ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বিকল্প বাহনের খোঁজে

সাফায়িত সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২৩ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বিকল্প বাহনের খোঁজে

ছবি সংগৃহীত

পৃথিবীটা হয়তো বড্ড ক্লান্ত। এই ক্লান্ত শরীরের উপর পেট্রোল-ডিজেল পুড়িয়ে আর ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলেছে শত-সহস্র বাহন৷ কারো শেষ তো কারো শুরু।

এই পথচলার যেন বিরাম নেই। ক্লান্ত-শ্রান্ত পৃথিবীতে এখন আবার দেখা দিয়েছে নতুন অসুখ। লোকে তার নাম দিয়েছে করোনাভাইরাস, ডাকনাম কোভিড নাইনটিন। তবে এই অসুখে হয়তো পৃথিবীর ভিন্ন সুখ খোঁজে নেওয়ার সুযোগ আসবে৷ কারণ সংক্রামক এই ভাইরাস ঠেকাতে দেওয়া লকডাউনে বিশ্বজুড়েই বন্ধ গণপরিবহন চলাচল। অন্যান্য বাহনও রাস্তায় নামছে খুব সীমিত পরিসরে।

প্রকৃতপক্ষে করোনায় স্বাভাবিক নাগরিক পথচলা অনেকাংশে বদলে গিয়েছে। ঘরবন্দি হয়ে বসে না থেকে হোম অফিসের মতো নানা বিকল্প দেখা যাচ্ছে হরহামেশাই। তবে সব কিছু তো ঘরে বসে করা যায় না। দীর্ঘ দিন বন্দি থাকার পর মানুষ সাধারণ কাজকর্ম বা জরুরি প্রয়োজনেও বের হয়৷ গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় এই পথচলা ভীষণ দুষ্কর৷ একদিকে যানবাহন অপ্রতুল, অপর দিকে কোনো গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেলে লকডাউনে তা ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রাও বিলাসে পরিণত হচ্ছে। এখন তাই হন্য হয়ে বিকল্প বাহন খোঁজে বেড়ানোর সময়!

ইতালীয় কমিকস আর্টিস্ট ওয়াল্টার মলিনো ভবিষ্যতের বিকল্প বাহনের একটি সম্ভাব্য চিত্র এঁকেছিলেন। দ্যুমেনিকা দেল কুরিয়ার নামক এক ম্যাগাজিনে ১৯৬২ সনে প্রকাশিত সেই চিত্রে দেখা যায়- একটা নগরীর ব্যস্ত রাস্তায় প্রত্যেক নাগরিক কিছুটা টেস্টটিউবের মতো দেখতে আলাদা আলাদা কাঁচে ঘেরা মোটর গাড়িতে চড়ে পথ চলছে। কেউ কারো সরাসরি সংস্পর্শে আসছে না৷ যেন কাছে থেকেও নিদারুণ এক দূরত্বের প্রতিচ্ছবি। ছবিটির নিচে ইতালীয় ভাষায় একটা প্রশ্ন- আমরা কি শহরে এভাবে ঘুরবো?

আজ বহু বছর পর, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কোভিড নাইনটিন মলিনোর ছবিতে দেখানো সামাজিক দূরত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কল্পবিজ্ঞানের পাতা থেকে উঠে এসে বাস্তবেও হয়তো এমন বিকল্প বাহন রাস্তায় নামবে অদূর ভবিষ্যতে। তবে তেমন অত্যাধুনিক গাড়ি সহসাই সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হওয়ার সুযোগ কম। বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই, পরীক্ষা নিরীক্ষা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সক্ষমতা ইত্যাদি সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বহু সময় গড়িয়ে যাবে৷

আবার আমাদের দেশীয় অটোপার্টস নির্মাতারা করিমন-নছিমনের মতো এই ধরনের বাহনেরও স্থানীয় সংস্করণ তৈরিতে দক্ষতার পরিচয় দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মূল ব্যস্ততম শহরগুলোর জন্য তা অটোরিকশার মতো গলার কাটাও হয়ে উঠতে পারে। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। তবে আমাদের হাতের নাগালেই বহু বছর ধরে নানা ক্ষেত্রে প্রচলিত একটি বাহন রয়েছে, যার সম্ভাবনা আছে সহজলভ্য বিকল্প বাহন হয়ে উঠার- সাইকেল বা দ্বিচক্রযান।

যানজটে নাভিশ্বাস, সাইক্লিস্টদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় প্রচারণাসহ নানা কারণে গত ক’বছরে ধীরে ধীরে হলেও সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আর সংক্রামক রোগের প্রকোপে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিরাপদ চলাচলের জন্য খুঁজতে থাকা বিকল্প বাহন হিসাবেও বিবেচিত হতে পারে দ্বিচক্রযান। অর্থাৎ কোভিড নাইনটিনের ক্ষেত্রেও নতুন ভূমিকায় আবির্ভূত হওয়ার যথেষ্ট বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা রয়েছে বাহনটির।

বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন ব্যস্ত রাস্তায় দীর্ঘ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাজারো গাড়ি একই জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। জ্যামে বসে বারবার ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে যাত্রী আর চালকদের সময় কাটে। আর নিশ্চল জটের তীব্রতায় মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মাঝে মধ্যে শম্ভুক গতিতে একটু সামনে এগিয়ে যায় তো আবারও থেমে যেতে হয়। এভাবেই চলতে থাকে নাগরিক জীবন।

কখনো কখনো গন্তব্যের বেশ কিছুটা দূরে থাকতেই থেমে থাকা গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়ে যাত্রী। শুরু হয় হেঁটে হেঁটেই পথচলা। না হেঁটে বসে থাকলে সময়মতো পৌঁছানো আর হয়ে ওঠে না৷ বিরক্ত হতে হতে অবসাদে ভুগতে থাকা যাত্রীদের চমকে দিয়ে প্রায়শই সামনে ছুটে যায় কিছু দুই চাকার বাহন। বাস-প্রাইভেটকারের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া সেই দ্বিচক্রযান তাদের দেখিয়ে যায় নতুন সম্ভাবনা।

তবে সাধারণ মানুষ সেই দেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে, সম্ভাবনাকে বাস্তবে তাদের আর প্রয়োগ করা হয়ে ওঠে না। আবারও রাত শেষে দিন আসে, যানজটে নাভিশ্বাস ওঠে। পাশ দিয়ে দ্বিচক্রযানে চলে যায় কেউ। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে কোনো যাত্রী হয়তো বলে- ‘ইশ!’

কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সময় গড়ায়, বদলায় না এই দেখে যাওয়া আর সয়ে যাওয়ার চক্র। ভাবতে চায় না আমিও তো সাইকেলে পথ চলতে পারি। হয়তো অফিসে সাইকেলে গেলে ‘লোকে কী বলবে’ ধাঁচের সংকোচে ইচ্ছেটা বন্দি হয়ে যায়। অথচ বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অন্যের ঘামে নিজের শার্ট ভিজিয়ে অফিস করতে বিদঘুটে অস্বস্তিও খুব একটা পাত্তা পায় না।

সমাজের ধনী শ্রেণি অবশ্য স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, চার চাকার বিলাসবহুল মোটর গাড়ি হাকিয়েই ঘুরাফেরা করতে পছন্দ করে। সামাজিক দূরত্বের প্রশ্নে সাইকেল বা গণপরিবহণের সুবিধা-অসুবিধার আলাপ হয়তো তাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অপ্রাসঙ্গিক। তবে যানজট নিরসনের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তাদের ব্যক্তিগত মোটরগাড়িকে নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহণের চলাচল বৃদ্ধি করা একই ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

রাস্তায় চার চাকার একটা ব্যক্তিগত গাড়ি একটা মিনিবাসের কাছাকাছি জায়গা দখল করে। অথচ ব্যস্ততম সময়ে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দু-তিনজন যাত্রী বহন করে। একই সময়ে গণপরিবহনগুলোর প্রতিটি বহন করে পঞ্চাশের অধিক যাত্রী। আবার যাত্রী পৌঁছানোর পর প্রায়ই ব্যক্তিগত গাড়ির চালক খালি গাড়ি নিয়েই বাসায় বা অন্যত্র ফিরে যায়। ফলে অল্প কিছু মানুষের জন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে যানজটে ভুগতে হচ্ছে প্রতিদিন।

কোভিড নাইনটিনের পর সংক্রমণ ভীতির প্রভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ধনী শ্রেণি তো বটেই, উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যেও গাড়ি কেনার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যানজট ও সার্বিক পরিবেশে। রাস্তায় নেমে যাবে হাজারো গাড়ি, কিন্তু পথচলার পথ থাকবে না৷

একটা বাইসাইকেলে সাধারণত একজন আরোহণ করে। ব্যক্তিগত বাহন হিসাবে ব্যবহার করার জন্য এটি বেশ সহজলভ্য। গণপরিবহণে যেমন একই আসন হাজারো মানুষ ক্রমাবর্তনে ব্যবহার করে, সাইকেলে এমনটা হয় না৷ এছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লোকাল বাসে সিট স্বল্পতায় দাঁড়িয়ে, ঝুলে ঝুঁকি নিয়েও চলাচল করে শত শত মানুষ। বাইসাইকেল চলাচল বাড়ানো গেলে অফিস শেষে অসহায় মানুষের বাস নামক চলন্ত খাঁচায় বন্দি হয়ে, একে-অপরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাসায় ফেরার দৃশ্যও কমে আসবে।

সাইকেলের আকৃতি ও গঠনের কারণে পরিষ্কার করা সহজ৷ ছোটখাটো বাহন হওয়ায় জীবাণুনাশক ব্যবহারেও মিতব্যয়ী হওয়া যাবে। প্রতিবার ভ্রমণ শেষে তূলনামূলকভাবে দ্রুততর সময়ে জীবাণুনাশক ভর্তি ছোট্ট হ্যান্ডস্প্রে দিয়ে পুরো সাইকেলটা বেশ কয়েকবার জীবাণুমুক্ত করা যাবে। একই কাজ চার চাকার মোটর গাড়ি বা অন্যান্য বাহনে অনেকটাই সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলার হয়ে দাঁড়ায়।

সাইকেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে তূলনামূলক দেরি হবে ভেবে আমরা অনেকে ভুল করি। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম সাইক্লিং কমিউনিটি হিসেবে সুপরিচিত বিডিসাইক্লিস্টের ফেসবুক গ্রুপে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালেই দেখা যায় বহু মানুষ সাইকেলকে করেছেন অফিস যাত্রায় নিত্যসঙ্গী। তারা নিজেদের লেখায় অকপটে জানাচ্ছেন সাইকেলের কারণে আগের চেয়ে তাদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। সেখানে কিছুদিন আগে দেখলাম আখতার হোসেন নামক একজন সাইক্লিস্ট বলছেন, এলিফ্যান্ট রোড থেকে নয়াবাজারের অফিসে পৌঁছাতে বাসে ঘোরপথে গুলিস্তান হয়ে যাওয়া আসায় তাঁর ব্যয় হতো আড়াই ঘণ্টা, বাসে উঠতেই লাগতো ১০-১৫ মিনিট। সাইকেলে সেখানে ব্যয় হচ্ছে গড়ে মাত্র ৪০ মিনিট। তেমনিভাবে সেখানে আরও অনেকেই সাইকেলে অফিসে যাতায়াতের সুখকর নানা অভিজ্ঞতা তোলে ধরছেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি সবাই একটা বিষয়ে একমত সেটা হলো সময় সাশ্রয়। তাদের এই ইতিবাচক ভাবনা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে সাইকেলে অফিস যাত্রায় অস্বস্তি বা নানা অজুহাতও ক্রমশ হ্রাস পাবে।

একদিন ঠিকই হয়তো দেখতে পাবো যানজট, মোটর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, পোড়া ডিজেলের ধোঁয়ায় শহরগুলো ধুঁকে মরছে না। হাসিমুখে সাইকেল চালিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি আমরা পথে পথে। হয়তো দেখতে পাবো সাইকেল চালানোর জন্য ব্যস্ত সড়কের পাশে হয়েছে আলাদা লেন। ছোট বড় প্রতিষ্ঠান বা শপিংমলের নিচে সাইকেলের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে নিরাপদ পার্কিং লট। ধুলো মাখা শহরটা ছেয়ে গেছে সবুজে সবুজে... এমন নানা স্বপ্ন হয়তো একদিন সত্যি হয়ে উঠবে।

লকডাউন শেষে আমরা সবাই হয়তো ওয়াল্টার মলিনোর চিত্রের মতো আবদ্ধ নাগরিক জীবন নয়, চিরচেনা পুরনো পৃথিবীকেই ফিরে পেতে চাই। তবে করোনা পরবর্তী নতুন পৃথিবীটা পুরনোর সাথে একটা নতুনত্বের ছোঁয়া নিয়ে আসুক। যেখানে আমরা আমাদের ভুলে ভরা জীবনযাত্রায় লাগাম টানতে পারবো। যেখানে পৃথিবী ও আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পরিবেশসম্মত প্রয়োজনীয় বিকল্প ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠবো। সেটা হতে পারে পরিবহন অথবা ইতিবাচক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।



কুবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ