৫-এপ্রিল সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মইনউদ্দিনকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। তিনিই প্রথম করোনায় আক্রান্ত ডাক্তার মৃত্যুবরণ করেন। আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজের হেমোটোলজিস্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কর্নেল (অব) মো. মনিরুজ্জামানকেও উৎসর্গ করতে হয়েছে নিজের জীবন। ডাক্তার মশিউর রহমান করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে স্বেচ্ছায় নারায়নগঞ্জের হাসপাতালে বদলি হয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ডাক্তারের ছোট্ট সন্তানকে তার পিতার পা ধরে বসে থাকতে দেখা গেছে। এই যে পিছুটান, এই ভালোবাসা উপেক্ষা করে এমন অনেক ডাক্তার দিন রাত ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে গেছেন। তাদের নিজের ও পরিবারের জন্য শঙ্কা, এত সবের মাঝেও তারা রোগীদের সেবা দিয়ে প্রমাণ করেছেন, ভ্যাকসিন হয়ে তারাও লড়তে জানেন।

লকডাউনকে পূর্ণরূপে কার্যকর করতে আমাদের পুলিশের তৎপরতা প্রশংসার দাবি রাখে। দায়িত্ব পালনকালে এখন পর্যন্ত ১৮৭৮ জন পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মোট করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৮৬৫ জন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদস্য। এর মধ্যেই মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত সদস্য। বর্তমানে ৪৯৬১ জন পুলিশ সদস্য কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ১১৫৯ জন আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

জননিরাপত্তা, জনসমাগম রোধে তারা প্রথম থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। দেশব্যাপী সাধারণ ছুটিকে কিছু মানুষ মোক্ষম সুযোগ ভেবে যত্রতত্র গমন করে যখন করোনা ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। উপযুক্ত কারণ দেখাতে না পারলে এসব মানুষকে কোথাও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এত এত মানুষের সংস্পর্শ পুলিশদের আক্রান্ত করছে বেশি মাত্রায়।

তাছাড়া আসামি ধরা, করোনার লাশ দাফন, রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা- সব দায়িত্ব পুলিশকে পালন করতে হয়৷ ৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জেই র‌্যাবের ৫৫ সদস্য করোনা আক্রান্ত।

সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত ছুটছেন সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন তারাও, আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তবুও মানুষকে সঠিক তথ্যটি দেওয়া আর সচেতন করাই যেন তাদের ব্রত। এ ব্রত পালন করতে গিয়ে ৭ মে পর্যন্ত ৬৫ জন সংবাদকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর এরই মধ্যে একজন মারা গেছেন। আরেকজন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। মারা যাওয়া এই দুইজন দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার। এই পত্রিকার আরও ৫ জন করোনা সংক্রমণ নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

লকডাউনের এ সময়টায় এক বিশেষ পেশার মানুষের প্রচ্ছন্ন ক্ষমতার কথা সবার চোখেই ধরা দিচ্ছে। যাদেরকে শেকড় গণ্য করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সভ্যতার এই মহীরুহে। তারা কৃষক, সব সাধকের বড় সাধক। মহামারিকে কেন্দ্র করে সব সাধারণ মানুষের মনে এক আসন্ন দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষের ভয়। সব কর্মক্ষেত্রে যখন শৈথিল্য নেমে এসেছে, তখনও আসন্ন সংকট চিন্তা দূর করতে তাদের মাঠের কাজ বন্ধ হয়ে নেই।

আমাদের প্রধান চিন্তা যে খাবারকে ঘিরে, তার আঞ্জাম দিতে কৃষকই চূড়ান্ত ভরসা, তা যেমন অন্য সময়ে সত্য, সত্য মহামারির এ সময়ে। ধান নিয়ে নেতাদের ফটোসেশনের এ সময়ে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম চারদিক থেকে প্রশংসা কুড়োচ্ছে। কৃষকের ধান কেটে ঘরে তোলার কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে তাদের সহযোগিতা উল্লেখ করার মতো।

আর সেচ্ছাসেবীদের কথা না বললেই নয়। মহামারির এ সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে, নগরে সবাই যখন মহামারি থেকে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত, তখনও এগিয়ে আসছেন সেচ্ছাসেবীরা। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের সংকট নিরসনে তাদের ভূমিকা ভ্যাকসিনের মতোই। সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তারা। ‘আপনারা ঘরে থাকুন, আমরা বাইরে আছি’- এ বিষয়টাকে বুকে ধারণ করে তারা অগ্রগামী হয়েছেন দেশের করোনা সংকট মোকাবিলায়।

সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই করোনা মহামারি থেকে উত্তরণ ঘটবে। কিন্তু, এ ভ্যাকসিন মানবদের অবদান আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, আমাদেরকে আসন্ন সব দুর্যোগে মানবতা ও মহানুভবতা শেখাবে। আমাদেরকে সহায়তা করবে ভ্যাকসিনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

কুবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়