ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লকডাউন প্রত্যাহার কতটা জরুরি?

অনিল মো. মোমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২১, ১ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
লকডাউন প্রত্যাহার কতটা জরুরি?

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। এর শেষ কোথায় এখনো তার কোনো পূর্বাভাস করা যাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর এই মহামারিতে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ৬২ লাখের অধিক মানুষ; মৃত্যুবরণ করেছে ৩ লাখ ৭৪ হাজারেরও অধিক।

আর বাংলাদেশে ভাইরাসটিতে ৩১ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ৪৭,১৫৩ জন; মৃত্যু ৬৫০ জন। উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা। কার্যকর কোনো প্রতিষেধক এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো কূলকিনারা করতে পারেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসহায়ত্বও স্পষ্ট। সংস্থাটি তাদের এক ভার্চুয়াল প্রেস কনফারেন্সে জানিয়েছে, এই ভাইরাসটি আমাদের জাতিগত রোগ হিসেবে আমাদের সাথেই থাকতে পারে এবং হয়তো কখনোই শতভাগ নির্মূল হবে না। এই ভাইরাস কবে নির্মূল হবে, সেই ধারণা যে কেউ করতে পারে- তাও বিশ্বাস করতে চায় না WHO।

এদিকে করোনাভাইরাসের এমন পরিস্থিতিতে ভেঙে যাচ্ছে অর্থনীতি। ধেয়ে আসছে মন্দা। খাদ্যসংকট প্রকট হয়ে উঠছে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে মানুষ খাদ্যের খোঁজে, ত্রাণ সহায়তার খোঁজে। বাংলাদেশে বুভুক্ষু মানুষ ত্রাণ ছিনতাই করেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে যাওয়ায় কাজ হারিয়ে বেকার হচ্ছে মানুষ। বিশ্বজুড়ে বেকার সংখ্যা বেড়ে চলছে কল্পনাতীতভাবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে তিন মাসের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছেন। যার মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ বসবাস করেন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)'র মতে, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির কারণে ২৪ কোটি ২০ লাখ লোক চাকরি হারাতে পারেন।

এদিকে করোনা মহামারি আর লকডাউনের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বেকারের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪ কোটি। এপ্রিলে দেশটিতে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ, বিগত ৯০ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। এপ্রিল নাগাদ যুক্তরাজ্যে বেকার হয়েছে ২১ লক্ষ মানুষ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থাও নাজুক। শুধু গত মাসেই ভারতে ১২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ। এই দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য)।

গভীর অনিশ্চয়তার দিকে বিশ্ব অর্থনীতি। স্বাভাবিকভাবেই চারদিকে বেকারত্ব আর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করে দিয়েছে অর্থনীতিকে। ১৯৩০ দশকে গ্রেট ডিপ্রেশনের পর এই প্রথম করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধস নেমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ ধারণা করছে যে, লকডাউনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি এ বছর তিন শতাংশ সংকুচিত হবে। সংস্থাটির মতে, অর্থনীতিতে কোভিড-নাইনটিনের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে ২০২০ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসে। অন্যদিকে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে করোনায় বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি দাঁড়াবে ৯ লাখ কোটি ডলার। আর দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) করোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪ হাজার ২০০ কোটি থেকে ২১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের মতো। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে করোনা মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সার্বিকভাবে এবার দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ কমবে।

এমন বাস্তবতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন লকডাউন তুলে দিচ্ছে। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি আর নিয়মাবলির বেড়াজালে অর্থনীতি চলমান রাখার লড়াইয়ে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে লকডাউন। বাংলাদেশও হাঁটছে সে পথে। জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়েই খুলে দিচ্ছে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ গণপরিবহন। বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকলেও সরকারে কাছে লকডাউন প্রত্যাহারের বিকল্প নেই। অন্তত মন্দের ভালো হিসেবেও এটাকে ইতিবাচকভাবে নেওয়া যায়।

গ্রামের মানুষ বলে থাকে ‘মরুম দেইখা করুম না, বাঁচলে খামু কী?’ তাই বেঁচে থাকার তাগিদে হলেও অর্থনীতির দুয়ার খুলতে হবে। তাছাড়া সবাই দেখেছি দেশে ৭ ধাপে বাড়ানো সাধারণ ছুটি তথা অঘোষিত লকডাউন তেমন কোনো কার্যকর ফলাফল আনতে পারেনি। সাধারণ মানুষের ভেতর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি আর সামাজিক দূরত্ব অনেকাংশেই বজায় রাখা হয়নি। এসব ছুটিতে শুধু ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ’ নিশ্চিত হয়েছে, করোনার সংক্রমণ নয়। সাধারণ ছুটির এক একটা দিনই ছিল করোনা শনাক্ত ও মৃতের রেকর্ড, যা এখনো চলমান। তাই লকডাউন তুলে অর্থনীতির দ্বার উন্মুক্ত করা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে জনজীবন স্বাভাবিক করা সময়েরই দাবি। লকডাউন প্রত্যাহারে দেশের অর্থনৈতিক আর্শিবাদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষগুলো।

সরকার স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যেসব নিয়মকানুন মেনে জনজীবন আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বলেছে, সেসব মেনে চললে করোনা সংক্রমণ এখনো কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব নিয়ম মানা প্রতিটা নাগরিকের কর্তব্য। সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারের পাশাপাশি সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

অন্যদিকে, নিয়মগুলোর সফল বাস্তবায়নে সরকারকেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগে সরকারকে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া বাকি সব কিছুতে জিরো টলারেন্স নীতি অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। এতে করে জীবন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

ইবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়