ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শ্রেষ্ঠার শ্রেষ্ঠত্বের গল্প

আরাফাত বিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১০, ১০ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
শ্রেষ্ঠার শ্রেষ্ঠত্বের গল্প

শ্রেষ্ঠা চৌধুরী

বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, লেখালেখি সব বিষয়ে সমান দক্ষতা শ্রেষ্ঠার। পড়াশোনায়ও তুখোড় মেধাবী। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার কিছু দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার মা মারা যান। তবুও মনোযোগ দিয়ে পড়ে ভালো ফলাফল করেন তিনি।  বলছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী শ্রেষ্ঠা চৌধুরীর কথা।

ছোট থেকেই উপস্থিত বক্তৃতায় বেশ পটু শ্রেষ্ঠা চৌধুরী। ২০১৫ সালের কথা। শ্রেষ্ঠা তখন চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগির সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়েন। উপস্থিত বক্তৃতায় পটু দেখে একদিন তমা দেবী নামের এক সিনিয়র শিক্ষার্থী প্রস্তাব দেয় একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার। তখনও বিতর্কের অ আ ক খ কিছুই জানেন না শ্রেষ্ঠা। শিখিয়ে দেওয়ার শর্তে শ্রেষ্ঠাও রাজি হয়ে যায় কিছু না ভেবেই। তাকে বিতর্কের সব নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেয় সেই তমা দেবী, আর বিতর্ক দলের আরেক সদস্য প্রযুক্তা প্রেরণা।

পরদিন জীবনের প্রথম বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন দলনেতা হিসেবে। প্রথম বিতর্কেই বাজিমাত করে শ্রেষ্ঠা। এক এক করে ফাইনালে পৌঁছে যায় শ্রেষ্ঠার দল ডা. খাস্তগির সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। জিতে নেয় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার।

এরপর থেকে শুরু হয় বিতর্কে শ্রেষ্ঠার সরব পদচারণা। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জিতে নেন নানা পুরস্কার। এরমধ্যে অন্যতম হলো ২০১৬ সালে জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সেই প্রতিযোগিতায় পুরো বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠা।

কিশোরকাল থেকেই লেখালেখি করে শ্রেষ্ঠা। ২০১৬ সালে তার লেখা ‘The life between' নামের উপন্যাসটি চারদিকে সাড়া ফেলে দেয় রীতিমতো। ১৬ বছর বয়সেই পেয়ে যায় ঔপন্যাসিক খেতাব। বইটি লিখেছিলেন মূলত ১৪ বছর বয়সে, ২০১৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। সেটা বই হিসেবে প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে। এরপর অবশ্য আর কোনো বই লেখা হয়নি, তবে লেখালেখি যে থেমে আছে তাও নয়। এখনও মাঝে মাঝে নানা ধরনের ছোট গল্প লিখেন তিনি। শিক্ষার্থী হিসেবেও কম যায় না শ্রেষ্ঠা। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।

বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি দারুণ রপ্ত করেছেন শ্রেষ্ঠা। ২০১৫ সালে এইচএসবিসি-প্রথম আলো আয়োজিত ‘ভাষা প্রতিযোগ’-এ জাতীয় পর্যায়ে ২য় রানার আপ হন তিনি। এর পরের বছর বায়োলজি অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে হয় প্রথম রানার আপ। পড়াশোনায়ও দারুণ মনোযোগী শ্রেষ্ঠা।  ২০১৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চট্টগ্রাম বোর্ডে পঞ্চম হন তিনি। ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় হন তৃতীয়।

তার এমন আলোকোজ্জ্বল পথচলায় বাবা-মা সবসময় ছিলেন পেছনের কারিগর হয়ে। কিন্তু গত বছরের ৩ আগস্ট একটা সড়ক দুর্ঘটনা সব কিছু উলটপালট করে দেয় যেন। শ্রেষ্ঠার মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। সেদিন দুজন সহকর্মীর সাথে স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের বহনকারী সিএনজি চালিত অটোরিকশাকে মুখোমুখি ধাক্কা দেয় একটি ট্রাক। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন শিক্ষিকা। ষষ্ঠ দিনের মাথায় মারা যান অন্য আরেকজন। সবশেষে ২২ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ২৩ আগস্ট ভোর ৪টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে মারা যান শ্রেষ্ঠার মা।

শ্রেষ্ঠা বলেন, ‘এর কিছু দিন পর আমার ভর্তি পরীক্ষা ছিল। তাই পড়াশোনার সমস্যা হবে বলে আমাকে মায়ের অবস্থা বিস্তারিত জানাতো না কেউ। ২৩ আগস্ট ভোর রাতে মায়ের জরুরি ওষুধ লাগবে বলে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যান। পরে জানতে পারি মা আর নেই। মা নাকি অ্যাক্সিডেন্টের দিন তার এক সহকর্মীকে বলেছিলেন, তার মেয়ে ঢাকা মেডিকেলে পড়বে।’

মায়ের কথা মিথ্যে হতে দেননি শ্রেষ্ঠা। মা হারানোর শোক বুকে নিয়েও মা মারা যাওয়ার মাস দেড়েকের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন শ্রেষ্ঠা। পরীক্ষার হলে ঢোকার কিছুক্ষণ পূর্বে তাকে দেখে কোনো এক অভিভাবক তার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলেন। এতে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পরীক্ষায়ও পড়ার কথা, তবে পরীক্ষা খুব যে খারাপ হয়েছে তা নয়। ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় শ্রেষ্ঠা ৮৬তম হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

রেজাল্ট শুনে বাবা খুবই খুশি হয়েছেন। মাও নিশ্চয় ওপার থেকে শ্রেষ্ঠার ভালো ফলাফলের কথা জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছেন। শ্রেষ্ঠা বলেন, ‘মায়ের মৃত্যুর পর রেজাল্টের দিনই বাবা প্রথম হেসেছেন। এ দিকে মায়ের চাওয়াটাও পূর্ণ হয়েছে। তাই রেজাল্টটা আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা ভালো না হলেও আমার কাছে এর গুরুত্ব অসীম।’

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।


চট্টগ্রাম/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়