ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনা: ধিক্কার বনাম ভিক্ষা

শাহেদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ২ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনা: ধিক্কার বনাম ভিক্ষা

কোভিড-১৯ বা করোনা। এটি একটি অদৃশ্য মারণাস্ত্র। অনেকে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে পাপীদের জন্য অভিশাপও বলছেন। এটি ধরাছোঁয়া যায় না, তারপরেও এটি এখন ঘাতক। এমন ঘাতক, যেটি দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে একটি তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বকে খুব স্বল্প সময়ে মৃত্যুপুরী বানাতে হয়, আর কীভাবে ভেঙে তছনছ করে দিতে হয়।

এর উৎপত্তি বিশ্বের বাঘা রাষ্ট্র নামে খ্যাত চীনের উহান শহর থেকে। কোন মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছে, তা নিয়ে হয়েছে অনেক বাক্য ব্যয় এবং বাকবিতণ্ডা। অনেকে অনেক তথ্য দিয়েছে এর সংক্রমণ কোন মাধ্যমে ছড়িয়েছে তা নিয়ে। কিন্তু সব তথ্য ছিল ধারণা প্রসূত।

গত বছরের শেষ দিকে চীনে এক তাণ্ডবলীলার জন্ম দেয় বিজ্ঞানীদের ভাষার এই করোনা। তাণ্ডবলীলায় খণ্ড-বিখণ্ড করেছে পুরো চীনকে। চীনে যখন এই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত এবং দেশটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল, অন্যান্য দেশ তখনও ঘোরের মধ্যে ছিল। অনেক দেশ ভেবেছিল এই ভাইরাস আমাদের দেশে ছড়াবে না, আমাদের দেশে ছড়ানোর আগেই এই ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেনের মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও হয়তো ভেবেছিল করোনা! এই ভাইরাসটা আমাদের কী করে ঘ্রাস করবে? না করারই কথা। কারণ, তারা পরমাণু অস্ত্র দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো রাষ্ট্র। কত বড় বড় ভাইরাস (রূপক অর্থে) তাদের হাতে পরাজিত আর নাজেহাল। আর করোনা! এটি তো ক্ষুদ্র একটা ভাইরাস। আবার মুসলিম বিশ্ব ছিল আরেক কুসংস্কারে। অনেকে ভেবেছিল তারা মুসলিম প্রধানদেশ, এই ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগই নেই। আবার মুসলিমদের কিছু বড় বড় ধর্মীয় নেতারাও বলেছিল মুসলিম বিশ্বে কেন এই ভাইরাস ছড়াবে? করোনা তো এসেছে বিধর্মীদের জন্য। তার মানে মুসলিম প্রধান দেশে এই ভাইরাস ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই না থাকার কথা।

এমন অমানিশার মধ্যে কাটলো কিছুদিন। বিশ সাল প্রবেশ করলো।  বিশে যেন বিষই নিয়ে আসছে মানবজাতির জন্য। বছরের শুরুর দিকে চীনে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল এই ভাইরাস। তাণ্ডবলীলাও চালিয়েছে ব্যাপক। চীনের মতো রাষ্ট্র কোনো দিন ভাবেওনি যে, অদৃশ্য একটা ভাইরাসের কাছে তাদের নাকানিচুবানি খেতে হবে। চীনের মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংবাদ দেখে আমরা কতই না বলেছিলাম, তারা মানুষকে নির্যাতন করেছে। এটা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে।

করোনার ভয়াল ঘ্রাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে চীন নামক রাষ্ট্রটি, তখনও পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাইসার প্রতিরোধে সচেনতা তৈরি বা সেটি মোকাবিলা করার চিন্তা ধারার কোনো বালাই মাত্রই ছিল না। তখনো অন্যান্য দেশের মানুষ টিভির স্ক্রিন খুলে চীনের আক্রান্ত ও মৃতের সংবাদ শুনে হা-হুতাশ করতো। এসব সংবাদ দেখে দেখে বলতো হ্যাঁ নে এসব তোদের পাপের ফল। হ্যাঁ একটা কথা চীনের এমন দুর্যোগে অনেক রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তত দিনে করোনার বিশ্বের বিভিন্ন ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছে।

২০ সালের মাস দুয়েক যেতেই ব্যাপক সংক্রমণ ধরা পড়া শুরু করেছে ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে। সংক্রমণের কিছুদিন যেতে না যেতেই জ্যামিতিক হারে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে লাগলো সংক্রমণ হওয়া দেশগুলোতে।  এখন সে ভাইরাস আর পরমাণু শক্তি আর ধর্মীয় নেতার রাষ্ট্র দেখছে না। সমানে চীনের ন্যায় তাণ্ডব চালাচ্ছে৷ মানুষ মরছে। বিভিন্ন মিডিয়া খুললেই দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু দেশ নাকি মৃত মানুষগুলোকে কবর দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কবর দেওয়ার জায়গাও নাকি নেই তাদের। তাই অনেক দেশ বাধ্য হয়ে গণকবর দিচ্ছে। সংক্রমণ ও আক্রান্ত হওয়ার ধরণ দেখে অনেক দেশ তার নাগরীকদের জন্য অতিরিক্ত কবরও খুঁড়ে রেখেছে। হাহাকার করা শুরু করেছিল পুরো পৃথিবী। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত।  রাজনৈতিক আর সামরিক দেমাকও হার মেনেছে এই ভাইরাসের কাছে।

তবে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতার চিত্র ফুটে উঠছে পৃথিবীর বাঘা রাষ্ট্রসমূহের চিকিৎসা ব্যবস্থায়। এই ভাইরাস না আসলে বোঝায় যেত না যে, তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের নিচেও লুকিয়ে আছে অনেক দুর্বলতা। মুহূর্তের মধ্যেই তালকে তিল আর তিলকে তাল বানাতে পারে এমন রাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে নেই নাকি পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর, পিপিই এবং মাস্কসহ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। কী করবে তারা এখন? কীভাবে পাবে এসব সরঞ্জাম? দেশ যে অবস্থায় পৌঁছে গেছে রাষ্ট্র এসব বানিয়ে সরবরাহ করবে, তার কথা মাথায় আনার সুযোগ নেই। ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নইলে দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে না। কথা হলো এসব পাবে কাদের কাছে?

এখন ভাবতে হবে কাদের কাছে এসব প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। হোক সেটা শত্রু রাষ্ট্র। শত্রু রাষ্ট্রের হলেও তা যে কোনো উপায়ে পেতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে ভিক্ষুক সাজতে হবে, নতুবা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে। এবার আসি মূল কথায়। অথচ পারমাণবিক আর রাসায়নিক অস্ত্রের দাপটে যে রাষ্ট্রগুলোকে রাষ্ট্র বা যে রাষ্ট্রের মানুষগুলোকে মানুষই মনে করা হত না।  কথায় কথায় তাদের ধিক্কার দিয়েছে, এখন কেন সামান্য ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য ভিক্ষুক সাজতে হচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই যাদের অস্ত্রের ভয় দেখানো হতো, তাদের কাছে কেন হাত পাততে হচ্ছে? জানা ছিল না যে, মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়? জানা কি ছিল না যে, কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ? এখন কই গেলো মোড়ল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সামরিক শক্তি? এখন কই অস্ত্রের ঝনঝনানি?

এবার আসি ছোট্ট একটা ভূখণ্ড বাংলাদেশের কথায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলেই কিছু হৃদয়বিদারক সংবাদ চোখে পড়ত। যে সংবাদগুলোর কথা ভাবলেই নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে ভাবতে লজ্জ্বাবোধ হতো। সেরকম কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে করোনার ফলে আমরা কতটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছি। কতটা ধিক্কার আমরা দিয়েছিলাম করোনায় আক্রান্ত রোগীদের। ১. করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে সন্তান কর্তৃক মাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া। ২. করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় মধ্যরাতে মালিক কর্তৃক ভাড়াটিয়াকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া। ৩. দলবদ্ধভাবে করোনায় আক্রান্ত পরিবারের বাড়িঘর ভাংচুর করা। ৪. করোনার ভয়ে হাসপাতালে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা না দেওয়ার ফলে বি না চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়া।

উপরের ঘটনাগুলো ভালোভাবে চিন্তা করলে কি বোঝা যায় না যে, আমরা করোনাকে কত বড় কলঙ্ক হিসেবে দেখেছি। আমরা কি তাদের ধিক্কার দেইনি? অথচ করোনা এইডসের মতো কোনো পাপের ফল ছিল না। তাও কি সমাজ একজন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়নি? অথচ সমাজের কি উচিৎ ছিল না তাদের প্রতি সুহানুভূতিশীল হওয়া, বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো? না সমাজ তা করেনি। সমাজ পরিচয় দিয়েছে অমানবিকতার পরিচয়। এইতো এপ্রিল মাসের শুরুর দিক পর্যন্ত আমরা মানুষের কাছে অমনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছি। রাষ্ট্রসহ রাষ্ট্রের মানুষগুলো বোঝেনি হঠাৎ করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া শুরু করবে আশংকাজনক হারে। আক্রান্ত এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। সাথে সাথে প্রকৃতি তার শাস্তিও মানুষকে দিচ্ছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’।  

হ্যাঁ, তবে আমরা এখানে ইটের পরিবর্তে পাটকেল খাবো না। তবে এখন ধিক্কারের পরিবর্তে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছি। এইতো কয়দিন আগেও আমরা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ভাবতাম, তারা সমাজের সবচেয়ে ঘৃণিত ও পাপিষ্ঠ। তাদের সমাজ থেকে একঘরে করে দিতে হবে। তারা সমাজের কেউই না।

মানুষের উচিৎ সবার সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে পৃথিবীকে একটা সুন্দর আবাসস্থল হিসেবে তৈরি করা। একটাই সমাধান, পৃথিবীর যত বড় দুর্যোগ আসুক না কেন হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সব জাতিকে একত্রিত করে সবার পাশে সবাই থেকে দুর্যোগ মোকাবিলা করার চেষ্টা করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

ইবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়