ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘উত্তরাধিকার’ এক বিস্তৃত সময়ের গল্প

আনিকা তাসনিম সুপ্তি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ২৩ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘উত্তরাধিকার’ এক বিস্তৃত সময়ের গল্প

দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের অসাধারণ এক সৃষ্টি ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাস। প্রথমে এই উপন্যাসটি কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো, যা পরে বই আকারে বের হয়। বইয়ের মূল চরিত্র অনিমেষ। ‘উত্তরাধিকার’ অনিমেষের শৈশব থেকে তারুণ্যে পদার্পণের গল্প।

অনিমেষের রাজনৈতিক মতাদর্শের সূচনাটা মূলত এই বইতেই। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে সমরেশ মজুমদার লিখেছেন কালবেলা ও কালপুরুষের মতো কালজয়ী উপন্যাস। ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছে ডুয়ার্সের চা বাগান এবং জলপাইগুড়ি শহর।

শান্ত নিরিবিলি স্বর্গছেঁড়া চা বাগান, ওপারে খুঁটিমারির জঙ্গল, এপারে আঙরাভাসা নদী, মাথার ওপরে ভুটানের পাহাড় থেকে ভেসে আসা বিষণ্ন মেঘের দল, মাঠ পেরিয়ে আসাম রোড, মদেসিয়া কুলিদের লাইন এই সব কিছু জুড়েই অনিমেষের শৈশব। ‘উত্তরাধিকার’ নিয়ে কিছু বলার শুরুতেই স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের এই প্রশান্ত রূপটা চোখের সামনে ছবির চেয়েও বাস্তব রূপে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।

চা বাগানের রাস্তায় ছুটে বেড়ানো শিশু অনিমেষ একটু একটু করে বড় হতে থাকে। চা বাগানের ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরি করা তার দাদা সরিৎশেখরের পরিচিতির সুবাদে সেও চা বাগানে বড়বাবুর নাতি বলেই পরিচিত। তখন ছিল এক অস্থির সময়, যখন সবেমাত্র ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্কুলে অনিমেষের হাতেই প্রথম পতাকা উত্তোলন হয়। শিশু অনিমেষের মনে দেশপ্রেমের বীজ বপনের শুরু সেখানেই।

অনিমেষকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দাদা সরিৎশেখরের, যা উত্তরবঙ্গের এই স্বর্গছেঁড়ার চা বাগানে পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই অবসরগ্রহণের পর বিধবা মেয়ে হেমলতা ও অনিমেষকে নিয়ে জলপাইগুড়ির নতুন বাড়িতে শুরু করেন নতুন জীবন। জলপাইগুড়ি- যেখানে অনিমেষ বাস্তবতার প্রথম স্বাদ পায়। চা বাগানের স্নিগ্ধ পরিবেশে জন্মানো ও শৈশব কাটানো কোমল হৃদয়ের অনিমেষ যেন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সবচেয়ে আপন মানুষ মা মাধুরী, যার কাছে ছোট্ট অনিমেষ অকপটে সব বলতে পারত, আর বাবা মহীতোষ, যার সঙ্গে আপাত দূরত্বের সম্পর্ক, অবাঙালি ঝাড়িকাকুর স্নেহ, ভবানী মাস্টার, বিশু বাপীর সঙ্গে ছুটে বেড়ানো, খেলার সাথী সীতা, যাকে অনিমেষ মনের মধ্যে গোপনে ধারণ করে- সবকিছুকে পেছনে রেখে জলপাইগুড়ি শহরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করে অনিমেষ।

নতুন জীবনের শুরুতেই ঘটে দুর্ঘটনা। অনিমেষের মা মাধুরীর অকাল মৃত্যুতে সবাই তখন দিশেহারা। ফেলে আসা স্বর্গছেঁড়ার স্মৃতির তাড়না আর মায়ের শূন্যতায় পিসিমার আঁচলে সর্বোচ্চ আশ্রয় পায় অনিমেষ। দাদুর কঠোরতা ও দৃঢ়তার আদর্শের মাঝে একটু একটু করে এগিয়ে চলে সে।

পরিচিত হতে থাকে নতুন নতুন চরিত্রের সাথে৷ রম্ভা, উর্বশী, মেনকা, মুভিং ক্যাসেল, তপুপিসী- এমন বিচিত্র সব নারীর সংস্পর্শে আসে, যারা সবাই কাছাকাছি থেকেও ভিন্ন জীবনধারার ভিন্ন মতাদর্শের এবং তারা সবাই তার জীবনে শিক্ষণীয় প্রভাব ফেলে৷ বিরামবাবু, নিশীথবাবু, প্রিয়তোষ- যাদের কাছে তার রাজনীতির হাতেখড়ি, রাজনীতির আড়ালের রূপ দেখা। স্কুলের বন্ধু মন্টু, তপন- যাদের কাছ থেকে জীবনের অনেক অপ্রিয় বিষয়ের ধারণা পায় সে। অনিমেষ তার নতুন পরিবেশ আর জীবনের বয়ঃসন্ধিতে এসে যেন একসাথে বহু বিষয়ের প্যাঁচে পড়ে যায়। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, পারিবারিক কলহ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনীতি সব কিছুর ছোঁয়া একসাথে পেতে শুরু করে কিশোর অনিমেষ।

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য এত দিনের অপেক্ষা! বাস্তবতার নিষ্ঠুর ধাক্কায় উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত কিশোর থেকে তরুণ হয়ে ওঠে অনিমেষ, আছড়ে পড়ে কলকাতার উত্তাল রাজপথে, যেখানে আগামী দিনের জন্য সবার অধীর অপেক্ষা।

স্বর্গছেঁড়া-জলপাইগুড়ি-কলকাতা। লেখক দক্ষতার সাথে অনেকগুলো জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বিপন্ন অস্থির উত্তাল এক সময়ের গল্প বলে গেছেন, অনিমেষের বেড়ে ওঠার গল্প বলেছেন।

জন্ম থেকেই পরিবারের যে মানুষগুলোকে ঘিরে অনিমেষ বড় হয়েছে, কালের পরিক্রমায় জীবনের বাঁকে বাঁকে তাদের নিজেদের মধ্যকার বাঁধন আলগা হয়েছে, অনেকে সেই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, কেউ সাময়িকভাবে কেউ বা চিরতরে। যারা আছে ক্লান্তি এসে ভর করেছে তাদের প্রত্যেকের উপর। বুকে আগলে তিলতিল করে মানুষ করেছেন যারা অনিমেষকে, সময়ের সাথে তাদের পরিবর্তন খুব চোখে পড়ার মতো - শেষকালে এসে বিষণ্ন, জরাগ্রস্ত, অতীত জীবনের নেশায় বুঁদ তারা এক অজানা অপেক্ষায়। পরিবারের বাইরে গিয়েও অন্য যেসব চরিত্র তারা কেউই অপ্রয়োজনীয় নয়। চরিত্রগুলোর স্থায়িত্ব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও প্রতিটি চরিত্র অনুভূতির ভেতর নাড়া দিয়ে যায়।

রাজনীতি নিয়ে আছে অনেক আলোচনা অনেক দ্বিধাদ্বন্দ অনেক ঘৃণা অনেক সম্ভাবনা, যদিও সব কিছু অনিমেষের অনভিজ্ঞ চোখ দিয়েই দেখতে হবে এবং তার কৌতূহল আর দ্বিধাদ্বন্দে ভোগা মন দিয়েই পড়তে হবে৷ কংগ্রেস আর কম্যুনিস্ট পার্টি, তৎকালীন বড় বড় নেতাদের প্রভাব, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর গোপন মিটিং, সংগ্রাম, ক্ষমতায় থাকা দলের দেশের স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা সব কিছু মিলে যেনো তালগোল পাকিয়ে যায় অনিমেষের সাথে পাঠকেরও।

অনিমেষ নিজেকে বারবার নিজের প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বুকের ভেতর ফুলে ফেঁপে উঠা যে দেশপ্রেম সেটি প্রমাণের শ্রেষ্ঠ উপায় কি শুধুই নির্বিকার থাকা? নাকি নিজের দেশপ্রেমের উর্ধ্বে গিয়ে দেশপ্রেমের সাথে স্বার্থকে গুলিয়ে ফেলে তা তুলে ধরার চেষ্টায় নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া! এইসব প্রশ্নের দোলাচলে পরিচিত কিছু মানুষকেই যেন মাঝে মাঝে অপরিচিত বলে মনে হয়।

এসব প্রশ্ন শুধু অনিমেষের নয়, পাঠকের মধ্যেও জাগ্রত হতে বাধ্য। যে পরিস্থিতির মধ্যে অনিমেষ নিজেকে আবিষ্কার করে, সেটি অপরিচিত নয়। কারণ, জীবনের কোনো একপর্যায়ে আমরা সবাই এই পথ অতিক্রম করি। লেখকের স্বতঃস্ফূর্ত লেখায় ধাপে ধাপে ছোট ছোট ঘটনার উপর ভিত্তি করে উঠে আসে অনিমেষের মানবিক গুণাবলির চর্চা, ভালো মন্দের পার্থক্য করতে শেখা, নিজের একটি পরিচয় গড়ে তুলবার প্রচেষ্টা, ঘাবড়ে গিয়েও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জনে পিছু হটে না অনিমেষ। এই কাহিনী এক তরুণের আত্নজিজ্ঞাসার কাহিনী, আত্ন- অনুসন্ধানের কাহিনী।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।


কুবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়